সাসেক্সে এক টুকরো বাংলাদেশ

২০১৫ সালে যুক্তরাজ্য সরকারের শিভেনিং স্কলারশিপের জন্য যখন আবেদন করি, তখন সাসেক্স ছিল আমার দ্বিতীয় পছন্দ। এখন ভালো লাগে যে ভাগ্যিস, প্রথম পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সুযোগ হয়নি। সাসেক্স এ গিয়ে অসাধারণ ক্যাম্পাস আর উন্নয়ন অধ্যয়নে এর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা দেখেই বুঝেছিলাম বছরটা হবে স্মরণীয়। এরপর সাসেক্স আমার জীবনে শুধু স্মরণীয় হয়নি, অনন্য অবিচ্ছেদ্য এক অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে।
২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্স করার সময়ই ফটোগ্রাফিতে আগ্রহী হই। এরপর বাংলাদেশে বেশ কিছু পত্রিকায় আমার তোলা ছবি ও গল্প ছাপা হয়েছিলো। সাসেক্সে গিয়ে সমুদ্র, শহর, পাহাড় আর মানুষের এক অবিশ্বাস্য সমন্বয় দেখে ছবি তুলে সেগুলোর গল্প লেখা শুরু করলাম। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সাসেক্সের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এ যখন আমার একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী হলো এবং সংগৃহীত অর্থ ব্রাইটন শহরের দুটো চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানকে দিলাম, তখনই সাসেক্স আর আমার সম্পর্ক হলো অবিচ্ছেদ্য। এরপর লাইব্রেরি নিয়ে চলচ্চিত্র বানানোসহ আমার আরও কয়েকটি উদ্যোগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমার নামে ‘মনি কর্নার’ স্থাপন করা হলো– সেটি ছিলো আমার জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় এবং অনুপ্রেরণার একটি মুহূর্ত। বাংলাদেশের পতাকা শোভিত ওই কর্নারে যতবার তাকিয়েছি, ভেবেছি সাসেক্স এ আমার দেশকে আরও কীভাবে প্রতিনিধিত্ব করা যায়। সেই ভাবনা নিয়েই সাসেক্স থেকে মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরেছি।
দেশে ফিরে তিন বছর বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে চাকুরি করার সময় পিএইচডি করার প্রয়োজন অনুভব করলাম। মনে প্রশ্ন জাগছিলো– কী নিয়ে গবেষণা করবো, কোথায় করবো? অবশ্যই এমন কিছু নিয়ে গবেষণা করতে হবে, যা থেকে লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজে লাগানো যাবে। সে চিন্তা থেকেই পিএইচডি করার জন্য উন্নয়ন অধ্যয়নের তীর্থস্থান আমার ভাললাগার সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়েকেই বেছে নিলাম। অফার লেটার হাতে পেয়েই প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপের জন্য আবেদন করার পর স্কলারশিপটা পেয়েও গেলাম। বর্তমান সরকারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা যে, আমাকে এ ফেলোশিপের মাধ্যমে সাসেক্সে এ গিয়ে পুনরায় দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিয়েছে।
এবার সাসেক্সে যাবার পরই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম যে ভিন্ন কিছু করবো। সেটার সুযোগও হলো। ২০১৮ সালে বাংলাদেশি আর এক পিএইচডি গবেষক আমিনুল ইসলামের উদ্যোগে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছিলো বাংলাদেশ স্টুডেন্টস সোসাইটি। গত বছর নভেম্বরে যখন এ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব নিলাম তখন আমার সাথে ছিলো অসাধারণ উদ্যমী ও দেশপ্রেমিক কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। তাদের সকলের সহযোগিতায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই আমরা বাংলাদেশের বিজয় দিবস পালন করলাম। এ অনুষ্ঠানে শত শত বিদেশি শিক্ষার্থীদের সাথে আমরা একসাথে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছি। এরপর এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও পালন করেছি সফলতার সাথে। বাংলাদেশকে সাসেক্স এ এভাবে উদযাপিত করার অংশ হয়ে যে আনন্দ ও গর্ববোধ করেছি তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।
এ বছরই আমি সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পেয়েছি। সেটাও আমাকে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। করোনাভাইরাস সংকট শেষে আবারও সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা কোনো মিলনমেলায় মিলিত হতে পারবো – সেটাই এখন প্রত্যাশা।
সবশেষে বলবো, বাংলাদেশি যারা যুক্তরাজ্যে গিয়ে শিক্ষা অর্জন করতে চান, তাদের জন্য সাসেক্স অনেকগুলো কারণেই প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত। উন্নয়ন অধ্যয়নসহ অন্যান্য অনেক ডিসিপ্লিনে সাসেক্স এখন পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এর ক্যাম্পাস, পরিবেশ এবং বৈচিত্র্য। এছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পার্ট-টাইম চাকুরি করেই থাকা-খাওয়ার খরচের অনেকটাই বহন করা সম্ভব।
আমি বর্তমানে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এম্বেসেডর হিসেবে কাজ করছি। আমার পিএইচডি গবেষণা চলবে আরও তিন বছর। এ সময়টাতে আমার কাজ, আলোকচিত্র এবং গবেষণার মাধ্যমে আমার দেশ বাংলাদেশকে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও সমুন্নতভাবে স্থাপন করতে পারবো – সেটাই আমার দৃঢ় প্রত্যয়।
(লেখক: বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) ক্যাডারের একজন সদস্য। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ফেলো হিসেবে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন। সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টুডেন্টস সোসাইটির প্রেসিডেন্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর।)
Comments