কোস্টারিকা: ল্যাটিন আমেরিকার এক সুখি দেশের সন্ধানে
![Costarica Costarica](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/costarica.jpg?itok=ehm2wkxV×tamp=1594811757)
মনে আছে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের কথা? ব্রাজিলে আয়োজিত সে বছর বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বে সবচেয়ে দুর্ভেদ্য গ্রুপ হিসেবে ধরা হচ্ছিল গ্রুপ ডি-কে।
সাবেক তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি, উরুগুয়ে ও ইংল্যান্ডকে নিয়ে গড়া এ গ্রুপে কোস্টারিকার নাম থাকায় বেশির ভাগ মানুষের চোখে সেবারের বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে এ কোস্টারিকা ছিল সবচেয়ে দুর্ভাগা দেশের নাম।
কিন্তু, কোস্টারিকাই দাপটের সঙ্গে উরুগুয়ে ও ইতালির মতো ফুটবল পরাশক্তিধর দেশকে পরাজিত করে গ্রুপের পর্বের বাধা তো বটে এমনকি কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখবে সেটি বোধ হয় কোস্টারিকার সমর্থকদের দূরতম কল্পনাতেও আসেনি কখনও।
এমনকি, গোলশূন্য কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচেও সে আসরের অন্যতম ফেভারিট লুই ফন গালের নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর তাদেরকে পরাজয় বরণ করতে হয় টাইব্রেকারে এসে।
কোচ হোর্হে লুইস পিন্টোর তত্ত্বাবধায়নে সেবারের ফুটবল বিশ্বকাপে কোস্টারিকার হয়ে নজর কেড়েছিলেন কেইলর নাভাস, ব্রায়ান রুইজ, হোয়েল ক্যাম্পবেল, হুনিয়র দিয়াজসহ আরও অনেক ফুটবলার।
সেবারের টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক হিসেবে জার্মানির ম্যানুয়েল নোয়ার ও আর্জেন্টিনার সার্জিও রোমেরোর পাশপাশি বারবার কেইলর নাভাসের নাম উচ্চারিত হয়েছিল।
ছয় বছর পর আজকের দিনেও কেইলর নাভাসের নাম উচ্চারিত হয় বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক হিসেবে। স্প্যানিশ ক্লাব লেভান্তে ও রিয়েল মাদ্রিদে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স শেষে ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেইনে এসেও তিনি আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন।
আজকে তাই আমার আলোচনা কেইলর নাভাস, ব্রায়ান রুইজ, হোয়েল ক্যাম্পবেল, হুনিয়র দিয়াজদের জন্মভূমি কোস্টারিকাকে ঘিরে।
কোস্টারিকা মধ্য আমেরিকায় থাকা ১৯ হাজার ৭৩০ বর্গমাইলের ছোট দেশ। আয়তনে পৃথিবীর ১২০ তম স্থানে থাকা এ দেশটির পূর্বে ক্যারিবিয়ান সাগর, পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, উত্তরে নিকারাগুয়া এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে পানামা।
আয়তনে কোস্টারিকা মিশিগান হ্রদের থেকেও ক্ষুদ্র। মধ্য কোস্টারিকাতে অবস্থিত সান হোসে দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী এবং যাবতীয় প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। ল্যাটিন আমেরিকা অঞ্চলের একটি গুৰুত্বপূৰ্ণ শহর সান হোসে ও একই সঙ্গে একটি জনপ্রিয় ট্রান্সপোর্ট হাব।
১৮২১ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। এক সময় কোস্টারিকা স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে কিছুকাল দেশটি মেক্সিকো সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবেও থেকেছে।
১৮৬৯ সালে দেশটিতে প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পথে পা বাড়ায়। কোস্টারিকার বর্তমান সংবিধানটি প্রণীত হয় ১৯৪৮ সালের গৃহযুদ্ধের পর।
সাংবিধানিকভাবে কোস্টারিকার প্রায় শতকরা পঁচিশ শতাংশের মতো জায়গা সংরক্ষিত। সেখানে কোনো গাছ কাটা কিংবা প্রাণীদের ক্ষতি করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। পৃথিবীতে এতো বিশাল পরিমাণ জায়গার সংরক্ষণ খুব কম দেশেই আছে।
দেশটির বেশিরভাগ ক্যাথলিক চার্চগুলোর সামনের অংশ পশ্চিম দিক করে নির্মিত। অনেকে জেনে অবাক হবেন যে কোস্টারিকায় গলি কিংবা রাস্তার কোনো নাম কিংবা নম্বর থাকে না। কোনো ঠিকানা খুঁজে পেতে হলে নিকটবর্তী কোনো বিশেষ নির্মাণ বা জায়গা সম্পর্কে জানতে হবে।
‘সোদা’ এখানকার ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ যা দেশটির সর্বত্রই দেখা যায়।
কোস্টারিকার সরকারি ভাষা স্প্যানিশ। ২০১৮ সালে প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী দেশটির মোট জনসংখ্যা ৫০ লাখের কিছু বেশি।
কোস্টারিকার অধিবাসীরা কোস্টারিকান নামে পরিচিত, তবে অনেক সময় তাদেরকে তিকো (Tico) নামেও ডাকা হয়। সাধারণত দেশটিতে ছেলেদেরকে তিকো (Tico) ও মেয়েদেকে তিকা (Tica) বলা হয়। তিকো শব্দটির সঙ্গে একটি গাড়ির মডেলের নাম যুক্ত। দক্ষিণ কোরিয়ার মোটর গাড়ির নির্মাণ কোম্পানি দাইয়েউ (Daewoo) এর তৈরি একটি গাড়ির মডেলের নাম ছিলো দাইয়েউ তিকো (Daewoo Tico)।
মেস্তিজো (Mestizo) কোস্টারিকার সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। দেশের অধিকাংশ মানুষ খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী। দেশটির বেশিরভাগ মানুষই স্প্যানিশ ও আদিবাসী আমেরিকানদের মিশ্র বংশধর।
১৯৪৯ সালের সংবিধান অনুযায়ী রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টানিটি কোস্টারিকার রাষ্ট্রধর্ম হলেও দেশটির প্রায় সব ধর্মের মানুষ সমান স্বাধীনতা ভোগ করেন।
কোস্টারিকান কোলন হচ্ছে দেশটির জাতীয় মুদ্রার নাম। কোলন নামটি রাখা হয়েছে বিখ্যাত ইতালিয়ান পরিব্রাজক ক্রিস্তোফার কলম্বাসের নামের ওপর ভিত্তি করে।
কোস্টারিকাতে ঋতু নির্ধারণ করা হয় বছরে কোন সময় কতোটুকু বৃষ্টিপাত হলো এর ওপর ভিত্তি করে। শুষ্ককালকে এখানে গ্রীষ্মকাল ও বর্ষাকালকে স্থানীয়ভাবে শীতকাল হিসেবে ধরা হয়।
দেশটির অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। ইলেকট্রনিক পণ্যসহ বিভিন্ন ধরণের উৎপাদনশীল কারখানা এ দেশে রয়েছে। ইন্টেল, আইবিএম, এইচপির মতো বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানিগুলোর কারখানাও কোস্টারিকাতে রয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে ভালো অবস্থানে থাকায় দেশটির শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান সহজলভ্য ও উন্নতমানের। দেশটির শতকরা প্রায় ৯৭ জন অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে স্বর্ণের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে।
![Costarica Costarica](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/news/images/costarica_2.jpg?itok=qML7I24Z×tamp=1594811813)
ইকো ট্যুরিজমের জন্য পরিচিত কোস্টারিকা কয়েকটি ন্যাশনাল পার্ক ও পোয়াস নামক একটি কার্টার বা গর্তের জন্য সুপরিচিত। এ গর্তটি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছে।
করকোভাদো ও তর্তোগুয়েরো ন্যাশনাল পার্ক দুইটিকে যে সব বানর, ব্যাঙ, পাখি, প্রজাপতি, টিকটিকি ও কয়েকটি বিশেষ প্রজাতির প্রাণী দেখা যায় তা পৃথিবীতে বেশ বিরল। প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার জন্য জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ইউএনডিপির যে পাঁচটি নির্ণায়ক আছে একমাত্র দেশ হিসেবে কোস্টারিকা সেগুলো পূরণ করতে সমর্থ হয়েছে।
নিউ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ওয়ার্ল্ড অর্ডার ফাউন্ডেশনের করা ‘Happy Planet Index’ এর র্যাংকিং তালিকায় কোস্টারিকা প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। এই র্যাংকিং করা হয় কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ ও পরিবেশের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে।
নিরক্ষীয়রেখার খুব কাছে অবস্থিত হওয়ায় কোস্টারিকাতে সূর্য উঠা ও সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় সহজে নির্ধারণ করা যায়। বলা হয়ে থাকে যে পৃথিবীর শতকরা পাঁচ ভাগের মতো জীব বৈচিত্র্য কোস্টারিকাতেই সংরক্ষিত রয়েছে।
কোস্টারিকা শব্দটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় রিচ কোস্ট (Rich Coast), বাংলায় সমৃদ্ধ উপকূল। প্রকৃতপক্ষে ‘কোস্টা’ ও ‘রিকা’ দুইটি ভিন্ন শব্দ। সাংবিধানিকভাবে দেশটি রিপাবলিক অব কোস্টারিকা নামে পরিচিত।
কফি টেস্টার কোস্টারিকাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়। কফিশপগুলো বিভিন্ন স্বাদের কফিকে বেছে তা কেনার জন্য এ সব কফি টেস্টারদের ওপর নির্ভরশীল এবং এ কাজের জন্য তাদেরকে পাঁচ বছরের প্রশিক্ষণ নিতে হয়।
কোস্টারিকাতে মেয়েরা বিয়ের পর নিজেদের মূল নামের সঙ্গে স্বামীর নামের শেষ অংশ যুক্ত না করে বরং মায়ের নামের শেষ অংশের সঙ্গে নিজেদের নাম যুক্ত করতে ভালোবাসে।
পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দেশটির রাজধানী সান হোসেতে গাড়িচালকেরা সপ্তাহে একদিন করে শহরের রাস্তায় গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকেন। সেই একদিন কোন দিন হবে তা নির্ভর করে তাদের গাড়ির নম্বর প্লেটে থাকা শেষ নম্বরটির ওপর ভিত্তি করে।
এছাড়াও, কোস্টারিকাতে প্রচলিত কথাগুলো অর্থগতভাবে কিছুটা ভিন্নতা বহন করে। যেমন: রাস্তার স্পিড বাম্পগুলোকে এখানে মুয়ের্তো (Muerto) বা পোলিছিয়াস দরমিদোস (Policias Dormidos) নামে ডাকা হয়। এর বাংলা অর্থ হচ্ছে মৃত কিংবা ঘুমন্ত ট্রাফিক পুলিশ বাহিনী।
কোস্টারিকাতে বেড়াতে এসে আপনি যদি কোনো ট্যাক্সিচালককে নাইট ক্লাবের কথা বলেন তাহলে তিনি আপনাকে স্ট্রিট ক্লাবে নিয়ে যাবেন।
কোস্টারিকার সাধারণ মানুষ খুবই নিরীহ ও শান্তিপ্রিয়। তারা সব সময় যে কোনো সংঘাত কিংবা যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে ভালোবাসে। এ কারণে দেশটিতে খুব বেশি একটা স্ট্যান্ডিং আর্মির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। তবে দেশকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ছোটো এক ধরণের বিশেষ বাহিনী রয়েছে।
কোস্টারিকাতে পর্যটক সমাগমের আরও একটি কারণ হচ্ছে হামিং বার্ড। বলা হয়ে থাকে হামিং বার্ডের প্রায় বায়ান্নটির মতো প্রজাতি শুধু কোস্টারিকাকে দেখতে পাওয়া যায়। এ কারণে কোস্টারিকাকে হামিং বার্ডের রাজধানী নামে অভিহিত করা হয়।
সারা বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক বেড়াতে আসে বলে দেশটিতে বিভিন্ন ধরণের খাবারের সমারোহ দেখা যায়। সেটা ইতালিয়ান হোক কিংবা চাইনিজ— প্রায় সব ধরণের খাবার এখানে পাওয়া যায়।
এমনিতে বলতে গেলে চাল, বিভিন্ন ধরণের বিন ও বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি এখানকার খাবারে দেখা যায়। কাসাদো দেশটির একটি জনপ্রিয় খাবার। আর সালসা লিজানো নামক এক ধরনের সসের প্রচলন এখানকার খাবারে খুব বেশি দেখা যায়।
বলাবাহুল্য কোস্টারিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। কোস্টারিকাতে কারো নামে চিঠি কিংবা কোনো পার্সেল আসলে সেটা নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনো ডেলিভারি ম্যান আসেন না। বেশিরভাগ সময় কোস্টারিকানরা নিজে গিয়ে সেটা স্থানীয় পোস্ট অফিস থেকে নিয়ে আসেন।
ল্যাটিন আমেরিকার বেশির ভাগ দেশে যেখানে ধনী ও গরিব দুই শ্রেণির মানুষের মধ্যে প্রবল বৈষম্য দেখা যায়। কোস্টারিকাতে এ সমস্যা খুব একটা বেশি চোখে পড়ে না। এ কারণে কোস্টারিকাকে ল্যাটিন আমেরিকার সুইজারল্যান্ড হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো তো বটেই এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায়ও সামাজিক নিরাপত্তা ও সুখি-সমৃদ্ধির তালিকায় কোস্টারিকা অনেক ওপরে। যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও মানুষের সচেতনতা একটা দেশকে উন্নতর সামাজিক কাঠামো দিতে পারে কোস্টারিকা তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া
Comments