থমকে যাওয়া সময় সরিয়ে রোমাঞ্চে ভরা এক টেস্ট

চার মাসের স্থবিরতা কাটিয়ে ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট দিয়েই ফিরেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। দর্শকশূন্য মাঠ আর জৈব সুরক্ষিত পরিবেশে অনেকগুলো পরিবর্তন নিয়ে শুরু হওয়া ক্রিকেট ছিল রোমাঞ্চে ভরা। দুই দলের সমান তালে লড়াই চলেছে পুরো ম্যাচে। শেষ দিনের শেষ সেশনে গিয়ে ইংল্যান্ডকে ৪ উইকেটে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। থমকে যাওয়া সময়কে তাড়িয়ে এমন টানটান উত্তাপ বোধহয় ক্রিকেটেরও বড় বিজ্ঞাপন হয়ে থাকল।
নেতৃত্বে, পারফরম্যান্সে চোখ জুড়ানো হোল্ডার
ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন গড়পড়তা ক্রিকেটার হিসেবে। সেই জ্যাসন হোল্ডার ব্যাটে-বলের মুন্সিয়ানায় এখন বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট অলরাউন্ডার। আর অধিনায়ক হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের যেকারো চেয়ে ঢের এগিয়ে। যার ছাপ তিনি রাখেন টেস্টের একদম প্রথম ইনিংসেই।
ইংল্যান্ডকে প্রথম ইনিংসে ধসিয়ে দিয়ে ৪২ রানে নেন ৬ উইকেট। ক্যারিয়ার সেরা এই বোলিংয়ের পাশাপাশি দেখার মতো ছিল তার অধিনায়কত্ব। চার পেসার এক স্পিনার নিয়ে নেমেছিলেন। তাদের ব্যবহার করেছেন দারুণভাবে।
প্রথম ইনিংসের সময় আকাশ ছিল মেঘে ভরা। কন্ডিশনের সুবিধা নিতে স্পিনারের হাতে আর বলই দেননি। নিজেসহ বাকি তিন পেসারকে ব্যাবহার করেছে বুদ্ধিদীপ্তভাবে।
শুরুতেই শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের কাঁপানো স্পেল অনেকটাই এগিয়ে দেন ক্যারিবিয়ানদের। পরে ছোট ছোট স্যুয়িং আদায় করে তিনি নিজে নাকাল করেছেন ইংলিশদের। প্রথম ইনিংসে ফিল্ডিংয়ে তিনটি রিভিউ নিয়েও সাফল্য পেয়েছেন তিনি। গভীর মনোযোগ রাখা আর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ায় হোল্ডার শুরুতেই বেন স্টোকসকে হারিয়ে দেন।
আগ্রাসী গ্যব্রিয়েল, নিখুঁত গ্যাব্রিয়েল
প্রথম ইনিংসে ৬২ রানে ৪ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৫ রানে ৫ উইকেট। ম্যাচ সেরাও শ্যানন গ্যাব্রিয়েলই। সহায়ক কন্ডিশনে বল হাতে পেয়ে শুরুতেই ইংল্যান্ডকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার আনা মঞ্চেই হোল্ডার নেচেছেন। দ্বিতীয় ইনিংসে তো তিনিই রাজা। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্রেক থ্রো এনে জয়ের পথ করে দিয়েছেন তিনিই। ঘন্টায় ৯০ মাইলে বল করেছেন, তবে গতি রাখতে গিয়ে তাল হারাননি, ছিল নিখুঁত লাইন-লেন্থ। চোটের কারণে শুরুতে স্কোয়াডে না থাকা গ্যাব্রিয়েলের বোলিং ছিল দৃষ্টিসুখকর।
ভঙুর ইংলিশ মিডল অর্ডার
