ঈশ্বর, বিদ্যাসাগরের আড়ালে দয়ার সাগর

পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্ম সাদামাটা হলেও তারা নতুন সভ্যতা, নতুন অধ্যায়ের সূচনায় চিহিৃত হন! তেমনি বাংলা ও বাঙালির মাঝে ঈশ্বরচন্দ্রের আবির্ভাব সমগ্র পিছিয়াপড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক মুক্তি ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের পথনির্দেশ দিয়েছেন।
তার পারিবারিক নাম— ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বিস্তর জ্ঞান ও অগাধ পাণ্ডিতের মুকুট ‘বিদ্যাসাগর’ হিসেবেই তিনি পরিচিত কাল থেকে কালান্তর। ঈশ্বরের অসামান্য বদান্যতা, উদারতার জন্য বিদ্যাসাগরের আড়ালে খ্যাতি পান ‘দয়ার সাগরে’।
বাংলা ভাষার যথার্থ শিল্পী ছিলেন তিনি। যতিচিহ্নের ব্যবহার করে তিনিই ভাষাকে প্রথম সুশৃঙ্খল রূপ দেন। ফলে বাংলা গদ্যের জনকও বলা হয় তাকে।
জানা যায়, সুখি একান্নবর্তী হিন্দু পরিবারের আচার-আচরণের আদর্শস্থল ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের অনুপ্রেরণা। তার পিতা ও পিতামহের দৃঢ়তা, ন্যায়পরায়ণতা, আত্মনির্ভরতা বংশপরম্পরায় অর্জিত হয়েছিল। আর মাতৃ-মাতুলালয়ের আচারাসিদ্ধ দয়া-দাক্ষিণ্য, পরদুঃখকাতরতা ‘দয়ার সাগরে’ পরিণত করছিল তাকে। উভয়দিক থেকে বিচিত্রভাবে মানস ও চরিত্র গঠনে ভূমিকা রেখেছিল।
পাঁচ বছর বয়সে পাঠশালায় যাওয়া শুরু। প্রথমে শিক্ষক হিসেবে পান বীরসিংহে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে। কালিকান্ত অত্যন্ত আন্তরিকতায়, স্নেহে অল্প সময়ে অধিক বিষয় জানাতে পারতেন। ঈশ্বরচন্দ্রও বিদ্যাভ্যাসে গুরুর প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠেন।
তিন বছরে পাঠশালা শেষ করায় গুরু তাকে ইংরেজি শিক্ষা নিতে তার বাবাকে বলেন: ‘আপনার পুত্র অদ্বিতীয় বুদ্ধিমান। শ্রুতিধর বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পাঠশালায় যা শিক্ষার তা শিক্ষা হইয়াছে। এইখান হইতে কলিকাতা লইয়া যাওয়া আবশ্যক হইয়াছে।’
তার মেধার আরও প্রমাণ মিলে কলকাতায় যেতে মাইলস্টোনের সংখ্যা দেখে দেখে ইংরেজি শিখে নিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। সংস্কৃতি কলেজের পাঠ শেষে মাত্র ষোল বছর বয়সেই অধ্যাপনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। ধাপে ধাপে প্রধান আচার্যের পদে আসীন হন। তার পরের গল্প অনেকের জানা।
খ.
উনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অনন্যসাধারণ চরিত্র— মৌলিক সৃষ্টিকর্মে বাঙালির গৌরব। নানা গুণের সম্মিলন ঘটায় তিনি জীবনের প্রতি পদক্ষেপে রেখে গেছেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাধারণ জীবনযাপন করলেও অসাধারণ কীর্তিতে সর্বজন নন্দিত। কারণ তিনি স্বজাতির পশ্চাৎপদতা নিয়ে ভাবতেন সবসময়। দেশ মাতৃকার জন্য জননীর মতো দরদ যেমন ছিল তেমনি ছিল আত্মসম্মানবোধ।
বর্তমানে আমিত্ববোধ আর আত্মসম্মানবোধের আকালে প্রাসঙ্গিক তার একটি গল্প: ১৮৪৭ সময়কার ঘটনা, বিদ্যাসাগর সংস্কৃতি কলেজে, ব্রিটিশ জেমস কার হিন্দু কলেজের (বর্তমান প্রেসিডেন্সি কলেজ) অধ্যক্ষ। বিদ্যাসাগর একদিন কোনো এক প্রয়োজনে গেছেন কার সাহেবের দপ্তরে। যাবার পর সামনে থাকা চেয়ারে কার সাহেব বিদ্যাসাগরকে বসতে বললেন না। বরং তিনি চেয়ারে বসে ছিলেন টেবিলের ওপরে জুতোসহ দুই পা তুলে। একবারের জন্যও পা গুটালেন না। কাজ শেষ করে বিদ্যাসাগর ফিরে এলেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর কার সাহেব কী একটা কাজে এলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। পেয়ে যান সুযোগ। বিদ্যাসাগরও তালতলার চটি জোড়াসহ টেবিলের ওপর পা তুলে কথা বললেন। এই ব্যবহারে কার অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে নালিশ করলেন সরকারের শিক্ষা পরিষদের সচিব ময়েট সাহেবের কাছে। ময়েট বিদ্যাসাগরের কাছে কৈফিয়ত চাইলেন।
বিদ্যাসাগরও ইংরেজিতে জবাব দিলেন, যার বাংলা এমন: ‘ভেবেছিলাম, আমরা অসভ্য, সাহেবেরা সভ্য, সাহেবদের কাছেই আমাদের সভ্যতা শেখা উচিত। কার সাহেবের কক্ষেও আমি গিয়েছিলাম, তিনি আমাকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, আমি ভেবেছিলাম সেটাই অভ্যর্থনা জানানোর রীতি, কাজেই তিনি যখন আমার কক্ষে এলেন, ঠিক একইভাবে আমি তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছি।’
এমনি সাহসী ছিলেন বিদ্যাসাগর। সাধারণ মিষ্টভাষী, ব্যবহারে অত্যন্ত সৌজন্যপূর্ণ কিন্তু তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের অসৌজন্যসূচক আচরণ বরদাস্ত করতে পারতেন না। নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকায় বিদেশি প্রভুর মনোরঞ্জন করতে আগ্রহী ছিলেন না। কথা-কাজে পৌরুষত্বেও পরিচয় মিলতো সব সময়। এ রকম দৃষ্টান্ত পাই ১৮৯৮ সালে জন্ম নেওয়া আবুল মনসুর আহমদের মানসে। বয়সে বড়দের অসম্মান করে ‘তুই’ বলার উচিৎ শিক্ষা দিয়েছিলেন ময়মনসিংহের ধানীখোলা গ্রামে নায়েবদের।
প্রাসঙ্গিক আর একটি ঘটনা: একবার এক ডাক্তার বাবু রেলওয়ে স্টেশনে নামলেন। নেমে ‘কুলি’ ‘কুলি’ বলে ডাকছেন। ডাক শুনে এগিয়ে এলেন একজন সাহায্য করতে। বিদ্যাসাগরের পরনে ধুতি, গায়ে মোটা চাদর। পায়ে সাধারণ চটি। কুলি এসেছে ভেবে ডাক্তার তার হাতে ব্যাগ তুলে দিলেন। লোকটাও ব্যাগটা নিয়ে স্টেশনের বাইরে দাঁড়ানো বাবুর পাল্কিতে পৌঁছে দিলেন। ডাক্তার পয়সা দিতে চাইলে লোকটা বললেন, ‘না না, পয়সা দিতে হবে না, আপনি এতো ছোট ব্যাগ নিয়ে এত বড় বিপদে পড়েছিলেন দেখে আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছি।’
পয়সা দিতে হবে না, তুমি কেমন কুলি হে?
আমি ঠিক কুলি নই।
তাহলে কে? আমি ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। লোকে অবশ্য বিদ্যাসাগর বলেও ডাকে। জেনে অনেকটা লজ্জা পান ডাক্তার। পায়ে পড়ে বলেন, ‘এরপর থেকে আমি নিজের কাজ নিজেই করব।’
বিদ্যাসাগর এমনিভাবে মানুষকে শিখিয়েছেন চলন-বলন। নিজেও আমিত্ববোধে সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। সাহেবদের যুগে সাদাসিধে পোশাকে গায়ে মোটা চাদর ও চটিজুতা ছিল তার একমাত্র পরিচ্ছদ। বৈচিত্রময় কাজ ও ভাবনায় বাঙালির চিন্তার অচলায়তন ভেঙ্গে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে কাজ করে গেছেন। আলো হয়ে পথ দেখান আরেক শিক্ষিত কিন্তু চিন্তায় সংকুচিত ও দৈন্য বাঙালিকে। যা আজকের সমাজের জন্যও প্রাসঙ্গিক চিন্তা ও কীর্তি অর্জনে।
গ.
সমাজে চলমান কোনো রীতিনীতি পরিবর্তন করতে হলে খুব সাহস ও প্রায়ঙ্গিক চিন্তা থাকা দরকার। সেই বিদ্রোহী চেতনায় ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম কীর্তি বিধবা বিবাহ চালুকরণ। রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রদ করে যে সংস্কারের সূচনা করেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র এর পরিসমাপ্তির দায়ভার নিজের কাঁধেই নিয়েছিলেন।
সতীদাহ রোধে জীবন বাঁচলেও মনে আর মানে বাঁচা দায় হয়ে উঠেছিল বিধবাদের। সে ক্ষেত্রে, ঈশ্বরচন্দ্র বিধবা বিবাহ প্রথার পক্ষে প্রচারণা চালানোয় সেই বিধবাদের চোখের জল মোচনেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে বহু বিবাহ রোধ, বাল্যবিবাহের প্রতিরোধেও শামিল হয়েছিলেন। এসবের সুফল-কুফল জানিয়েছেন ভাষণে ও বই লিখে। সমাজের এক দল মানুষ তাকে হত্যার চিন্তা করলেও তিনি নিরুৎসাহিত হননি।
নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে মেয়েদের স্বনির্ভর করা ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু হয় তার হাত ধরে।
পরম এক সুহৃদকে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবা বিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।’ তবুও বিধবা বিবাহ নিয়ে তিনি শুধু আন্দোলন করে থেমে থাকেননি, নিজের সন্তান নারায়ণকে দিয়ে বিধবা কন্যাকে বিয়ে করিয়ে দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছিলেন।
নিজে কাজ করে বা লিখেই থেমে থাকেননি। নানাভাবে সমাজ সংস্করের চেষ্টা করে গেছেন। মাইকেল মধুসূদনের মতো বাঙালির প্রথম বিদ্রোহী শিল্পীসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একজন বিদ্যাসাগরের মহানুভবতা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ফরাসি দেশে চরম অর্থকষ্টে ভোগা মাইকেল তার দুর্দিনে একজন ঈশ্বরচন্দ্রকে সম্বোধন করেছিলেন এভাবে, ‘যার জ্ঞান আর প্রতিভা প্রাচীন ঋষির মতো, উদ্যম একজন ইংরেজের মতো, আর হৃদয়টা একজন বাঙালি মায়ের।’
এমন বিষয়ে সেকালে সবাই জানতো বিদ্যাসাগরের পরদুঃখে কাতরতার কথা। কবি নবীনচন্দ্র সেনও যৌবনে বিদ্যাসাগরের অর্থে লেখাপড়া করেছিলেন। এর মধ্যে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে অনেক সময় কেউ কেউ মিথ্যা বলেও সাহায্য নিত। একবার এ ব্যাপারে একজন ধরা পড়ে যায়। বিদ্যাসাগরের সহকারী তাকে বলেন যে, ‘আপনাকে ভালো মানুষ পেয়ে অনেকেই এভাবে ঠকায়।’ উত্তরে বিদ্যাসাগরের বলেন, ‘পরের সাহায্য করতে গেলে মধ্যে মধ্যে ঠকতে হয়। ঠকানোর চেয়ে ঠকা ভালো।’
আহা! সাগরসম হৃদয়! বাংলা ও বাঙালির সমাজের জন্য খুব দরকার। আরও দরকার দেশপ্রেম ও অসম্প্রদায়িক চেতনা। যেমনটা বিদ্যার আড়ালের দয়ার সাগরের ছিলেন। জানা যায় তিনি কখনো জাত বিবেচনা বা হিন্দু-মুসলিম ‘ছোঁয়াছুঁয়ি’ এসব মানতেন না।
দুর্ভিক্ষে বীরসিংহ খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। আবার সংবাদ আসে মেয়েদের মাথায় তেল না থাকায় খুবই অসুবিধা হচ্ছে। তাৎক্ষণিক তিনি তেল বরাদ্দ করেছেন। কিন্তু যারা দিচ্ছেন, তারা ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়ে হাত উঁচু করে তেল দিচ্ছেন। এটা দেখে বিদ্যাসাগর এগিয়ে এসে নিজেই ওদের মাথায় তেল মাখিয়ে দিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: ‘মা যেন মেয়েদের মাথায় তেল মাখিয়ে দিচ্ছেন।’
শুধু তাই নয়, বর্ধমানে মুসলিম পাড়ায় যখন কলেরা মহামারির রূপ নেয়, তিনি হোমিওপ্যাথি ওষুধ নিয়ে সেখানে ছুটে যেতেন, নিজের কোলে বসিয়ে রোগীকে ওষুধ খাওয়ান ও সেবা করেন। ধর্ম-অধর্ম বিচার করেননি।
তিনি কেবল মানুষের দুঃখে কাঁদতেন না, কাজও করতেন। সর্বোপরি ঈশ্বরচন্দ্র শিক্ষায় নয়, দীক্ষায় নয়, দয়া নয়, বিদ্যায় নয় তিঁনি বেঁচে থাকবেন সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজের আমিত্ববোধের ভাবনায়। অক্ষয় মনুষ্যত্বে তার আসন চিরকাল।
(লেখাটি তৈরিতে ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতি’ সম্পাদক বিশ্বনাথ দে, কলকাতা ও ছোটদের বিদ্যাসাগর আনিসুল হকের বই দুটির সহায়তা নিয়েছি। কৃতজ্ঞতা।)
ইমরান মাহফুজ : কবি ও গবেষক। [email protected]
Comments