চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ায় বান্দরবানেও একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপের আত্মপ্রকাশ
বান্দরবানে চলতি বছরের মার্চে আত্মপ্রকাশ হওয়া জেএসএস এমএন লারমা (সংস্কার) গ্রুপের ছয় নেতা-কর্মী বাগমারা এলাকায় পার্টি অফিসের পাশে অতর্কিত হামলায় নিহত হয়েছেন।
নিহতরা হলেন- বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি রতন তংচংগ্যা (৬০), কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি বিমল কান্তি চাকমা (৬৫), কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ডেবিট মারমা (৫০) এবং দলের সদস্য জয় ত্রিপুরা (৪০), দিপেন ত্রিপুরা (৪২) ও মিলন চাকমা (৬০)।
জেএসএস এমএন লারমা (সংস্কার) দলের বান্দরবান কমিটির সেক্রেটারি উবা মং মারমা দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য জানান।
এ ঘটনায় আহত হয়েছেন বিদ্যুৎ ত্রিপুরা (৩৭), নিরন চাকমা (৫০) এবং হ্লা ওয়াং চিং মারমা (২৫)।
আহতদের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদেরকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান বান্দরবান সদর হাসপাতালের চিকিৎসক অজয় কিশোর বড়ুয়া।
উবা মং এই হামলার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতিকে দায়ী করেছেন।
তিনি বলেন, ‘সকাল পৌনে সাতটার দিকে পাঁচ জন সশস্ত্র লোক আমাদের পার্টি অফিস এলাকাটি ঘিরে ফেলে। তাদের মধ্যে তিন জন রতন তংচংগ্যার বাড়িতে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায়। হামলায় ঘটনাস্থলেই আমাদের ছয় নেতা-কর্মী নিহত হন’, বলেন উবা মং।
তিনি জানান, রতন তংচংগ্যা ছাড়া নিহত এবং আহত সাত জনই খাগড়াছড়ির বাসিন্দা।
উবা মং বলেন, ‘নিহত এবং আহত দুজন গত ৩১ মে থেকেই এখানে অবস্থান করছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘চলতি বছরের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামে এক প্রেস কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে আমাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে।’
রতন তংচংগ্যার স্ত্রী মিনি মারমা বলেন, ‘সকালে আমার স্বামী এবং বিমল উঠানে বসে গল্প করছিলেন। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। এসে দেখলাম তাদের নিথর দেহ পড়ে আছে।’
বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রেজা সারোয়ার বলেন, ‘আমরা মরদেহ এবং আহতদের উদ্ধার করে বান্দরবান সদর হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম।’
ঘটনাস্থলে পুলিশ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অতর্কিত এই হামলা কারা চালিয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে আমরা তা বলতে পারছি না।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির নেতা কে এস মং মারমা বলেন, ‘জন সংহতি সমিতি হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাসী না। আমরা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।’
গত ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে কয়েকজন ক্ষমতাসীন দলের নেতা একটি বিশেষ বাহিনীর কিছু সদস্যের সহায়তায় বেশ কিছু দুষ্কৃতিকারীকে আশ্রয় দিয়ে আসছিল এবং তারাই পরবর্তীতে মগ পার্টি নামে এলাকায় জন সংহতি সমিতির সদস্য ও বিভিন্ন পাড়ার নিরীহ জুম্মদের হত্যা এবং অপহরণ করছে বলে অভিযোগ করেন জন সংহতি সমিতির কয়েকজন নেতা।
তারা জানান, মগ পার্টির অনেকেই পরবর্তীতে বান্দরবানে মার্চে আত্মপ্রকাশ হওয়া জেএসএস এমএন লারমা (সংস্কার) গ্রুপে যোগ দেয়।
স্থানীয়দের অনেকেই মনে করছেন মগ পার্টি এবং সংস্কার গ্রুপের আবির্ভাবের আগে পর্যটন জেলা বান্দরবানে শান্তি এবং সম্প্রীতি বজায় ছিল।
২০১৯ সালের ২৫ জুন বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির একজন সমর্থককে গুলি করে হত্যা করা হয়।
একই বছরের ৭ মে সদর উপজেলার রাজবিলা এলাকায় পিসিজেএসএসের আরও এক সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং এর দুই দিন পর একই উপজেলার বাকিছড়া এলাকায় মগ পার্টি পিসিজেএসএসের আরও একজনকে গুলি করে হত্যা এবং পুলাধন তংচংগ্যা নামে আরও একজনকে অপহরণ করা হয়।
১৯ মে সদর উপজেলায় রাজবিলা এলাকায় একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলা, যেটি বান্দরবানের রাজবিলার পার্শ্ববর্তী এলাকা সেখানে যুবলীগের আরও একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
২৫ মে বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চ থোয়াই মং এর গুলিবিদ্ধ মরদেহ কুহালং ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।
চ থোয়াই যিনি বান্দরবান ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার ছিলেন, গত ২২ শে মে তার খামার বাড়ি থেকে থাকে অপহরণ করা হয়েছিল।
চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি সদরের জামছড়ি এলাকায় একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং পাড়ার পাঁচ জন গুরুতর আহত হন।
১৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি উপজেলার কেনাইজু পাড়ায় মগ পার্টির এক জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
১৫ জুন বান্দরবানের কুহালং ইউনিয়নের একজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) থেকে বের হয়ে ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে পিসিজেএসএস-এমএন লারমা গ্রুপের আত্মপ্রকাশ হয়েছিল।
২০১৭ সালের ১৫ তারিখ খাগড়াছড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে ইউপিডিএফ ফেকশন এর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
১৯৭২ সালে পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের জন্য জন সংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর এমএন লারমার ছোট ভাই সন্তু লারমার নেতৃত্বে পিসিজেএসএস সিএইচটি পিস অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করেছিল।
অনেকেই মনে করছেন, শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়াতেই পাহাড়ের এই ভ্রাতৃ সংঘাত থামছে না।
এই সংঘাতে শত শত দলীয় লোক ছাড়াও নিরীহ অনেক পাহাড়ির জীবন প্রদীপ নিভে গেছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘একদিকে শান্তি চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, অন্যদিকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করছে।’
তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলে হত্যাকাণ্ড বন্ধ না হওয়া সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে পাহাড়ে অপ্রত্যাশিত ঘটনা বন্ধ হবে।’
Comments