ইউরোপে বাংলাদেশিদের নিরাপদ দেশ ইতালি এখন কঠিনতম

‘কোভিড-১৯ পরীক্ষার ভুয়া সনদ বাণিজ্য’কে কেন্দ্র করে ইতালির প্রথমসারির গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ইতালিতে যাওয়া ৩৬ জন বাংলাদেশির কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। যাদের সবার কাছে কোভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ ছিল।
Sobhan Sikder-1.jpg
ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. আবদুস সোবহান সিকদার। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

‘কোভিড-১৯ পরীক্ষার ভুয়া সনদ বাণিজ্য’কে কেন্দ্র করে ইতালির প্রথমসারির গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ইতালিতে যাওয়া ৩৬ জন বাংলাদেশির কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। যাদের সবার কাছে কোভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ ছিল।

ইতালির বিমানবন্দরের পরীক্ষায় পজিটিভ আসার পর তারা স্বীকার করেন, ঢাকা থেকে তারা সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ, ১০ বা আরও বেশি পরিমাণ টাকা দিয়ে করোনা নেগেটিভ সনদ সংগ্রহ করেছেন। কাতার এয়ার ওয়েজের আরেকটি ফ্লাইটে থাকা ১২৫ বা ১৫১ জন বাংলাদেশিকে রোম বিমানবন্দর থেকে আবার ফেরত পাঠানো হয়েছে।

সেই সময় ঢাকার গণমাধ্যম সরগরম রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে নিয়ে। অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম গণমাধ্যমকে জানান, রিজেন্ট হাসপাতাল কমপক্ষে ছয় হাজার নমুনা কোনো পরীক্ষা ছাড়াই ‘নেগেটিভ’ লিখে সনদ বিক্রি করেছে। কয়েকদিন আগে পরীক্ষা না করে কমপক্ষে ১৫ হাজার কোভিড-১৯ সনদ বিক্রির দায়ে অভিযুক্ত জেকেজিও নতুন করে আলোচনায় আসে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অনেকে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ এসেছে।

ইতালির গণমাধ্যম ঢাকার গণমাধ্যমের সংবাদের সঙ্গে প্রবাসীদের কাছে পাওয়া ভুয়া সনদ মিলিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে।

ইতালি প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েন। ভেনিসের একটি পর্যটন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও ঢাকার পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পলাশ রহমান টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরেই বাংলাদেশ থেকে “করোনাভাইরাস আমদানি” নিয়ে ইতালির গণমাধ্যমে আলোচনা চলছিল। গত ৫ জুলাই থেকে এটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। কর্মঠ হওয়ায় বাংলাদেশিদের সুনাম ছিল। এখন স্থানীয়রা আমাদের সুনজরে দেখছেন না। গত মার্চে চীনের নাগরিকরা ইতালিতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল। চীন থেকে ভাইরাসটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ায় এমন ঘটনা ঘটেছিল। এখন অনেক বাংলাদেশিদের সঙ্গে সেরকমটা ঘটছে।’

ইতালিয়ান গণমাধ্যমে বাংলাদেশ বিষয়ক সংবাদে আমাদের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? হোয়াটস অ্যাপে প্রশ্ন করেছিলাম ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. আবদুস সোবহান সিকদারকে। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘এটা তো ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার বিষয় না। এক সপ্তাহ আগে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইটও এসেছিল। অনুমতি না থাকায় সেই ফ্লাইটের যাত্রীরাও চলে গেছে। এখানকার মিডিয়া ঢাকার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে লিখছে।’

বাংলাদেশিরা ঢাকা থেকে ভুয়া সনদ নিয়ে গেছে। ঢাকায় ভুয়া স্বাস্থ্য সনদের ব্যবসা চলছে। ইতালির প্রথমসারির পত্রিকায় এমন সংবাদ দেখছি। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না?

‘আপনারা লক্ষ্য করেছেন, এখানকার মিডিয়ায় ভুয়া সনদের কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে যে ফ্লাইটগুলো আসছে, সেগুলো স্পেশাল ফ্লাইট। এসব ফ্লাইটের যাত্রীদের এমন কোনো শর্ত দেওয়া ছিল না যে তাদের সনদ দেখাতে হবে। তারা যদি সনদ দেখাত, তাহলে এই সনদ ভুয়া না আসল সে হিসাব দরকার হতো। ৬ জুলাই যে ফ্লাইটটি এসেছে তার সব যাত্রীকে এখানকার বিমানবন্দরে পরীক্ষা করা হয়েছে। এই যাত্রীদের কাছ থেকে কোনো সনদ নেয়নি। সুতরাং এই ভুয়া সনদের বিষয়টি ভুলভাবে প্রচারিত হয়েছে’, বলছিলেন রাষ্ট্রদূত সোবহান সিকদার।

‘ভুলভাবে প্রচারিত’ সংবাদ বিষয়ে পত্রিকাগুলোর সঙ্গে আপনারা কথা বলেছেন কি না?

‘হ্যাঁ, আমরা কথা বলেছি। ইল মেসেজেরো (দ্য মেসেঞ্জার) পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছি।’

মৌখিকভাবে কথা বলেছেন, না ‘ভুলভাবে প্রচারিত’ সংবাদের লিখিত প্রতিবাদ করেছেন?

‘আমরা টেলিফোনে কথা বলেছি। লিখিত প্রতিবাদ করিনি।’

লিখিত প্রতিবাদ করবেন কি না?

‘তারা আমাদের বলেছেন, ঢাকার গণমাধ্যম থেকে তারা ভুয়া সনদ বাণিজ্যের সংবাদ পেয়েছেন। আর ঢাকার গণমাধ্যমে যেহেতু এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সেহেতু আমাদের জন্যে লিখিত প্রতিবাদ করা টেকনিক্যালি সমস্যা আছে।’

ইতালি প্রথমে এক সপ্তাহের জন্যে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে নিষেধাজ্ঞা দিলো। যখন কথা বলছি তখনই জানছি নিষেধাজ্ঞা ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আপনি কি জেনেছেন বিষয়টি?

‘আমি শুনেছি, এখনো লিখিত কিছু পাইনি। যদিও ইতালির সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানের নিয়মিত কোনো ফ্লাইট নেই।’

ইতালিতে বাংলাদেশিদের সংখ্যা কত? করোনা সংকটে তাদের অনেকেই ভালো নেই বলে জানছি। আপনার কাছে কী তথ্য আছে?

সোবহান সিকদার বলছিলেন, ‘দাপ্তরিক হিসাব অনুযায়ী ১ লাখ ৪৫ হাজার। যাদের বৈধ কাগজপত্র আছে। এর সঙ্গে অননুমোদিত ২০ থেকে ২৫ হাজারের মতো হতে পারে। সব মিলিয়ে প্রায় ২ লাখ। তারা ভালো আছেন।’

কিন্তু, আমরা জানতে পারছি যে অনেকেই খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছেন। তাদের নানা রকমের সহায়তা দরকার। এমন কিছু কি আপনারা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছেন?

‘ইতালি সরকার সকল আয়ের মানুষের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। অধিকাংশ বাংলাদেশিও ইতালি সরকার ঘোষিত প্যাকেজের আওতায় আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন। এর বাইরে যারা অননুমোদিত বাংলাদেশি রয়েছেন, তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার সহায়তা পাঠিয়েছে।’

কত টাকা পেয়েছিলেন আপনারা এবং কতজনকে দিতে পেরেছিলেন?

‘সেটা আমরা দিয়েছি তাদের, যারা ইতালি সরকারের সহায়তার আওতায় নেই। অর্থাৎ, অননুমোদিত প্রবাসী। আমরা কিছু অর্থ পেয়েছিলাম, যা এই অননুমোদিত প্রবাসীদের মধ্যে বিতরণ করেছি। আমরা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৫ লাখ টাকা পেয়েছিলাম। সেটা বিতরণ করেছি ৬১০ জনের মধ্যে। কাউকে আমরা টাকা দেইনি। ফুড ভাউচার দিয়েছি। তখন লকডাউন ছিল। অনলাইনে প্রবাসীদের কাছ থেকে আবেদন নিয়ে দোকান নির্বাচন করে দিয়েছি। সেসব দোকান থেকে তারা খাদ্যদ্রব্য নিয়ে গেছেন।’

সহযোগিতা পাওয়া এই প্রবাসীদের তালিকাটি কি আপনাদের ওয়েবসাইট বা অনলাইনে আছে?

‘তালিকাটি অনলাইনে নেই, দূতাবাসে সংরক্ষিত আছে। যারা সাহায্য পেয়েছেন, তাদের পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে এটা প্রকাশ করা হয়নি। তবে, কেউ যাচাই করতে চাইলে দূতাবাসের মাধ্যমে যাচাই করতে পারবেন।’

একদিকে ইতালির গণমাধ্যমে বাংলাদেশ বিষয়ক নেতিবাচক সংবাদ, অন্যদিকে বাংলাদেশিদের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলার অভিযোগ। প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশির কতজন ইতালিতে আর কতজন বাংলাদেশে আছেন, সঠিক সংখ্যা কারও কাছে নেই। যারা ইতালির বাইরে আছেন, ৫ অক্টোবর পর্যন্ত তারা যেতে পারছেন না। তাদের কাজ থাকা নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। কাগজ-পত্রহীনদের বৈধতার সুযোগ দিতে যাচ্ছিল ইতালি সরকার। বাংলাদেশিদের জন্যে সেই সুযোগ কতটা কার্যকর থাকবে, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। করোনাকালে যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তারা সংকটে আছেন। বাংলাদেশ সরকারের সামান্য সহায়তা পেয়েছেন অতি নগণ্য সংখ্যক ইতালি প্রবাসী। বৈধদেরও অনেকেই ইতালিয়ান সরকারের সহায়তা পাননি বলে জানা গেছে। সবকিছু মিলিয়ে ইউরোপে বাংলাদেশিদের অন্যতম আশ্রয়ের দেশ ইতালি ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রদূত সোবহান সিকদার কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই বললেন, ‘এখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা যদি কঠোরভাবে ইতালিয়ান সরকারের নির্দেশনা মেনে না চলেন, তবে সামনে নানাবিধ সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago