প্রবাসে

ওরে নীল দরিয়া…

‘এই যে এতদিন জাহাজে করে খালি নীল পানিতে ভেসে চলেন, বিরক্ত লাগে না?’ আমরা যারা সাগরে থাকি তাদের প্রায়ই এমন প্রশ্ন শুনতে হয়।

‘এই যে এতদিন জাহাজে করে খালি নীল পানিতে ভেসে চলেন, বিরক্ত লাগে না?’ আমরা যারা সাগরে থাকি তাদের প্রায়ই এমন প্রশ্ন শুনতে হয়।

একটা সময় ছিল যখন জাহাজিরা মাঝ দরিয়ায় পুরো দুনিয়া থেকেই বিচ্ছিন্ন থাকত। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস নীল পানি দেখেই সময় কাটাত। যদিও বিনোদনের সম্ভাব্য সব জিনিসই জাহাজে থাকতো। টিভি, ভিসিআর, সিডি-ডিভিডি প্লেয়ার, টেবিল টেনিস বোর্ড, চেস, কার্ডস, জিমনেশিয়াম থেকে শুরু করে টাইম পাস করার অনেক কিছুই জাহাজে থাকে। ডিউটি আওয়ারের শেষে যে যেভাবে খুশি সময় কাটাতো। এখন প্রায় সব জাহাজেই ওয়াইফাই সুবিধা থাকায় বেশির ভাগ জাহাজি অবসর সময়ে পরিবারের সাথেই মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে সময় কাটায়। এছাড়া জাহাজিরা জয়েনিং এর আগে মুভি, নাটক, টিভি সিরিজ ভর্তি হার্ডডিস্ক নিয়ে যায় ৬/৯ মাসের বিনোদন হিসেবে। যার যার কেবিনে বসে ল্যাপটপে এসব দেখে সময় কাটায়। তাই জাহাজে এখন বিরক্ত লাগার সুযোগ নেই বললেই চলে।

কেউ কেউ জানতে চান, জাহাজে কি শুধু সামুদ্রিক মাছ ধরেই খান? অন্য মাছ বা মাংস থাকে না? আসলে জাহাজ সমুদ্রে থাকলেও আমাদের দরকার হয় না মাছ ধরার। জাহাজ পোর্ট ছাড়ার আগেই প্রয়োজনীয় খাবার কোম্পানি থেকে সাপ্লাই দেয়া হয়। জাহাজে ব্রেড-জেলি থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবারই থাকে। জাহাজে কী ধরনের খাবার থাকে বললে এর সহজ উত্তর হবে, এমন সব খাবার যা আমরা নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা সচরাচর খাই না।

অনেকের প্রশ্ন জাগে সমুদ্রে তো লবণাক্ত পানি, নরমাল পানি কোথায় পান বা পাবেন যদি শেষ হয়ে যায়? আসলে জাহাজে একটা মেশিন আছে যেটার নাম 'ফ্রেশ ওয়াটার জেনারেটর'! এটার কাজই হচ্ছে 'সি-ওয়াটার' (লবণাক্ত পানি) থেকে 'ফ্রেশ-ওয়াটার' (নরমাল পানি) তৈরি করা। ২৪ ঘণ্টায় এটি ২৫ হাজার লিটার (প্রয়োজনে আরও বেশি) পর্যন্ত নরমাল পানি বানাতে পারে।

কারও মধ্যে প্রশ্ন জাগতে পারে, সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়েন না? আসলে আধুনিক যুগে প্রযুক্তির উন্নয়নে জাহাজ আর জাহাজিদের জীবন অনেক বেশি নিরাপদ। এখন যে কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস অনেক আগে থেকেই আমরা পেয়ে থাকি। পূর্বাভাস পেয়ে সেভাবেই কোর্স পরিবর্তন করা হয়, যেন জাহাজ ঝড়ের কবলে না পড়ে। এখনো বড় কোন ঝড়ের কবলে পড়ার অভিজ্ঞতা হয়নি আমার।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, আপনার জাহাজ ইউরোপ-আমেরিকা যায় না? বিষয়টা এমন, বেশির ভাগ জাহাজের রুট ফিক্সড। সচরাচর ৬-৯ মাসে চেঞ্জ হয় না। ধরুন, গ্রিনলাইন/ হানিফ/ সোহাগ বাস কোম্পানি। ওদের শ'খানেক বাসের মধ্যে ২০ টা ঢাকা-চিটাগাং, ২০ টা ঢাকা-সিলেট, ২০ টা ঢাকা-কলকাতা ইত্যাদি রুটে চলে। এখন আপনি যদি গ্রিন লাইনের ড্রাইভার বা সুপারভাইজার হন তাহলে গ্রিনলাইন থেকে আপনাকে যে লাইনের বাসে দেবে সে লাইনেই আপনি চলবেন। ঢাকা-চিটাগাং রুটের বাসে দিলে তো আপনি সিলেটের চা বাগানে গিয়ে চেক-ইন দিতে পারবেন না। হয়তো ৬/৯ মাস পর আপনার রুট চেঞ্জ করে দিলে আপনি সিলেটে বা কলকাতায় যেতে পারবেন। তেমনি জাহাজেও জাহাজির রেডিনেস অনুযায়ী যে জাহাজে জয়েন করানো যায় সেখানে জয়েন করাবে। সে জাহাজের রুট কোরিয়া-আমেরিকাও হতে পারে আবার কানাডা-অস্ট্রেলিয়াও হতে পারে।

যেমন, আমার প্রথম জাহাজের রুট ছিল এশিয়া-আফ্রিকা-মিডল ইস্ট, পরের জাহাজ ছিল শুধু সাউথ ইস্ট এশিয়ায় অর্থাৎ সিংগাপুর-মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া। তারপরের জাহাজ এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া-আফ্রিকা সেইল করতো। আমার সর্বশেষ জাহাজের জয়েনিং ছিল নিউইয়র্ক থেকে। এটা ইউরোপ, নর্থ আর সাউথ আমেরিকাতে সেইল করে। তবে বেশির ভাগ জাহাজির ৫ বছরের আমেরিকান মাল্টিপল এন্ট্রি ট্রানজিট ভিসা আর ৩ বছরের অস্ট্রেলিয়ান 'মেরি টাইম ক্রু ভিসা'  থাকে যেন প্রয়োজন হলে আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া থেকে জাহাজে জয়েন বা সাইন অফ করতে পারে।

অনেকেই জানতে চান। জাহাজে আপনাদের কাজটা কী? আমাদের কাজের বর্ণনা দেয়ার আগে জাহাজের কাজের একটু বর্ণনা দেই।

পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে, নিরাপদে, স্বল্প সময়ে অধিক পরিমাণ পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম জাহাজ। চাল, চিনি, তেল থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, গাড়ি, মোবাইল, ল্যাপটপ, জামা-কাপড় এমন কিছু নাই যা জাহাজে আনা নেয়া করা হয় না। আমাদের দেশে ভালো কোয়ালিটির কিছু বোঝাতে সবাই 'এক্সপোর্ট কোয়ালিটি' বা 'ইমপোর্টেড' বলে থাকে। আর পৃথিবীর এই এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের প্রায় পুরোটাই হচ্ছে জাহাজ কেন্দ্রিক। বাই এয়ার খুব অল্প পরিমাণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে যা আবার অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

জাহাজের মধ্যে আবার বিভিন্ন রকমফের আছে। অর্থাৎ যে জাহাজে আপনি শখের গাড়ি আমদানি করবেন সে জাহাজে তেল আমদানি করতে পারবেন না। এভাবে গাড়ি, তেল, গ্যাস, চাল, চিনি, গার্মেন্টসের তৈরি পোশাক ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পণ্য পরিবহনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের জাহাজ আছে।

পরিশেষে, জাহাজিরা সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয় সেটা হলো, দেশে কবে এসেছেন-জাহাজে কবে যাবেন? কোন জাহাজি যদি আপনার পরিচিত থাকে তাহলে দয়া করে বারবার এটি জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করবেন না। প্রথম দেখায় কবে এসেছে, কবে যাবে বলেছে সেটা মনে রাখার চেষ্টা করুন। একজন জাহাজি পরীক্ষা বা বিভিন্ন কোর্সের জন্য ৬/৯ মাস বা এক বছরেরও অধিক সময় দেশে থাকতে পারে।

একটা বিষয় জেনে রাখবেন। বাংলাদেশি জাহাজিদের প্রাণের সংগীত হলো সারেং বউ সিনেমার "ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া..." এ গানের প্রতিটি লাইন জাহাজিরা মন থেকে অনুধাবন করেন।

জাহাজিরা জাহাজ থেকে সাইন অফ বা বাড়ি আসার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে মনে করে, যা জাহাজি সমাজে "ঈদ-উল সাইন অফ" নামে পরিচিত। যার যার সাইন অফের দিন তার তার ঈদের দিন।

(লেখক: এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি (৪৭ তম ব্যাচ), সিঙ্গাপুর থেকে)

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago