রবি গেল অস্তাচলে…

‘...মানুষকে তো মরতে হবেই একদিন। এক ভাবে না এক ভাবে এই শরীরের শেষ হতে হবে তো, তা এমনি করেই হোক না শেষ। ক্ষতি কী তাতে? মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছিঁড়ি করার কী প্রয়োজন? তাঁর দেওয়া দেহ অক্ষতভাবেই তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া ভালো।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহের আশ্রমকন্যা এবং রোগশয্যায় মুখে মুখে বলা কবির রচনার অনুলিপিকার রানী চন্দের বর্ণনায় ঠিক এভাবেই নিজের অপারেশনের ব্যাপারে মনোভাব জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

মনে প্রাণে শেষ সময়ে এসে অপারেশনটা চাননি তিনি বরং কবিরাজী চিকিৎসার উপর ভরসা রাখতে চেয়েছিলেন।

পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও বলেছেন, ‘রথী, কবিরাজ তো বলেছেন যে তিনি খুবই আশা করেন তার ওষুধেই আমাকে ভাল করে তুলবেন। তবে একটু সময় লাগবে! আঃ! বাঁচি যদি কাটাছেঁড়া না করতে হয়।’

১৯৪১ সালের ৯ জুলাইযখন ডা. জ্যোতিপ্রকাশ সরকার শান্তিনিকেতনে গিয়ে কবিকে অপারেশনের সিদ্ধান্তের কথা বলেন তখন তাকেও জানিয়েছিলেন কবিরাজের উপর তিনি ভরসা রাখতে চান, মিথ্যে কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন নেই।

জ্যোতিপ্রকাশ চলে যাবার পর, নির্মল কুমারী মহলানবিশকে (শেষ সময়ে কবির সার্বক্ষণিক দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন) বলেছিলেন, ‘...বয়স তো ঢের হয়েছে, আর কদিনই বা মানুষ বাঁচে, কাজেই ছেড়ে দিক না আমাকে। ফুলের মতো, ফলের মতো, শুকনো পাতার মতো আমার স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি ঘটুক।’

পরদিন (১০ জুলাই) কবিরাজ কমলাকান্ত ঘোষকে ডেকে তিনি মজা করে তার 'ব্রহ্মাস্ত্র' ছাড়ার কথা বলেছিলেন সম্ভাব্য অস্ত্রাঘাত থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য।

কান্না আর ধৈর্যচ্যুতি এই দুটো রবীন্দ্রনাথের কখনও ছিল না, কিন্তু অপারশেনের সিদ্ধান্তের পর এই দুটোই দেখা গেছে তার মধ্যে। শুধু তাই নয়, অপারেশনের সিদ্ধান্তের পর থেকেই তিনি মুষড়ে পড়েছিলেন এবং সর্বক্ষণ মাথায় ছিল এই একটাই চিন্তা।

১৬ জুলাই কলকাতা থেকে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের শান্তিনিকেতনে আসার কথা শুনে বাচ্চাদের মতো বলেছেন, ‘ডাক্তার যখন আমার পেট টিপবে, আমি বলবো যে কোথাও লাগছে না।’

বিকালে বিধান রায় কবির সঙ্গে দেখা করে অপারেশনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘অপারেশনটা করিয়ে নেওয়াই ভাল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সাবধানের মার নেই।’

এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ শুধু বলেছিলেন, ‘মার যখন আসে তারও সাবধান নেই।’

রাতে পুত্রবধু প্রতিমা দেবীর কাছে সকাতরে বলেছেন, ‘মামণি, আজ সব ঠিক হয়ে গেল। এরা আমাকে কাটবেই, কিছুতেই ছাড়বে না।’

কবির অপারেশন (সুপ্রা পিউবিক সিস্টোস্টমি) নিয়ে সেই সময়কার চিকিৎসকদের মধ্যেও ছিল মতভেদ। 

সেই সময়ের প্রখ্যাত এবং কবির ব্যক্তিগত চিকিৎসক নীলরতন সরকার ছিলেন অপরেশনের বিরোধী। তার যুক্তি ছিল অপারেশনটা সাধারণ মানুষের উপর হচ্ছে না। রুগী যে-সে লোক নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সাধারণ লোকের মতো ওঁর নার্ভ সিস্টেম নয়। অপারেশনের ঝুঁকি না নিয়ে ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা চালানোর পক্ষে ছিলেন ডা. নীলরতন।

অপরদিকে ডা. বিধান রায়ের যুক্তি, এই অবস্থায় চিকিৎসাশাস্ত্রে অপরেশনই একমাত্র প্রতিকার। পরে ডা. সরকার যখন স্ত্রী বিয়োগের পর গিরিডিতে চলে যান, তাকে না জানিয়ে কবির অপারেশন করা হয়।ডাক্তারদের যুক্তির কাছে নতী স্বীকার করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ নিজেও। বাবার আপত্তিটা শুধুমাত্র বার্ধক্যের ছেলেমানুষি হিসেবেই দেখেছিলেন তিনি।

অবশেষে অপরেশন করানোর জন্য কবিগুরুকে ২৫ জুলাই শান্তিনিকেতন থেকে আনা হয় কলকাতায়।

২৪ জুলাই কবির কলকাতা যাত্রার কথা শুনিয়ে তার ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দ (পরবর্তীতে ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) যখন বললেন, গুরুদেব আপনার জন্য গাড়ীর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘গাড়ীর ব্যবস্থা না মারবার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছ?’ অবশ্য পরক্ষণেই কবি নিজেই আবার হেসে বলেন, ‘বাঙাল ঠাট্টাও বোঝে না।’

২৫ জুলাই শুক্রবার সকালে আশ্রমের ছেলে-মেয়েরা-‘এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’ এবং ‘আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন’---গান গেয়ে কবিকে বিদায় জানায়। 

৭০ বছরের স্মৃতি বিজড়িত শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসার সময় হয়তো কবি বুঝেছিলেন এটিই তার শেষ যাত্রা। বার বার চোখে রুমাল বুলাতে দেখা গেছে আসবার সময়। 

শান্তিনিকেতনে কবি প্রথম গিয়েছিলের তার পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মাত্র দশ বছর বয়সে।

রেলের ভিতরেও মজা করেছেন সবার সাথে। যাত্রাপথে কবির খা‌ওয়ার জন্য কবিরাজের নির্দেশে চিড়ের ‘মন্ড’ বানিয়ে আনা হয়েছিল।

বর্ধমান স্টেশনে যখন ট্রেন থামল, নিবারন বাবু নেমে এসে জানালা দিয়ে কেমন আছেন প্রশ্ন করলে কবি তার উত্তর দেন, ‘না, বেশ আছি, দিব্যি “মুন্ডু” খেতে খেতে চলেছি।’

কলকাতায় লোকজনের ভিড় এড়াতে কবির এই যাত্রার কথা গোপন রাখা হয়েছিল। বেলা সোয়া তিনটায় তিনি পৌঁছান জোড়াসাকোঁর বাড়িতে। 

বাড়ির দোতলায় ‘পাথরের ঘর’, যেটি সবসময় ব্যবহৃত হতো বসবার ঘর হিসেবে সেখানে থাকবার ব্যবস্থা হলো। ঘরের পুব দিকের বারান্দার দক্ষিণ দিকে কবির অস্ত্রোপচারের জন্য একটা অস্থায়ী অপারেশন থিয়েটার বানানো হয়েছিল।

ঠিক হলো ৩০ জুলাই হবে অপরেশন, কিন্তু কবিকে জানতে দেওয়া হয়নি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, যাতে তিনি বিচলিত না হয়ে পড়েন। 

২৭ জুলাই-তেও লিখেছেন কবিতা---

‘প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে--

কে তুমি,

মেলেনি উত্তর...’

তারপর মজা করে বললেন, ‘ডাক্তাররা আমাকে নিয়ে বেজায় বিপদে পড়েছে। হার্ট দেখে, লাংস দেখে, কোনো দোষ খুঁজে পাচ্ছে না বলে ওদের ভারী মন খারাপ। রোগ নেই, ওরা চিকিৎসা করবে কার? এতে ওদের মন খারাপ হবে না?’

২৯ জুলাই ডা. জ্যোতিপ্রকাশকে ডেকে অপারেশন কবে হবে সেটা জানতে চান। সেই সময় কবিকে প্রতিদিন গ্লুকোজ ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছিল সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘সেই বড়ো খোঁচার ভূমিকাস্বরূপ এই ছোটো ছোটো খোঁচাগুলো আর কতদিন চালাবে? এটা চুকে গেলে বাঁচি।’

অপারেশনের সময় কবিকে অজ্ঞান না করে লোকাল অ্যানেসথিসিয়া দিয়ে অপারেশন করা হবে এটা জানতে পেরে জ্যোতিপ্রকাশকে প্রশ্ন করেন ব্যাপারটা কেমন হবে এবং তার ব্যাথা লাগবে কিনা।

উত্তরে জ্যোতিপ্রকাশ বলেছিলেন, ‘আপনি টেরও পাবেন না কিছু। এই তো রোজ গ্লুকোজ ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে, এই রকম একটা খোঁচার মতো হয়তো একবার একটু লাগবে। আপনি কিছু ভাববেন না এ নিয়ে। এমনও হতে পারে যে, অপারেশন-টেবিলে এক দিকে অপারেশন হচ্ছে আর এক দিকে আপনি কবিতা বলে যাচ্ছেন।’

এরপর খুশি হয়ে জ্যোতিপ্রকাশের জন্য ভাল খাবারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন।

সেদিন বিকালেও লিখেছেন কবিতা---

‘দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে

এসেছে আমার দ্বারে;

একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছিনু

কষ্টের বিকৃত ভান, ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত—

অন্ধকার ছলনার ভূমিকা তাহার...’

৩০ জুলাই সকালে আবার ডা. জ্যোতিপ্রকাশকে প্রশ্ন করেছেন অপারেশনটা কবে হচ্ছে। অপারেশনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরেও তিনি উত্তর দিয়েছিলেন এখনও তারিখ ঠিক হয়নি। অপারেশনের কথা শুনে কবি শেষ মুহূর্তে যাতে বিচলিত না হয়ে পড়েন সেই জন্য ছিল এই রাখঢাক।

সকালে জার্মান-রাশিয়ার যুদ্ধের খবর কী সেটা জানতে চেয়েছেন প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ (রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি)-এর কাছে। 

সকালে রানী চন্দকে লিখতে ইশারা করে বলে গেলেন---

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি

বিচিত্র ছলনাজালে,

হে ছলনাময়ী।

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে

সরল জীবনে...

কবিতাটি বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন তিনি। কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলেন। সাড়ে নয়টার সময় রানীকে আবার লিখতে বলেন---

‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে

সে পায় তোমার হাতে

শান্তির অক্ষয় অধিকার।’

পরে লাইনগুলি সকালবেলার কবিতাটির সঙ্গে জুড়ে দিতে নির্দেশ দেন।

বেলা ১০টার দিকে আবার লিখতে বললেন। এবার চিঠি, ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী প্রতিমা দেবীর উদ্দেশ্যে। ব্রংকাইটিসে ভোগার কারণে তিনি শান্তিনিকেতনেই ছিলেন। 

সেই চিঠিরও শুরুটা ছিল—'মামণি তোমাকে নিজের হাতে লিখতে পারি নে বলে কিছুতে লিখতে রুচি হয় না…’। চিঠিখানা লিখে গুরুদেবের হাতে দিলে তিনি কাপাঁ হাতে লিখলেন ‘বাবামশায়’।

অক্ষরগুলি একটার গায়ে আর একটা লেগে লেখাটা অম্পষ্ট হলো। এটিই ছিল কবির শেষ কলম ধরা। তখনও তিনি জানতেন না একটু পরে তার অপারেশন হবে। 

বাইরে তখন অপারেশনের সব আয়োজন সম্পূর্ণ। সাড়ে ১০টায় ডাক্তার ললিতমোহন বন্দোপাধ্যায় ঘরে ঢুকেই কবিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আজ দিনটা ভালো আছে। তাহলে আজই সেরে ফেলি কি বলেন?’

উত্তরে কবি শুধু বললেন, ‘আজই? একটু থেমে আবার বলেন, তা ভালো, এরকম হঠাৎ হয়ে যাওয়াই ভালো।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন সকালে লেখা কবিতাটি পড়ে শোনানোর জন্য। শুনে জানালেন কিছু গোলমাল আছে, তবে ডাক্তার বলেছে অপারেশনের পরে মাথা পরিস্কার হবে তখন ঠিক করব।

বেলা ১১টায় স্ট্রেচারে করে অপারেশন টেবিলে আনা হয় কবিকে এবং ১১:২০ মিনিটে শুরু হয়ে আধা ঘণ্টায় শেষ হয় অপারেশন। ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় অপারেশনের নেতৃত্ব দেন।

লোকাল অ্যানেসথিসিয়া দিয়ে অপারেশন করানোর কারণে ব্যাথা সহ্য করতে হয়েছিল তাকে, তবে একটা শব্দও উচ্চরণ করেননি।

১২ টায় অপারেশন শেষের পরযখন তাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়, সবার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে তখন নিজেই হেসে বললেন, ‘কী ভাবছ? খুব মজা-না?’

অপারেশনের সময়ে লেগেছিল কিনা, সন্ধ্যায় ডা. ললিতমোহনের এমন প্রশ্নে তিনি মজা করে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেন মিছে মিথ্যে কথাটা বলাবে আমাকে দিয়ে।’

এখানেই থামেননি, ডা. জ্যোতিপ্রকাশকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘জ্যোতিকে আমি একবার জিজ্ঞেস করতে চাই-- সে যে আমাকে বোঝালে যে একটুও লাগবে না- তার মানে কী?’

৩১ তারিখে কবি সারাদিন প্রায় অসাড় হয়ে শুয়ে ছিলেন। সন্ধ্যাবেলায় যখন সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখন হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘এত গম্ভীর মুখ কেন? একটু হাসো।’

১ আগস্ট কবির হিক্কা উঠতে থাকে। সন্ধ্যাবেলায় নির্মল কুমারীকে ডেকে কষ্ট পাচ্ছেন জানিয়ে কিছু একটা করতে বলেন। ওষুধ দেবার কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বলেন ‘কিচ্ছু কমবে না। ওরা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না আমি তা টের পেয়েছি। কেবল আন্দাজে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছে।’

২ আগস্ট সারারাত আচ্ছন্ন হয়ে ছিলেন। কিছু খাওয়াতে গেলেই বিরক্তি প্রকাশ করে তাকে জ্বালাতন না করার কথা বলেছেন। ডাক্তার এসে যখন জিজ্ঞাসা করলেন কী রকম কষ্ট হচ্ছে। তিনি হেসে উত্তর দিলেন, এর কি কোন বর্ণনা আছে?

৩ আগস্ট কবির অবস্থার আরও অবনতি হলো। কিছু খাওয়াতে গেলেই বিরক্তি নিয়ে বলেছেন, ‘যিনিই বলুন না কেন আমি কারো কথাই আর শুনছি নে। তোরা আর জ্বালাস নে আমাকে।’

এদিন প্রতিমা দেবীকে টেলিফোন করে কলকাতায় চলে আসার জন্য বলা হয়।

৪ আগস্ট ভোরবেলা অল্পক্ষণের জন্য একটু-আধটু কথা বলেছেন। ডাকলে সাড়া দিয়েছেন। প্রতিমা দেবী শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে কবির কাছে গিয়ে বললেন, বাবামশায় আমি এসেছি, আমি বউমা।

চোখ মেলে প্রতিমা দেবীর দিকে তাকালেন এবং তার দেওয়া জল খেলেন কবি।

৫ আগস্ট কবির কোন সাড়াশব্দ নেই, একেবারেই অচৈতন্য। সন্ধ্যাবেলা এলেন ডা. বিধান রায় এবং ডা. নীলরতন সরকার।

রাতে স্যালাইন দেওয়া হলো কবিকে। অক্সিজেন সিলিন্ডার আনা হলো। কবির গাল তখন ফুলে গেছে, বাঁ চোখ ছোট ও লাল হয়ে গেছে, পা এবং হাতের আঙ্গুলে ঘাম জমছে।

৬ আগস্ট সকাল বেলা থেকেই জোড়াসাঁকোর বাড়ী লোকে লোকারণ্য। কবির হিক্কা উঠছে সমানে, সাথে কাশি।

এ দিন কয়েকজন কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থকে ডাকতে চেয়েছিল শেষবারের মতো কিন্তু রাজী হননি ডা. বিধানরায়।

রাত ১২টার দিকে কবির অবস্থার আরও অবনতি হয়।

৭ আগস্ট ভোরবেলা থেকেই জোড়াসাঁকো বাড়ি প্রাঙ্গণ লোকের ভিড়। আত্মীয়-বন্ধু, পরিজন-প্রিয়জন, অসংখ্য ভক্ত--- সবাই এসেছে কবিকে দেখতে। পুবের আকাশ ধীরে ধীরে আলোকিত হলো।

অঞ্জলি ভরে চাঁপা ফুল নিয়ে এলেন অমিতা ঠাকুর। ছড়িয়ে দেওয়া হল গুরুদেবের দু'খানি পায়ের উপর।

সকাল ৭ টায় খাটের পাশে দাঁড়িয়ে উপসনা করলেন রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়। কবির পায়ের কাছে বসে বিধুশেখর শাস্ত্রী উচ্চারণ করলেন—'ওঁ পিতা নোহসি পিতা নো বোধি।’

অমিতা ঠাকুর মুখে জল দিলেন। কবির নাড়ী ধরে বসে রইলেন ডা. জ্যোতিষচন্দ্র রায়। চীনা অধ্যাপক তান-য়ুন-সান শুরু করলেন মালা জপ। ডা. অমিয় সেন কবির নাড়ী অতি কষ্টে খুঁজে পেলেন এবং পরে ক্ষতস্থান পরিস্কার করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন। বেলা ৯ টায় দেওয়া হলো অক্সিজেন। শেষবারের মতো দেখে গেলেন বিধান রায় ও ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। কানের কাছে অবিরাম পড়া হচ্ছিল তার জীবনের বীজমন্ত্র 'শান্তম, শিবম্, অদ্বৈত্যম'। বারান্দায় কে যেন গেয়ে চলেছেন, ‘কে যায় অমৃতধামযাত্রী...’

খুলে দেওয়া হলো অক্সিজেনের নল- ধীরে ধীরে কমে এল পায়ের উষ্ণতা। একসময়ে থেমে গেল হৃদস্পন্দন। ঘড়িতে তখন ১২টা ১০ মিনিট।

বাড়ির বাইরে তখন কোলাহল, সবাই একবার দেখতে চায় কবিগুরুকে।

কবিকে তখন স্নান করানো হচ্ছে, অপেক্ষারত জনতার এক অংশ দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে সেই ঘরটিতে।

সেই অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে নির্মল কুমারী মহলানবিশ লিখেছেন, ‘কী দারুণ অপমান কবির চৈতন্যহারা এই দেহটার। যে মানুষের মন এত স্পর্শকাতর ছিল, যে মানুষ বাইরের লোকের সামনে নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কথা কখনও প্রকাশ করতে পারতেন না, সেই মানুষের আত্মাহীন দেহখানা অসহায়ভাবে জনতার কৌতুহলী দৃষ্টির সামনে পড়ে রইল।’

কবিকে শেষবারের মতো সাজানো হলো। পরানো হল বেনারসী-জোড়, কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, পাট-করা চাদর গলার নীচ থেকে পা পর্যস্ত ঝোলানো হলো, কপালে চন্দন, গলায় গোড়ে মালা, দু পাশে রাশি রাশি শ্বেতকমল রজনীগন্ধা। বুকের পরে একটি পদ্মকোরক।

শেষযাত্রার জন্য তৈরি হলো কাঠের পালঙ্ক, সোনালি বুটি দেওয়া চাদর… জুঁই, বেলীর মালায় সাজানো।

একে একে প্রণাম করে যেত লাগল নারী-পুরুষ। গাওয়া হতে থাকল ব্রাহ্মসংগীত।

এমন সময় শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র প্রদ্যোতকুমার সেন কবির শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে বললেন, গুরুদেবকে কি শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়া যায় না?

কবি তার শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘...আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে, ‘জয় বিশ্বকবি কি জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, বন্দেমাতরম্”-এই রকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে। আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায়, আমার ছেলেমেয়েদের মাঝখানে। সেখানে জয়ধ্বনি থাকবে না, উন্মত্ততা থাকবে না। থাকবে শান্তস্তব্ধ প্রকৃতির সমাবেশ। প্রকৃতিতে মানুষে মিলে দেবে আমাকে শান্তির পাথেয়। আমার দেহ শান্তিনিকেতনে মিশিয়ে যাবে-এই আমার আকাঙ্ক্ষা। চিরকাল জপ করেছি “শান্তম”। এখন বিদায় নেবার আগে যেন সেই “শান্তম” মন্ত্রই সার্থক হয়।’

‘ডাকঘর’ নাটকে অমল চরিত্রের জন্য লেখা ‘সমুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার’ গানটা নাটকে ব্যবহার না করে তার শবযাত্রায় গাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু হলো সব তার উল্টো। কারণ ঠাকুরবাড়ির ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য দেখানোর জন্য প্রস্তুত ছিল না অপেক্ষারত লাখো জনতা। ততক্ষণে ঠাকুরবাড়ীর আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে সবকিছু। 

বেলা ৩ টার দিকে একদল লোক কবির দেহ তুলে নিয়ে যাত্রা শুরু করলো নিমতলা শ্বশানের উদ্দেশ্যে যাদের কাউকেই চিনতেন না ঠাকুরবাড়ীর কেউ। মুখে জয়ধ্বনি--বিশ্বকবির জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, বন্দেমাতরম্।

মানুষের কাঁধের উপর ভেসে চললেন কবিগুরু, ঠিক যুধিষ্ঠিরের রথের চাকার মতো।

ঠাকুরবাড়ি থেকে বের হয়ে শবযাত্রা চিৎপুর রোড, বিবেকানন্দ রোড, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, কলুটোলা স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট, বটকৃষ্ণ স্ট্রিট হয়ে নিমতলা শ্মশান পৌঁছাল। সংগ্রহে রাখার জন্য কবির মৃতদেহ থেকে চুল ও দাড়ি ছিঁড়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল শবযাত্রায়।

এই সময়ের একটা বর্ণনা পাওয়া যায় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর স্মৃতিকথা মূলক গ্রন্থ ‘বাঙালনামা’-তে।

প্রত্যক্ষদর্শী তপন রায়চৌধুরী সেদিনের স্মৃতি বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘…এমন দ্বিধাহীন বর্বরতার দৃশ্য দেখতে হবে কখনও ভাবিনি। প্রচণ্ড চেঁচামেচি ঠেলাঠেলি চলছিল। জনতার চাপে ঠাকুরবাড়ির লোহার গেট ভেঙে গেল। মানুষের ভিড় এত বেশি যে আমাদের পা প্রকৃতপক্ষে মাটি ছুঁচ্ছিল না। এরই মধ্যে হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে মানুষের মাথায় মাথায় খাটের ওপর শোয়ানো ওঁর দেহ বেরিয়ে এল। আর অনেক লোক ওঁর চুল দাড়ি ছিঁড়ে নিচ্ছিল। কবির দেবদেহ শুধু মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম। বাইশে শ্রাবণ আমার কাছে শুধু জাতীয় শোকের দিন নয়, জাতীয় গ্লানির দিনও হয়ে আছে। এই বর্বরতার নায়করা যতদূর দেখতে পেলাম তথাকথিত ভদ্র বাঙালি ছাড়া কেউ নয়।’

স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুততায় শবযাত্রা পৌঁছে গেল নিমতলা শ্মশানে। 

কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ভিড় ঠেলে শ্মশানে যেতে না পারায় বাবার মুখাগ্নিও করতে পারেননি। কবির মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের ঠাকুরের পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর নৌকা করে শ্মশানে গিয়ে মুখাগ্নি করেন কবিগুরুর।

পুরো শোকযাত্রা ধারাবিবরণী আকাশবাণীতে প্রচার হয় এবং সেই ধারা বিবরণী দিয়েছিলেন সেই সময় কলকাতার আরেক অসীম প্রতিভাধর, যিনি সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ এবং মহালয়ার জন্য সমধিক পরিচিত, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

তার বর্ণনার শেষ অংশছিল, ‘...ও পারে দূরের ওই নীলাকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারে এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হলো এক মহপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল অস্তাচলে...’

প্রয়াণদিবসে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি একমেবাদ্বিতীয়ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি।

তথ্য ও গ্রন্থ ঋণ

গুরুদেব/শ্রী রানী চন্দ

বাইশে শ্রাবণ/নির্মল কুমারী মহলানবিশ

বাঙালনামা/তপন রায়চৌধুরী

রবীন্দ্র জীবন কথা/প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়

‘যা বীরেন্দ্র সর্বভূতেষু’/জগন্নাথ বসু, অনুলিখন:স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়/আনন্দবাজার পত্রিকা

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীতে রক্ষিত দিনলিপি

আলাপন: আমার রবীন্দ্রনাথ, ঋতুপর্ণ ঘোষ

ছবি: ইন্টারনেট/আনন্দবাজার পত্রিকা

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago