‘গানে প্রতিষ্ঠার আগে মনোহারী দোকান দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর’

পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত জাতীয় মুক্তির আন্দোলন মুখর দিনগুলোতে রাজশাহীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সমৃদ্ধির যে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছিল সেই আলোতেই বেড়ে ওঠেন সদ্য প্রয়াত জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর।
Andrew Kishore
২০১১ সালের নভেম্বরে রাজশাহীর তৎকালীন উত্তরা কমিউনিটি সেন্টারে এক অনুষ্ঠানে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: আনোয়ার আলী

পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত জাতীয় মুক্তির আন্দোলন মুখর দিনগুলোতে রাজশাহীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সমৃদ্ধির যে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছিল সেই আলোতেই বেড়ে ওঠেন সদ্য প্রয়াত জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর।

এখনকার বাস্তবতায় তার মতো জাতীয় সম্পদে পরিণত হতে পারে এমন গুণী শিল্পী আবার কবে জন্ম নিবেন তা বলা কঠিন।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে এ কথাগুলো বলেছেন রাজশাহীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা রুহুল আমিন প্রামাণিক। তিনি রাজশাহীর লেখক পরিষদ ও কবিদের প্রতিষ্ঠান কবিকুঞ্জের সভাপতি।

এন্ড্রু কিশোরকে ঢাকামুখী করার ও জাতীয় পর্যায়ে পা রাখতে যারা ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম। মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন প্রামাণিক কলেজের অধ্যাপকও ছিলেন।

‘এন্ড্রু কিশোর আমার চোখের সামনেই বড় হয়েছে। আমাদের বয়সের ব্যবধান থাকলেও, কিশোর আমার ঘনিষ্ঠ ছিল। আমাদের আত্মার অভিপ্রায় ছিল একই— মানুষের কল্যাণ।’

‘আসলে সে অসাধারণ প্রতিভাধর ছিল। ছেলেবেলা থেকেই তার কণ্ঠ সবার দৃষ্টি কাড়তে শুরু করেছিল। তার গলায় গান ছোট-বড় সবাইকে মুগ্ধ করত।’

তিনি বলেন, ‘কিশোরের বেড়ে ওঠার সময়টায় রাজশাহীর সংস্কৃতি অঙ্গন অনেক সমৃদ্ধ ছিল, যেটা তাকে সংগীত শিল্পী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।’

‘কিশোরের যিনি গানের শিক্ষক— ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু তিনি ছিলেন রাজশাহীর সংগীতাঙ্গনের এক মহীরূহ। শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে তিনি জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন। তিনি নিজেও গান গাইতেন। তার কাছে গান শিখে অনেকে আজও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতাঙ্গন মাতিয়ে রাখছে। তাদের মধ্যে ইফফাত আরা নারগিস, রফিকুল আলম অন্যতম।’

‘তখন একদিকে যেমন ওস্তাদ হরিপদ দাস ছিলেন, তেমনি ছিলেন ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন, কানু মোহন গোস্বামী, ওস্তাদ রবিউল ইসলাম, আব্দুল মালেক খান, আব্দুল জব্বার, পরশ ভট্টাচার্য, স্মৃতিকণা মজুমদার ও অনুপ কুমার দাসের মতো গুণী শিল্পী। এদেরসহ আরও অনেক প্রতিভাধর শিল্পী যারা জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছেন তাদের সাহচর্য পেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর।’

’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৪-র আন্দোলন ও ৬২-র শিক্ষা আন্দোলনে রাজশাহীর সংগীত শিল্পীরা বরাবরই ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে ৬৯-র গণঅভ্যুত্থানের সময় এন্ড্রু কিশোর ও তার সমসাময়িক শিল্পীদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা পাঁচ/ছয়টি ট্রাকে চড়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে গণসংগীত গাইতেন। অনেক সময় দেখেছি গণসংগীতে ছেলাবেলাতেই এন্ড্রু কিশোর নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং অন্যরা যারা তার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন তারাও তার কণ্ঠে সুর মিলিয়েছেন। রাজশাহীতে জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস এন্ড্রু কিশোরকে বাদ দিয়ে হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেনের ছাত্র ছিলেন ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু। ওস্তাদ বাচ্চু আমাকে দেখলেই “পূর্ব বাংলা” বলে ডাক দিত। বলত, “এই পূর্ব বাংলা এদিকে আয়”। তাকে দিয়ে আমরা অনেক কবিতা আন্দোলনের জন্য গান করিয়ে নিয়েছি। এছাড়াও, সুকান্ত ভট্টাচার্যের “হে সূর্য! শীতের সূর্য! হিমশীতল সূদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়” এটা সুর করিয়ে নিয়েছি। শামসুর রাহমানের “জীবন মানেই তালে তালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলা, নিশান ওড়ানো, জীবন মানেই অন্যায়ের প্রতিবাদে শূন্যে মুঠি তোলা”— এগুলো ছিল কবিতা, কিন্তু আমরা তাকে দিয়ে এগুলো সুর করিয়ে নিয়েছি। তার ছাত্ররা অর্থাৎ এন্ড্রু কিশোররা দল বেঁধে পথে পথে এ গানগুলো গেয়ে বেড়িয়েছে। আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেছে। নাট্যশিল্পী অধ্যাপক রহমত আলী, ওয়াহিদা মল্লিক জলি তারাও তখন ছিলেন।’

‘আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করি যেটা শহরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই প্রভাব বিস্তার করেছিল। এন্ড্রু কিশোররা সংস্কৃতি কর্মীদের সংগঠিত করতে তখন অনেক শ্রম দিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে অসিত সেন, সুখেন কুমার, প্রশান্ত সাহাও ছিল।’

‘এন্ড্রু কিশোর মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে গিয়েছিল। সেখানে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছে। গানে গানে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছিল। পরে আমি ওর জীবন ও আমার জীবনকে সামনে রেখে একটি গান লিখেছিলাম, সেটিও সে গেয়েছিল।’

‘গানটি ছিল এরকম— “আমি চির শিশু, চির কিশোর, গান গেয়ে রাত করি ভোর। জরা নাই মরা নাই, জীবনের গান গাই, আমি যে সবার দুঃখ চোর।’

‘পরে কিশোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে পাশ করল। তার গানে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তাকে ঢাকা যাওয়ার পরামর্শ দিত। ঢাকা না গিয়ে রাজশাহীতেই থাকলে তাকে তো আর সারা দেশের মানুষ আজ এভাবে চিনত না। পড়াশোনার সময় তাকে তার পরিবার থেকে ঢাকা যেতে দেয়নি।’

‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেড়িয়ে এক কাণ্ড করেছিল এন্ড্রু কিশোর,’ উল্লেখ করে রুহুল আমিন প্রামাণিক বললেন, ‘তখন সময়টা ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলের শেষের দিকে। তৎকালীন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আন্দোলন চলছিল। ছাত্ররা অনশন করছিল। সে সময় আমি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর) রাজশাহী জেলা কমিটির সভাপতি ছিলাম। আমি সেখানে ছাত্রদের অনশন ভাঙানোর জন্য যেতে চাইছিলাম। তখন আমাদের সহকর্মী অ্যাডভোকেট অসিত সেন বললেন— “আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন, ছাত্রদের জন্য গ্লুকোজ নিয়ে যান। চলেন এন্ড্রু কিশোরের দোকান থেকে গ্লুকোজ কিনে আনি”। আমি এ কথা শুনেই অবাক। বলে কী! এন্ড্রু কিশোর কোথায় দোকান দিয়েছে? কিসের দোকান?’

‘শুনলাম, শহরের মনিচত্বরে জেলা পরিষদের মার্কেটে এন্ড্রু কিশোর একটি দোকান দিয়েছে। আমি সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি সত্যি সে মনোহারী দোকান খুলে বসে আছে। প্রসাধনী সামগ্রীর পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যও ছিল। সেদিন ওর দোকান থেকে আমি ছয় প্যাকেট গ্লুকোজ কিনেছিলাম। তাকে বললাম, “তুমি এখানে কী করো?” সে বলল, “কিছু তো করতে হবে, তাই এই দোকান দিয়েছি”। বললাম, “তুমি এই দোকান আজই বন্ধ করো”। সে বলে, “দোকান বন্ধ করে করব কি?” বললাম, “তুমি ঢাকায় যাও।” সে বলল, “ঢাকায় গিয়ে কী করব?” বললাম, “ঢাকায় গিয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকবা। তোমার দোকান করা যাবে না।” তখন এন্ড্রু কিশোরের বাল্যবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন ছবি ঢাকায় থাকে। আমি কিশোরকে বললাম, “তুমি ছবির কাছে যাও, গিয়ে তার সঙ্গে দরকার হলে তার ঘরের মেঝেতে থাক, আর গান গাওয়ার চেষ্টা করো। যাও, তাড়াতাড়ি চলে যাও।” এভাবে উদ্বুদ্ধ করার পর কিশোর আমার কথা রেখেছিল।’

‘সে ঢাকায় গিয়ে ছবির বাসাতেই উঠেছিল। ঢাকায় সংগীত পরিচালকদের নজর কাড়তে তার এক বছরও লাগেনি। তারপরের কথা তো সবাই জানে। কিশোর জাতীয় ঐশ্বর্যে পরিণত হয়েছে।’

‘কিশোর এতো বড় হয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে কখনো কোনো অহংকার বোধ ছিল না। রাস্তায় পরিচিত কাউকে অগ্রাহ্য করে কখনো চলে যায়নি। এটা আজকালকার দিনে একটা বিরল ঘটনা।’

‘আমি কিশোরকে তার শৈশব থেকেই দেখেছি। দেখেছি তার কণ্ঠস্বরটাই প্রতিনিধিত্বমূলক। যখন গান গাইছে, উপস্থিত সবারই প্রতিনিধিত্ব করছে সে। তার গান সবারই হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আমার কাছে মনে হয়েছিল তার মতো একজন শিল্পীর জাতীয় পরিমণ্ডলে পরিচিতির প্রয়োজন আছে। সেজন্যই আমি তাকে ঢাকা যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম।’

‘অনেকে তাকে ভারতের কিশোর কুমারের সঙ্গে তুলনা করত। কিন্তু, এন্ড্রু কিশোরের আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। কিশোর কুমারের গলায় যেমন হাসি-খুশির বা ব্যাঙ্গাত্মক গান শোভা পেত, আমাদের এন্ড্রু কিশোরের গলায় সেটা হয়নি। তার কণ্ঠে দুঃখের, বেদনার, গভীর জীবনবোধের গানগুলোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার এসব গানে সাধারণ মানুষ জটিল জীবনরহস্যের সহজ সমাধান পেয়েছে।’

আরও পড়ুন:

মৃত্যুর একদিন আগে এন্ড্রু কিশোর বলেছিলেন, ‘আমার জন্য কফিন বানাতে দিয়ে দাও’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago