‘সব খেয়েছে তবুও পিছু ছাড়ছে না ধরলা’

নদী ভাঙনে আবাদি জমি, ফলের বাগান, প্রিয় বসতভিটা সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব আলিম উদ্দিন (৯০) ও বাসের উদ্দিন (৮০)। যৌবনকাল থেকে ধরলা নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন তারা।
Lalmonirhat erosion victims
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের কুরুল গ্রামে ধরলার ভাঙনের শিকার আলিম উদ্দিন (৯০) ও বাসের উদ্দিন (৮০)। ৭ জুলাই ২০২০। ছবি: স্টার

নদী ভাঙনে আবাদি জমি, ফলের বাগান, প্রিয় বসতভিটা সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব আলিম উদ্দিন (৯০) ও বাসের উদ্দিন (৮০)। যৌবনকাল থেকে ধরলা নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন তারা।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের কুরুল গ্রামে বাস করছেন জীবনের সঙ্গে লড়াই করে। দুজনই সরকারের বয়স্কভাতা পান। কিন্তু, ধরলার বুকে সবকিছু হারানোর দৃশ্য, স্মৃতি ভুলতে পারেন না তারা। একটু সময় পেলে দুজনে এক সঙ্গে ছুটে আসেন ধরলার পাড়ে আর নীরব-নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকেন ধরলার দিকে যেখানে ছিল তাদের জমি-জমা, বসতভিটা ও বাগান। কখনো কখনো তারা নীরবে চোখের অশ্রু ঝরিয়ে আবার ফিরে যান বাড়িতে।

আলিম উদ্দিন ও বাসের উদ্দিন একে অপরের আত্মীয় নন। কিন্তু, জন্ম থেকে একই গ্রামের অধিবাসী। এক সঙ্গে বড় হয়েছেন। এক সঙ্গে ধরলার সঙ্গে লড়াই করে হারিয়েছেন সবকিছু। এখনো পাশাপাশি বসবাস করছেন। শেষ বয়সেও এক সঙ্গে চলাফেরা করছেন।

আলিম উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বললেন, ‘ধরলা নদী সবকিছুই খেয়েছে। কিন্তু, এখনো পিছু ছাড়ছে না। সবকিছু হারিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের পাশে এক টুকরো জমিতে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু, ধরলার ভাঙন সে দিকেও ছুটে আসছে। শেষ আশ্রয়টুকুও যদি ধরলা কেড়ে নেয় সেই আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি।’

তিনি জানান, স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ২৫ বার বসতভিটা সরিয়েছেন। গেল কয়েক বছর থেকে বসতভিটা সরানোর বেদনা থেকে দূরে আছেন। কিন্তু, এ বছর ধরলার ভাঙন তার বসতভিটার দিকে ছুটছে।

তিনি ৯০ বিঘা জমির মালিক ছিলেন। এখন ৯০ শতাংশ জমিও তার নেই। এক সময় তার আবাদি জমি, ফলের বাগান, বাঁশঝাড়, গোয়ালভরা গরু ও সাজানো বসতভিটা ছিল। এখন সবকিছু স্বপ্নের মতো তার কাছে।

‘ধরলার প্যাটোত সোককিছু গ্যাইছে তাঙ ধরলা হামার পাছ ছাড়ে না। ধরলা হামাক নিঃস্ব গরিব করা ফ্যালাইছে। তাঙ ধরলা হামার ভিটার দিকে আইসবার নাগছে,’ বললেন আলিম উদ্দিন।

বাসের উদ্দিনেরও ছিল ৪৫ বিঘা জমি। সবই এখন ধরলার বুকে। সবকিছু হারিয়ে বাঁধের পাশে এক টুকরো জায়গার ওপর কোন রকমে জীবন চালাচ্ছেন। আগে সারা বছরই ঘরের ধানে সংসার চলতো। এখন প্রতিদিন চাল কিনে সংসার চালাতে হয়।

জীবনের অনেক গল্প, অনেক স্মৃতি সবকিছুই ধরলার বুকে লুকিয়ে রয়েছে। এক সময় গ্রামের অনেক মানুষ তার বাড়িতে কাজের জন্য আসতেন। এখন তার সন্তানরা কাজের জন্য ছুটছেন অন্যত্র। জীবনে ২০ বার বসতভিটা সরানোর দুঃসহ স্মৃতি রয়েছে তার। প্রত্যেকবার বসতভিটা সরাতে জমানো টাকা খরচ করেছিলেন। দারিদ্রের কষাঘাতে জীবনকে সংগ্রামী করে তুলেছেন তিনি।

‘সময় পাইলে হামরা ধরলার পাড়োত আইসোঙ। এটেকোনা আসিয়া হামরা বসি বসি থাকোঙ। মাঝে-মধ্যে চোথের পানি ফ্যারাঙ। কী ছিল হামার জীবন, এ্যালা কী হইছে! ফের যে কী হয়,’ বাসের উদ্দিনের কণ্ঠেও অনিশ্চয়তার আশঙ্কা।

আবারো ধরলার ভাঙন তার শেষ আশ্রয়ের দিকে ছুটে আসছে বলে আশঙ্কা-উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

ধরলাপাড়ে আলিম উদ্দিন ও বাসের উদ্দিনের মতো শত-শত ভুক্তভোগী রয়েছেন যারা আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধে ও সরকারি রাস্তার ওপর। নদীপাড়ে ছোট ঘর করে বাস করছেন। তাদের সবার পরিবারেই রয়েছে হারানোর গল্প। বেদনাভরা জীবন নিয়ে তবুও তারা বাস করছেন নদীপাড়ে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল কাদের দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কুরুল এলাকায় ধরলার ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে জিও-ব্যাগ প্রস্তুত করা হচ্ছে।’

শীঘ্রই তা ডাম্পিং ও প্লেসিং করে ভাঙন ঠেকানো হবে বলেও জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
VIP movements are Dhaka’s undiagnosed illness

VIP movements are Dhaka’s undiagnosed illness

If the capital's traffic condition makes you angry, you're normal

8h ago