প্রবাসে

করোনাকালে হঠাৎ কলিং বেল!

শুরুর দিকটায় খুব হতাশ ছিলাম, যখন যুক্তরাজ্য সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন বলছিল করোনা উপসর্গ দেখা দিলে বাসায় আইসোলেশনে থাকতে হবে যতক্ষণ না শ্বাসকষ্ট অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। কী ভয়ংকর?
ছবি: মাহমুদুল হক মনি

শুরুর দিকটায় খুব হতাশ ছিলাম, যখন যুক্তরাজ্য সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন বলছিল করোনা উপসর্গ দেখা দিলে বাসায় আইসোলেশনে থাকতে হবে যতক্ষণ না শ্বাসকষ্ট অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। কী ভয়ংকর?

নিজেকে কভিড আক্রান্ত মনে হলে ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসে যোগাযোগ করা যাবে না, হসপিটাল বা জেনারেল ফিজিশিয়ানের সাথে দেখা করা যাবে না, এমনকি ফার্মেসিতেও না যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছিল। হতাশা বেড়ে গেল যখন আশেপাশের কোনো ফার্মেসিতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, গ্লাভস খুঁজে পেলাম না। মনে হতো এসময় দেশে থাকলে ভালো হতো, যে কোনো প্রয়োজনে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া যেতো, পরামর্শ নেয়া যেতো, বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনের সহায়তা পাওয়া যেতো। অসম্ভব অস্থিরতায় সময় কাটছিল। আমার এক প্রিয় ব্যাচমেটের ভাই অনেক আগে থেকে পরিবার নিয়ে এ এলাকায় থাকেন। এখানে আসার পর যোগাযোগ হয়। ভাই-ভাবী দুজনেই অত্যন্ত বন্ধুবৎসল। উনাদের সাথে মাঝে মাঝে কথা হতো, হতাশা প্রকাশ করতাম। তারা অভয় দেয়ার চেষ্টা করতেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ দেয়ার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ চিন্তা করছিল। তবে, সময় নিচ্ছিল। যুক্তরাজ্য সরকার প্রথমদিকে হার্ড ইমিউনিটির দিকে হাঁটছিল। তবে, গবেষকদের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত তা থেকে সরে আসে। সরকার থেকে সিগন্যাল পেয়ে বাচ্চাদের স্কুল ও আমার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। লকডাউনের পূর্ব পর্যন্ত যেহেতু নিয়মিত ক্যাম্পাসে যেতাম, তাই লকডাউন শুরু হওয়ার প্রথম দিকে বাসায় প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করেছি। বিশেষত আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে কভিড উৎপত্তির দেশটির শিক্ষার্থী বেশি থাকায় ভয় একটু বেশিই ছিল!

যাকগে, যুক্তরাজ্য সরকার কর্তৃক হার্ড ইমিউনিটি থেকে লকডাউনের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে দেরি হওয়ায় দেশটির জনসাধারণ প্রস্তুতি গ্রহণের সময় পায়। তবে প্রথম থেকেই পণ্যসামগ্রী ক্রয় ও মজুতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছিল, তথাপি কিছুদিনের মধ্যে টিস্যু পেপার ফুরিয়ে গেল, অল্প কোথাও যাও পাওয়া যাচ্ছিল তা দু-তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছিল। লকডাউনের দুসপ্তাহের মধ্যে বাসায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনার প্রয়োজনীয়তা পড়লো। শুরুর দিকে গ্রোসারি ক্রয়ে সম্ভাব্য সব কোম্পানির অনলাইন সাবস্ক্রাইব করি, তবে স্লট পাওয়া যাচ্ছিল না। বস্তুত, লকডাউনের শুরুর দিকে অনলাইনে গ্রোসারি ক্রয়ে স্লট পেতে অসম্ভব বেগ পেতে হয়েছে, এমনকি কখনও কখনও সারাদিন লেগেছে। অনলাইনে কেনাকাটা করার অভ্যাসটা অনেক আগে থেকেই ছিল। তবে, লকডাউনের কারণে তা নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

লকডাউনের অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমার বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন কার্যক্রমে চলে যায়। তবে, ওই সময়টায় পড়াশোনা চালিয়ে নেয়া খুব দুরূহ ছিল। মন বসতো না, গবেষণার পরিবর্তে সারাদিন পেপার-পত্রিকা পড়ে সময় কাটতো। অস্থিরতা কাটাতে দেশে পরিবারের সদস্য ও বন্ধ বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ এবং একটু-আধটু লেখালেখিতে সময় ব্যয় করতাম।

যুক্তরাজ্যে কভিড লকডাউনে যে কয়েকটি বিষয় বিস্ময়কর লেগেছে, তার অন্যতম ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি ইমেইল প্রাপ্তি- যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত, সার্বিক পরিস্থিতির চিত্র এবং পড়াশোনা ও স্বাস্থ্যগত পরামর্শ থাকতো। বিষয়টি খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক ছিল।

আমি জানি না, করোনাকালে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের এ ধরনের যোগাযোগ ছিল কী না?  তাছাড়া, ১০ নং ডাউনিং স্টিট থেকে যুক্তরাজ্যের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কর্তৃক প্রেরিত পত্রপ্রাপ্তির বিষয়টিও বিস্ময়কর লেগেছে। পত্রে প্রধানমন্ত্রী যে কয়েকটি বিষয়ে অবতারণা করেছিলেন তার অন্যতম ছিল- বাসায় থাকার পরামর্শ, ফ্রন্ট লাইন স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশংসা, দুর্যোগকালে জনগণের সাথে তার একাত্মতার অঙ্গীকার। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে, করোনা আক্রান্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিজে সর্বশেষ পরিস্থিতি বিষয়ে সপ্তাহে একাধিক বার সরাসরি দেশবাসীকে জানাতেন।

বাচ্চাদের স্কুলিং কার্যক্রম দ্রুততর সময়ের মধ্যে অনলানে চলে আসার বিষয়টিও আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। কী করে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা বাচ্চাদের অনলাইন উপযোগী কারিকুলাম ঠিক করলো? কীভাবে শিক্ষকেরা তার সঙ্গে খাপ খাওয়ালো? কিভাবে প্রয়োজনীয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপ করলো? সারাদিন বাসায় থেকে মাঝে মাঝে অস্থিন লাগলেও অনলাইনে স্কুল কার্যক্রম চালু থাকায় তা বাচ্চাদেরকে কিছুটা প্রফুল্ল রেখেছে, সর্বোপরি লার্নিং গ্রোথ ধরে রেখেছে। এসময়টায় বাচ্চাদের স্বাস্থ্য সচেতনা বেড়েছে- তারা এখন নিয়মিত শরীর চর্চা করে। বলে রাখা ভালো, সরকারি নির্দেশনায় কঠোর লকডাউনের সময়ও দিনে একবার জগিং করার নিমিত্তে বাইরে যাবার সুযোগ রাখা হয়। নিয়মিত শরীর চর্চার বিষয়টি উন্নতদেশের নীতিনির্ধারক ও মানুষের কাছে যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে এ উদাহরণটি যথেষ্ট।

এ পর্যায়ে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি (এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী) মধ্যকার আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্কের একটি পরিচয় দেয়া যেতে পারে। লকডাউনের প্রাথমিক শিথিলতা শুরুর দিকে ঈদ-উল-ফিতরের দিনে, হঠাৎ কে যেন বাসায় কলিং বেল চাপে। রাজ্যের বিস্ময়ে দরজা খুলে দেখি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ফেলো বাংলাদেশি প্রিয় মুখ। বাচ্চাদের জন্য চকলেট নিয়ে হাজির। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বাসার বাইরে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করি।

আশা করি সব কিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হবে, বিদেশে বসে মা, মাটি ও মাতৃভূমি নিয়ে সব উদ্বেগ কাটবে- এ আশায় বুক বাঁধি।

ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ।

(লেখক: বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, যুক্তরাজ্য)

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago