প্রবাসে

‘হোম অফিস’ এর অধিকার পেতে যাচ্ছে কর্মীরা?

জার্মানিতে করোনাক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ২৭ জানুয়ারি। মাসখানেকের মধ্যেই ভাইরাসটি কেবল জার্মানি নয়, মহামারির রূপ নেয় বিশ্বজুড়ে। যুগটাই যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্দি, সেখানে মানুষ বাধ্য হয়েছে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে। কোভিড-১৯ এর কারণে রাতারাতি বিবর্তিত হয়ে গেছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচার। পাল্টে গেছে বেঁচে থাকার লড়াই, পাল্টেছে কর্মপদ্ধতি।
করোনাকালে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ছবি: বিপ্লব শাহরিয়ার

জার্মানিতে করোনাক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ২৭ জানুয়ারি। মাসখানেকের মধ্যেই ভাইরাসটি কেবল জার্মানি নয়, মহামারির রূপ নেয় বিশ্বজুড়ে। যুগটাই যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্দি, সেখানে মানুষ বাধ্য হয়েছে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে। কোভিড-১৯ এর কারণে রাতারাতি বিবর্তিত হয়ে গেছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচার। পাল্টে গেছে বেঁচে থাকার লড়াই, পাল্টেছে কর্মপদ্ধতি।

যদি করোনাকালের আগের কথা ধরি, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় জার্মানিতে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' কিংবা ঘরে বসে কাজ করার প্রবণতা ছিল খুবই কম। কারণ জাতি হিসেবে জার্মানরা ঘরে বসে থাকাটা সমর্থন করতে পারে না বললেই চলে। কিন্তু সত্যি বলতে, করোনা সঙ্কট বদলে দিয়েছে সব হিসেব। এই সঙ্কট এখন ভাবতে বাধ্য করছে, একটা মহামারি কি সত্যিই মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সংস্কৃতিতে মোটা দাগে বিবর্তন আনতে পারে?

ফিরে যাই জানুয়ারির গোড়ার দিকে। তখন 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'-এর অর্থ অনেকটা 'উপরি লাভ'-এর মতো ছিল। সাপ্তাহিক অবকাশ শুরুর আগমুহূর্তে স্রেফ ই-মেইলগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে দেখা। এরপর ঘরের দিকে মনোযোগ, পরিবারকে নিয়ে সময় কাটানো। কিন্তু এই মহামারির কাল ভাগ্যবানদের জন্য আদর্শ হয়ে দেখা দিয়েছে। নিজের ঘরে বসে আরামে কাজ করে যাও। বাড়তি কোনো চাপ নেই। গেল তিন চার মাসের এই আরামের দৈনন্দিন রুটিন অবশ্য এখন গোল বেঁধেছে মননে, মানসিকতায়। লকডাউনের বিধিনিষেধ যখন ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে যখন ব্যস্ততা ফিরতে শুরু করেছে, তখনই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে এই পরিবর্তন। ঘরে থেকে কাজ করা অনেকেই কর্মজীবনের স্থায়ী এবং অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন।

নাটকীয় পরিবর্তন

ডুইস বুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার্ক, স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং-এর গবেষণা বলছে, করোনা সঙ্কটের আগে জার্মানিতে নিয়মিত কর্মসংস্থানের মাত্র আট শতাংশ মানুষ বাড়ি থেকে কাজ করত। যাদের ফোকাস ছিল কেবল পরিবার ঘিরে। ক্যারিয়ার নিয়ে এই মানুষগুলো খুব একটা ভাবতে চায় না। ডুইসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. আঞ্জা গার্লমায়ার একে বলছেন 'উপস্থিতি সংস্কৃতি' বা Presence Culture। করোনা কালে জার্মানিতে ঘরে বসে কাজ করা মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশে। মজার বিষয় হলো, ঘরে থেকে কাজ করা যে সম্ভব এবং তাতে যে কর্ম উৎপাদন ক্ষমতায় খুব একটা হেরফের হয় না- সেটি মোটামুটিভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে। কাজেই ঘরে থেকে কাজ করতে না দেয়ার পেছনে নিয়োগ কর্তাদের যেসব যুক্তি ছিল, তার অনেকগুলোই এখন আর ন্যায়সঙ্গত মনে নাও হতে পারে। এমনকি জার্মান ফেডারেল কর্মসংস্থান মন্ত্রী হুবার্টুস হাইলও ঘর থেকে কাজ করাকে একজন কর্মীর আইনি অধিকার হিসেবেই দেখছেন। এ সংক্রান্ত নতুন একটি আইন প্রণয়নের কাজও শুরু করে দিয়েছেন তিনি। ঘরে থেকে কাজ করতে চান বা কাজ করতে সক্ষম এমন যে কাউকে সেই অধিকার দিতে যাচ্ছে আইনটি। এটি পাস হলে একজন কর্মী ‘হোম অফিস’ এর অধিকার করোনা-উত্তরকালেও পেতে পারেন।

ওয়ার্ক ফ্রম হোম: কম নাকি বেশি উৎপাদনশীলতা?

ঘরে থেকে কাজ করার এই যে নাটকীয় সংখ্যাবৃদ্ধি, এটি কিন্তু সহকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা এবং কর্ম-উদ্দীপণায় বিশাল তেজিভাব তৈরি করেছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান মেন্টিমিটার (Mentimeter)। ইন্টারেক্টিভ এই প্ল্যাটফর্মটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। চলতি বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবহারকারী ছিল সাত কোটি ৫০ লাখ। কিন্তু করোনাকালে এই প্ল্যাটফর্মে সাইন-আপ বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ শতাংশ। 

প্রতিষ্ঠানটি তার দেড় হাজার ব্যবহারকারী-কর্মীর ওপর সম্প্রতি জরিপ চালিয়েছে। যাদের প্রত্যেকেই কর্মস্থলভিত্তিক কর্মী ছিলেন এবং করোনাকালে প্রথমবারের মতো কাজ করেছেন ঘরে থেকে। জরিপটিতে নজর কাড়া এবং চমকে ওঠার মতো কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ১৩ শতাংশ কর্মী জানিয়েছেন, ঘরে বসে কাজ করার সময় তারা ক্যামেরা বন্ধ রাখতেন। কারণ ওই সময় হয় তারা নগ্ন ছিলেন অথবা স্বল্প পোশাকে ছিলেন। আর ৪২ শতাংশ জানিয়েছেন, ঘরে থেকে কাজ করার সময় তারা তাদের কর্মস্থলের অভাবটা মোটেও অনুভব করেননি।

তবে সব থেকে উল্লেখযোগ্য অনুসন্ধানটি হলো, ৬৪ শতাংশের মতে ঘরে থেকে কাজ করায় তাদের উৎপাদনশীলতা কমে গেছে। মেন্টিমিটারের প্রধান নির্বাহী জনিভার স্ট্রোয়েম উৎপাদনশীলতার এই তারতম্যের কিছু কারণ বের করেছেন। তার মতে, জরিপে অংশ নেয়াদের বেশিরভাগই দূরবর্তী কাজে (remote working) একেবারেই নতুন। পাশাপাশি নতুন কিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ার যে সময়কাল, সেটিও উৎপাদনশীলতা খানিকটা কমে যাওয়ার একটি কারণ বলে মানছেন তিনি। 

এছাড়া কর্মস্থলের বেশ কিছু উপাদান ভার্চুয়াল জীবনে নতুন করে তৈরি করাটাও বেশ কঠিন। যেমন- হঠাৎ কোনো একটা সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক কোনো সহকর্মীর কাছে গিয়ে সেটি নিয়ে আলোচনা করা যাচ্ছে না। কাজেই সমস্যা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে আরও কিছুটা সময়। 

অন্যদিকে ডুইস বুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, ঘর থেকে কাজ করার অন্যতম এবং বাড়তি সুবিধা হতে পারে বর্ধিত উৎপাদনশীলতা। কিন্তু তখনই সম্ভব, যখন একজন কর্মী তার কর্মঘন্টাকে কার্যকর ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখতে পারবে।

যেমন, একজন কর্মী যখন বাড়ি থেকে কাজ করে সে বুঝতে পারে না যে তার ঠিক কতক্ষণের কর্মবিরতি নিতে হবে। কর্মস্থলে কিন্তু এটা নিয়ে তাকে ভাবতে হয় না। আবার ঘরে বসে কাজ করার সময় কোনো কর্মী তার সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলছে না। ফলে তার উপর একধরনের মানসিকচাপও তৈরি হতে পারে। কাজেই একজন কর্মী বাড়িতে থেকে কীভাবে কাজ করবেন, সে বিষয়েও তার প্রশিক্ষণের দরকার আছে। করোনা সঙ্কটের আরেকটি বড় প্রভাব পড়ছে ঘরে বসে কাজ করা বাবা-মায়েদের ওপর। এই সময়টিতে তাদের সন্তানদের হোম-স্কুলের বিষয়টিও দেখভাল করতে হচ্ছে। কাজেই কর্মক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতায় একধরনের প্রভাব তো পড়বেই।

স্বাভাবিকভাবেই জার্মান কর্মবাজারে এখন বড় একটি প্রশ্ন। করোনা মহামারি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কি বিশাল সংখ্যক কর্মী হোম-অফিস চালিয়ে যাবেন? এই করোনাকাল প্রমাণ করে দিয়েছে ইন্টারনেট কিংবা প্রযুক্তি মানুষকে কতটা কর্মক্ষম এবং উৎপাদনশীল করতে পারে। এই অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কর্মীদের হোম-অফিসে আরও কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে উল্লেখযোগ্য হারে। এটিও পরীক্ষিত যে, ডিজিটালাইজেশন কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে পরিবেশগত প্রভাব ফেলতে পারে। জার্মানিতে অসংখ্য কর্মী আছেন যারা প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পথ গাড়ি চালিয়ে কর্মক্ষেত্রে যান। হোম –অফিস নিশ্চিত ভাবেই কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা কমিয়েছে অনেকখানি। 

সব মিলিয়ে যেসব কর্মী এতোদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছেন, তারা যদি ঘরে বসে কাজ করাকে তাদের অধিকার মনে করেন, তা অস্বীকার করার উপায় জার্মান সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই। কাজেই করোনা-উত্তর জার্মানিতে যে হোম-অফিসের চর্চা বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই।

(লেখক: জার্মানি প্রবাসী)

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

10h ago