নিয়মিত অধিনায়ক জো রুট ছিলেন না। ইংল্যান্ডের মিডল অর্ডারও যেন ছিল এতিমের মতো। প্রথম ইনিংসে টপ অর্ডারের শুরুর ধাক্কা সামলাতে পারত মিডল অর্ডার। কিন্তু মিডল অর্ডার থেকে আসেনি কোন প্রতিরোধের গল্প।
চোখে পড়ার মতো ছিল কিপার ব্যাটসম্যান জস বাটলারের পারফরম্যান্স। উইকেটের পেছনে সুযোগ হাতছাড়া করেছেন। সবচেয়ে হতাশাজনক ছিল তার ব্যাটিং। প্রথম ইনিংসে ৩৫ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৯। গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে ব্যাটিংয়ে থাকলেও বাজে শটে ডুবিয়েছেন দলকে। ১১ টেস্টে ২১.৩৮ গড় বাটলারের দলে জায়গাও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আরও বেশি প্রশ্নের মুখে জো ডেনলির জায়গা। ১৮ ও ২৯। তিন নম্বরে নেমে দুই ইনিংসে এই হলো তার দশা। ক্রাউলি দ্বিতীয় ইনিংসে রান পাওয়ায় পরের টেস্টে রুট ফিরলে কোপটা তাই সহ্য করতে হতে পারে ডেনলিকেই।
আগের অনেক কিছুই নেই কিন্তু রোমাঞ্চেরও ঘাটতি থাকল না
করোনা মহামারির পর প্রথম কোন ক্রিকেট ম্যাচ। খেলোয়াড়, ম্যাচ অফিসিয়াল, সংশ্লিষ্ট সবাইকে বারেবারে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানো, জৈব সুরক্ষিত পরিবেশ বানানো আর দর্শকশূন্য মাঠের ব্যবস্থা। সাউদাম্পটন টেস্টে নতুন ছিল অনেক কিছুই। বোলাররা বল চকচকে করতে লালা ব্যবহার করতে পারেননি। এই প্রথম লালা ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে হলো একটি টেস্ট ম্যাচ।
এসব কিছুর প্রভাব অবশ্য টের পাওয়া গেছে কমই। টেলিভিশনে এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি দেখা টেস্টে দর্শকরা উপভোগ করেছেন সেরা ক্রিকেট প্রদর্শনী। স্পোর্টিং উইকেটে যেমনটা হয় শুরুতে সুবিধা পেয়েছেন পেসাররা। টিকতে পারলে ব্যাটসম্যানদের জন্যও ছিল অনেক কিছু।
কন্ডিশন সহায়ক থাকায় মিলেছে মুভমেন্ট। লালা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বেন স্টোকসকে দেখা গেছে রিভার্স স্যুয়িং পেতে। ক্রিকেটাররা লালা ব্যবহার না করলেও ঘাম ব্যবহার করেই যে সারছেন কাজ। ব্যাটে-বলের লড়াই তাই হয়েছে জম্পেশ। শেষ দিনের শেষ সেশন পর্যন্ত ম্যাচ ছিল দোলাচলে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেতার রেশ যে ব্যাপকভাবে ক্রিকেট বিশ্বে লেগেছে, ম্যাচের পরো সোশ্যাল মিডিয়া দেয় সে স্বাক্ষ্য।
নিরপেক্ষ আম্পায়ার না থাকা এবং রিভিউ নাটক
করোনার কারণেই নিরপেক্ষ ম্যাচ অফিসিয়ালের ব্যবস্থা করা যায়নি। মাঠের দুই আম্পায়ার, টিভি আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি, রিজার্ভ আম্পায়ার সবাই ছিলেন ইংল্যান্ডের।
মাঠের দুই আম্পায়ার রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ ও রিচার্ড ক্যাটেলবোরো প্রথম ইনিংসেই চরম বিব্রতকর এক অবস্থায় পড়লেন। একবার নয় তিন তিনবার তাদের দেওয়া নট আউটের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সাফল্য পেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
আম্পায়ার নিরপেক্ষ না থাকায় এই টেস্টে বাড়তি একটি করে রিভিউ রাখা হয়েছিল। পুরো টেস্টে পাঁচটি সফল রিভিউ বলছে নিয়মটা ক্যারিবিয়ানদের কাজে লেগেছে বেশ।
ব্রড ছিলেন, ব্রড ছিলেন না
গত ৮ বছরেও এমনটা হয়নি। হলো এবার। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড টেস্ট খেলছে অথচ একাদশে নেই স্টুয়ার্ট ব্রড। ঘরের মাঠে টানা ৫১ টেস্ট পর তাকে বাদ রেখে একাদশ বানিয়েছিল ইংল্যান্ড। ব্রডের বদলে মার্ক উডকে রাখার জন্য হয়ত এখন আফোসই হচ্ছে ইংল্যান্ড কোচের। একাদশে জায়গা না পেয়ে গণমাধ্যমেও হতাশা লুকাননি ব্রড।
তবে ব্রড না থাকলেও ছিলেন যে সিনিয়র ব্রড। হ্যাঁ এই টেস্টের ম্যাচ রেফারি ছিলেন স্টুয়ার্ড ব্রডেরই বাবা ক্রিস ব্রড। স্টুয়ার্ট ব্রড একাদশে থাকলে একটা অন্যরকম ইতিহাসই হয়ে যেত। কোন টেস্টে বাবা ম্যাচ রেফারি আর ছেলে খেলছেন, এমনটা যে দেখা যায়নি আর।
উদযাপনে ভিন্নতা
উইকেট, সেঞ্চুরি, ফিফটি, জয়ের পর উদযাপনের যে স্বাভাবিক ছবি। করোনার কারণে তা বদলে যাবে। এমনটা জানাই ছিল। সাউদাম্পটন টেস্টেও দেখা গেল তা। উইকেট পাওয়ার পর হাইফাইভের বদলে ফিস্ট বাম্প করলেন ইংলিশ ক্রিকেটাররা। ম্যাচ শেষে দুদলের সৌজন্য বিনিময়েও তা। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা যেন এক্ষেত্রে নিজেদের রাখলেন একটু উদার। ফিস্ট বাম্প তারাও করেছেন। তবে আবেগে সতীর্থকে জড়িয়ে ধরা বাদ যায়নি। অনেক সময়েই হাই-ফাইভও করেছেন।
তবে এক্ষেত্রে তাদের যুক্তিও থাকতে পারে। বারবার কোভিড-১৯ পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের করোনামুক্ত নিশ্চিত করেই তো খেলছেন। দুজন করোনামুক্ত মানুষ সংস্পর্শে এলে ঝুঁকি কোথায়?
বল করতে আসা বোলারদের সোয়েটার, ক্যাপ এবার আম্পায়ারের কাছে রাখার নিষেধাজ্ঞা ছিল। বোলারদের নিজেদের এসব জিনিস তাই সতীর্থ কারো কাছেই রাখতে হয়েছে। মাঠের সবাই কোভিড-১৯ নেগেটিভ থাকার পরও এই নিয়ম কতটা সুরক্ষার আর কতটা বিড়ম্বনা সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। মাইকেল হোল্ডিং যেমন কোভিড মুক্ত নিশ্চিত হবার পরও কেন লালা ব্যবহার করা যাবে না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন।
স্পন্সরওয়ালাদের দখল বাড়ল
আগে কখনই টেস্ট ম্যাচের জার্সির বুকটা দখল করতে পারেনি কোন বিজ্ঞাপনওয়ালা। টেস্টে দলগুলোর টিম স্পন্সরের লোগো থাকত কেবল বাহুতে। সাউদাম্পটন টেস্টে দেখা গেল ভিন্ন ছবি। ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন বাজারের স্থবিরতা কাটাতে ছাড় দিল আইসিসি। স্পন্সরের লোগো ধবধবে সাদা জার্সিতে বড় করে বুকের মাঝখানে দেখা গেল দুই দলের। করোনার কারণে অনেক বাস্তবতা বদলের মধ্যে এটাও হয়ত এখন আরেকটি নিয়মিত দৃশ্য হতে চলেছে।
Comments