সিলেট বিভাগের ৯০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গ্রাম ‘করোনামুক্ত’
কখনো বন্ধুর পথ, কখনো পাহাড়-টিলা পাড়ি দিয়ে যেতে হয় এসব এলাকায়। এতই প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে নেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। তাই এসব স্থানে বসবাসকারীদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বলা হয়। তবে করোনাভাইরাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিক থেকে তারা এগিয়ে। গত পাঁচ মাসে সিলেট বিভাগের সব এলাকায় ভাইরাসের সংক্রমণ হলেও, ৯০টি পুঞ্জিতে বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গ্রামে এখনো কোনো কোভিড-১৯ রোগী পাওয়া যায়নি।
কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনের (পুঞ্জিবাসীদের অধিকার আদায়ের একটি সংগঠন) দেওয়া তথ্য মতে, সিলেট বিভাগে প্রায় ৯০টি পুঞ্জি রয়েছে। এসব পুঞ্জিতে জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।
পুঞ্জিগুলোকে করোনামুক্ত রাখতে দিন-রাত মাঠে কাজ করছেন তারা। ছুটে চলেছেন এক পুঞ্জি থেকে আরেক পুঞ্জিতে। মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। পাশাপাশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করাসহ সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে নানামুখী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। চাল-ডাল বাইরে থেকে কিনে আনার পর তাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয় এবং এক সপ্তাহ পুঞ্জির গেট সংলগ্ন বাড়িতে রাখা হয় যেন কোনোরকম ভাইরাস পুঞ্জিতে ছড়াতে না পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘গতকাল শনিবার পর্যন্ত সিলেটে মোট করোনা রোগী পাওয়া গেছে ৮ হাজার ৪৯৭ জন ও মারা গেছেন ১৫৩ জন। অথচ পুঞ্জিতে বসবাসকারীদের কারোই করোনা সংক্রমণ হয়নি।’
‘এসব এলাকার মানুষ ঠিকমত লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি মানছেন বলেই আজ পর্যন্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। তারা মানছেন বলে তাদের এই কর্মকাণ্ডের সুফলও মিলেছে। পুঞ্জিতে যেভাবে লকডাউন ও হাইজিন প্রোটোকল অনুসরণ করা হয়, তা সকলের জন্য অনুকরণীয়। এটি একটি ভালো অনুশীলন। যে কেউ উদাহরণ হিসেবে এটি অনুসরণ করতে পারে’, যোগ করেন তিনি।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ধনছড়া পুঞ্জির বাসিন্দা দিপু রেমা বলেন, ‘লকডাউন বাস্তবায়নের বিষয়ে আমরা গ্রামের সবার সঙ্গে মিটিং করেছি, যাতে কাউকে বিশেষ ছাড় দেওয়া না হয়। কোভিড-১৯ যদি আমাদের অঞ্চলে প্রবেশ করে, তবে প্রত্যেকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য আমরা এসব করছি।’
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার মেগাটিলা পুঞ্জির মন্ত্রী (প্রধান) মনিকা খংলা বলেন, ‘ভাইরাসের বিরুদ্ধে সতর্কতা হিসেবে এমনকি বাইরে থেকে কেনা চাল বা ডালের বস্তায় স্প্রে করা হয় জীবাণুনাশক এবং পুঞ্জি ফটক সংলগ্ন একটি ঘরে এক সপ্তাহ রাখা হয়।’
সিলেট ডায়োসিসের প্রধান বিশপ বিজয় এন ডি ক্রুজের নেতৃত্বে সচেতনতা বাড়াতে পুঞ্জিতে কাজ করছেন ফাদার যোসেফ গমেজ ওএমআই এবং তার দল।
তিনি বলেন, ‘আমরা এক পুঞ্জি থেকে অন্য পুঞ্জি যাচ্ছি সবাইকে মাস্ক পরার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিতে। আমরা নিজেরাও কঠোর স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখছি এবং প্রচারণার সময় নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করছি।’
এন ডি ক্রুজ আরও বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে পুঞ্জিগুলোতে জনসাধারণের উপাসনার জন্য একত্রিত হওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ইউএনও এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘কোভিড-১৯ বিষয়ে পুঞ্জিবাসীরা অত্যন্ত আন্তরিক। তাদের কড়া নিয়ম আমাদের গর্বিত করে তুলেছে। আমরা তাদেরকে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন কার্যক্রম চালাতে সহায়তা করছি, যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা হয়।’
কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলি তালাং বলেন, ‘সিলেট বিভাগে প্রায় ৯০টি পুঞ্জি আছে। এতে প্রায় ৪০ হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস করেন। বেশিরভাগ এলাকায় পাহাড়ি রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ থাকায় এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় এগুলো এখনো দুর্গম এলাকা, যেখানে আধুনিক সুবিধা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য এই মহামারি চলাকালে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছি।’
Comments