সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ‘প্রতারণা করেছিলেন’ সাহেদ

সাহেদ
মো. সাহেদ। ফাইল ছবি সংগৃহীত

‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসেছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা।’

২০১৬ সালে চট্টগ্রামের খোয়াজনগরে একটি অভিযানের তদন্তের বিষয়ে ২০১৭ সালে যখন সাহেদ চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) সদর দপ্তরে যান, তখন সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে এভাবেই নিজের পরিচয় দেন তিনি।

২০১৬ সালের ৫ নভেম্বর ডিবি পুলিশের একটি দল বন্দর নগরীর ‘মেগা মোটরসে’র একটি ডিপোতে অভিযান চালায় এবং ১৭টি অটোরিকশা জব্দ করে, যেগুলোর একাধিক চেসিস নম্বর রয়েছে। এই ঘটনায় একইসঙ্গে মেগা মোটরসের মালিক জিয়া উদ্দীন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও কর্মী শহীদুল্লাহকেও আটক করে পুলিশ।

সে সময় সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেই শুধু প্রতারণা করেননি সাহেদ, অটোরিকশাগুলো পুনরুদ্ধারে কয়েকজন জুনিয়র কর্মকর্তাকে ‘হুমকি’ও দিয়েছিলেন।

এর মধ্যে, এ বছরের ১৩ জুলাই সাহেদের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাহাঙ্গীর চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা করেন। অভিযোগে বলা হয়, বিআরটিএ থেকে ২০০টি অটোরিকশার রোড পারমিট পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ৯১ লাখ ২৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন সাহেদ।

মামলাটি দায়ের হওয়ার পরই মূলত ‘সাহেদ কীভাবে তাদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছিলেন এবং তাদের হুমকি দিয়েছিলেন’— সে বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেন সিএমপির কর্মকর্তারা।

সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, প্রভাব-ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে খোয়াজনগরে অভিযানের সময় থাকা সিএমপির চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে শৃঙ্খলা ও পেশাদার মান ইউনিটে অভিযোগ করতে সহায়তা করেছিলেন সাহেদ।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের দুই কর্মকর্তা— সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. আজমির শরীফ (বর্তমানে পিবিআইতে কর্মরত) ও এএসআই সাদেক মোহাম্মদ নাজমুল হক ইতোমধ্যে শাস্তি ভোগ করেছেন। অন্যদিকে দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা— পুলিশ পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া ও আফতাব হোসাইনের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের তদন্ত চলছে বিগত সাড়ে তিন বছর যাবৎ।

এই দুই পরিদর্শকই বর্তমানে সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম (সিটি) ইউনিটে কর্মরত।

পুলিশ সূত্র বলেছে, গ্রেপ্তারের পর নিজেদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য জাহাঙ্গীর সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

পরিদর্শক আফতাব হোসাইন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ওই অভিযানের পর আমাদেরকে বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়া হয়েছিল এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে একজন আইনজীবীর জিম্মায় আমরা ওইদিন রাতেই তাদের ছেড়ে দিয়েছিলাম।’

‘আমরা জব্দ করা ১৭টি অটোরিকশার মধ্যে ১৬টি ছেড়ে দিয়েছিলাম। শুধু চেসিস যাচাইয়ের প্রমাণস্বরূপ শুধু একটি রেখে দিয়েছিলাম। জব্দ করা অটোরিকশার চেসিস নম্বরগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আমি বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলাম’, বলেন তিনি।

২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি দেওয়া এক চিঠিতে বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক তৌহিদুল হাসান জানান, এই চেসিস নম্বরগুলোর কোনো রেকর্ড তাদের কাছে নেই এবং অটোরিকশাতে একটিই চেসিস নম্বর থাকে।

তদন্ত চলাকালীন ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিএমপির সদর দপ্তরে গিয়েছেন সাহেদ। সিএমপি কর্মকর্তাদের তিনি বলেছেন, চলমান সমস্যাটি সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে তাকে বন্দর নগরীতে পাঠানো হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সে সময় পুলিশ পরিদর্শক রাজেশ ও আফতাবকে হুমকিও দিয়েছিলেন সাহেদ। যে কারণে সাহেদের নামে অভ্যন্তরীণভাবে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন আফতাব।

পুলিশ পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া বলেন, ‘সাহেদ বলেছিলেন, আপনারা জুনিয়র কর্মকর্তা।... এত (অভিযান চালানোর) সাহস পেলেন কোথা থেকে? ছোট্ট একটি ঘটনার জন্য কেন আমাকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসতে হলো।’

‘এরপর (ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে) তিনি কতটা ঘনিষ্ঠ বা বোঝান এবং বলেন, “পুলিশের সিকিউরিটি ইউনিট আমার হাতেরমুঠোয়”’, বলেন রাজেশ।

তিনি বলেন, ‘এর কিছুদিন পরেই ঢাকায় আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। যেটি এখনো চলমান। অথচ, কিছু না করেও আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি।’

সিএমপি সূত্র জানায়, সিএমপির সদর দপ্তর থেকে যাওয়ার সময় জব্দ করা বাকি অটোরিকশাটিও নিয়ে যান সাহেদ। যে কারণে পরবর্তীতে অটোরিকশা সংশ্লিষ্ট তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়।

সূত্র বলছে, সিএমপির চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা অটোরিকশা জব্দ করে ‘মেগা মোটরসকে’ হয়রানি করছে এবং এর মালিকের কাছে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করছে।

অভিযোগের পর সিএমপির তদন্তে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে শিল্প পুলিশের অধীনে একজন অতিরিক্ত আইজিপি অভিযোগটির তদন্ত করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিএমপির সিটি ইউনিটের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) পলাশ কান্তি নাথ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সিএমপির এই কর্মকর্তারা সাহেদের প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন।’

মেগা মোটরস

মেগা মোটরস মালিক জাহাঙ্গীরের পক্ষে সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন এর কর্মী সাইফুদ্দিন। সাইফুদ্দিন বলেন, ‘সাহেদ সিএমপির কর্মকর্তাদের চাপ দিয়েছিলেন, যাতে করে আমরা তাকে বিশ্বাস করি। এমনভাবে তিনি আমাদের কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন, যাতে জোর করে তিনি আমাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতে পারেন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের সাবেক কর্মী শহীদুল্লাহ, যাকে আমরা পরবর্তীতে বরখাস্ত করি, তার সহায়তায় সাহেদ বন্দর নগরীতে এসেছিলেন।’

অর্থ আত্মসাতের মামলায় সাহেদের পাশাপাশি শহীদুল্লাহকেও অভিযুক্ত করেছে মেগা মোটরস।

‘সাহেদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের অর্থ আত্মসাৎ করা এবং রাজধানীতে ২০০টি অটোরিকশা চলাচলের জন্য রোড পারমিট পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ২০১৭ সালে আমাদের কাছ থেকে ৯১ লাখ ২৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন’, দাবি করেন সাইফুদ্দিন।

সাইফুদ্দিন স্বীকার করেছেন যে, জাহাঙ্গীর ও শহীদুল্লাহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর মেগা মোটরসের পক্ষে অনেক রাজনীতিবিদও পুলিশকে ফোন করেছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and suppress political dissent.

5h ago