অপরাধের সাম্রাজ্য গড়তে মিডিয়াকে ব্যবহার করেছেন সাহেদ

রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ তার অপরাধের সাম্রাজ্য গড়তে রাজনীতিবিদ, আমলা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সখ্যতা বাড়াতে ব্যবহার করেছেন ‘মিডিয়ার শক্তি’।

রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ তার অপরাধের সাম্রাজ্য গড়তে রাজনীতিবিদ, আমলা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সখ্যতা বাড়াতে ব্যবহার করেছেন ‘মিডিয়ার শক্তি’।

তিনি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে অসংখ্য টকশোতে অংশ নিয়েছেন এবং ২০১৫ সালের ১১ মার্চ থেকে ‘দৈনিক নতুন কাগজ’ নামে একটি সংবাদপত্রও বের করছেন। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঢেকে রাখতে মিডিয়ার এই পরিচয় তিনি ব্যবহার করতেন বলে জানিয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এডিশনাল ডেপুটি কমিশনার বদরুজ্জামান জিল্লু ২১ জুলাই দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা সাহেদের পিছনে এখনও কোনো গডফাদার বা রাজনৈতিক নেতা পাইনি। সাহেদ তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিভিন্ন টকশোতে অংশ নিয়ে এবং খবরের কাগজের মালিক হয়ে সেই পরিচয় ব্যবহার করেছেন।’

তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাহেদ নিয়মিত সচিবালয়ে যাওয়া-আসা করতেন। সংবাদপত্র দেখিয়ে তিনি একটি প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডও সংগ্রহ করেছিলেন। বিশেষ নিরাপত্তা পাসের ব্যবস্থা করে তিনি বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছেন।

উত্তরা ও গুলশান এলাকার তালিকাভুক্ত অপরাধীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন সাহেদ। এরপর তাদের চাকরি দেন তার সংবাদপত্রে। ভবিষ্যতে নামীদামী সাংবাদিকদের নিয়োগের মাধ্যমে পত্রিকাটির ভালো ইমেজ তৈরির পরিকল্পনা ছিল তার।

তারা জানান, ১৬ জুলাই থেকে শুরু হয় কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফলে জালিয়াতি, করোনা রোগীদের পরীক্ষা ও চিকিত্সার জন্য টাকা নেওয়া এবং সরকারের সঙ্গে চুক্তি লঙ্ঘন করার মামলায় সাহেদের ১০ দিনের রিমান্ড। এসময় ডিবি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদকালে এসব তথ্য দেন সাহেদ

ডিবি হেফাজতে পাঁচ দিন রিমান্ডে রাখার পর তাকে র‌্যাব হেফাজতে স্থানান্তর করা হয়।

গতকাল সাহেদের নামে থাকা চারটি জালিয়াতি মামলায় মোট ২৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা উত্তরা পশ্চিম ও উত্তরা পূর্ব থানার মামলাগুলোর প্রতিটির জন্য সাত দিন করে রিমান্ড দেওয়া হয়েছে।

চারটি পৃথক মামলায় ৪০ দিনের রিমান্ড আবেদনের প্রেক্ষিতে সাহেদকে আদালতে হাজির করার পর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী এই আদেশ দেন।

এছাড়া উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা তিনটি মামলায় রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজকে ২১ দিনের রিমান্ডে রাখা হয়েছে।

২৩ জুলাই ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সাহেদ তার অপরাধ ঢাকতে মিডিয়া ব্যবহার করেছিলেন বলে তিনি মনে করেন না।

কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, ‘বরং, তিনি সমাজে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং প্রশাসনে কর্মরতদের ব্যবহার করেছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা ও ওয়ারেন্ট ছিল। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

তিনি আরও জানান, একটি সংবাদপত্রের জন্য অনুমোদন পেতে গোয়েন্দা ছাড়পত্র প্রয়োজন। প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘মামলা থাকার পরও তার নামে পত্রিকার ছাড়পত্র কিভাবে দেওয়া হলো?’

অভিযোগের পাহাড়

১৫ জুলাই সাহেদকে সাতক্ষীরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকেই ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, চাকরিপ্রার্থী, চিকিৎসক ও আইনজীবীসহ অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং সাহেদের নামে অভিযোগ দায়ের করছেন।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একজন দাবি করেছেন যে মাত্র সাত দিন রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখায় তার মাকে ভর্তি রাখার পর তাকে বিল পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

তিনি বলেন, ‘আমার মাকে ২ জুন ভোর ৪টার দিকে কোভিড-১৯ এর লক্ষণসহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির একদিন পর থেকেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় যে তাকে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) রাখতে হবে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আরও জানান, আইসিইউ থেকে দুদিন পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার মাকে আবার জেনারেল ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করে। ৮ জুন তারা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে চাইলে কর্তৃপক্ষ তাদের আড়াই লাখ টাকার বিল দেয়।

অপর এক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, তিনি পায়ে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে মাত্র একদিন ছিলেন। এতেই তার বিল এসেছিল ৫০ হাজার টাকা।

সিলেটের এই বাসিন্দা বলেন, ‘আমি আইসিইউতে থাকিনি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে যে তারা আমাকে আইসিইউতে রেখেছিল।’

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, তারা বেশিরভাগ ভুক্তভোগীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছেন যে হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় থাকার পরও তাদের আইসিইউ শয্যার বিল পরিশোধ করতে হয়েছে।

কেউ যদি বিল পরিশোধ করতে অস্বীকার করতেন তাহলে হাসপাতালের কর্মীরা এবং কিছু ক্ষেত্রে সাহেদ নিজেই তাদের জীবননাশের হুমকি দিতেন বলে জানিয়েছেন ডিবির এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।

২০ জুলাই তিনি বলেন, ‘আমরা সাহেদের ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র পেয়েছি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আমাদের জানিয়েছিলেন যে তার সঙ্গে দেহরক্ষী থাকলেও তিনি মানুষকে ভয় দেখাতে সঙ্গে বন্দুক রাখতেন।’

১৮ জুলাই রাতে এক অভিযানের সময় ডিবি পুলিশ তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পাঁচ বোতল বিদেশি মদ এবং ১০ বোতল ফেনসিডিলও উদ্ধার করে।

ডিবি উত্তরা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার কাজী শফিকুল আলম জানান, গত সপ্তাহে অস্ত্র ও মদ উদ্ধারের পৃথক দুটি মামলা হয়েছে সাহেদের নামে।

তিনি আরও জানান, প্রতিদিন তারা শাহেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এবং তার প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য পাচ্ছেন।

ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দেওয়া এবং করোনা রোগীদের কাছ থেকে পরীক্ষা ও চিকিৎসার খরচ নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া সাপেক্ষে গত ৭ জুলাই শাহেদ এবং রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের ১৬ জন কর্মচারীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে র‌্যাব।

র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ গত বৃহস্পতিবার জানান যে তারা এই জালিয়াতি মামলায় এখন পর্যন্ত ১৭ আসামীর মধ্যে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে।

তিনি বলেন, ‘সাহেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সাতক্ষীরায় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার এবং জালিয়াতির মামলা দুটি তদন্তের ভার আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি। সাহেদ এখন আমাদের হেফাজতে রয়েছে। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে মোট ৪৮টি মামলা চিহ্নিত করেছে র‌্যাব।’

গত ১৭ জুলাই সাহেদের প্রতারণার শিকার যারা হয়েছেন তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য র‌্যাব একটি তদন্ত সেল গঠন করে।

লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘আমরা ২২ জুলাই তদন্ত সেলটির ফোন নম্বর বন্ধ করে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত আমরা ১৩৯ জনের কাছ থেকে কল পেয়েছি। যারা সাহেদের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছেন।’

তিনি জানান, এখনও তাদের কাছে ইমেইলের মাধ্যমে অভিযোগ জমা দেওয়া যাবে। গত ২৩ জুলাই পর্যন্ত ইমেইলের মাধ্যমে ২১ জনের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছে র‌্যাব।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে এমনও অভিযোগ এসেছে যে তিনি কারাগারে থাকা বিভিন্ন কয়েদিদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন তাদের মুক্ত করার আশ্বাস দিয়ে।’

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago