বৈরুত বিস্ফোরণের দুঃসহ স্মৃতি
ঘটনার পাঁচ দিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু লেবাননের রাজধানী বৈরুত বন্দরের সেই বিস্ফোরণের দুঃসহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারছেন না বৈরুতবাসী। ৪ আগস্ট বিকাল ৬:০৭মিনিট হঠাৎ বিকট শব্দে পুরো লেবানন যেন ভূমিকম্পের মতো দুলছিল। ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে গিয়েছিল বহুদূর। কালো ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে যায় পুরো শহর। এরপর মহূর্তেই লন্ডভণ্ড সব। বাসা বাড়ির কাঁচগুলো যেন বৃষ্টির মতো ভেঙে পড়ছে।
প্রচণ্ড শব্দে আমরা সবাই ভয় পেয়ে যাই। গুজব ছড়িয়ে পড়ে বোধহয় লেবাননে হামলা হয়েছে। মনে হয় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সবকিছু ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁপছিল। ৩৫ কিলোমিটার দূ্র থেকেও আকাশে কালো ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছিলাম। কয়েকজন বাংলাদেশি ফোন করে জানান, বৈরুতে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। আমার পরিচিত একজন আহত হয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে যাই। দেখি শত শত লোক আহত অবস্থায় পড়ে আছে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই।
খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আমার পরিচিত এক বাংলাদেশি নারী আহত হয়েছেন। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতাল ও এর আশেপাশে তখন শুধু মানুষ আর মানুষ। আমি কোনদিন এই দৃশ্য ভুলবো না। মনে হচ্ছিল রক্তে ভেজা লাল গোলাপ ফুলের পাপড়ির মতো মানুষ পড়ে আছে চারপাশে। আশেপাশের বাড়িঘর, মার্কেটসহ সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। মনে হলো আমি একটা মরুভূমির একপাশে দাঁড়িয়ে আছি।
আসলে দিনটা ছিল ভয়াবহ। বিশেষ করে বৈরুত বন্দর এলাকায় বসবাস করা বাসিন্দা ও কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা যেন খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছে। এ কারণেই তাদের ভয় এখনো কাটেনি। তারা বলেছেন, মাথার কাছে যেন সব ভেঙে পড়ছে। গ্লাসের আঘাতে কম বেশি অনেকের হাত-পা কেটেছে। কে কাকে নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে কেউ জানে না। হাসপাতালগুলোকে মানুষ ছুটছে।
আমরা প্রথমে যুদ্ধ বা হামলা ভাবলেও পরে শুনেছি যুদ্ধ না, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সংরক্ষণের গুদামে বিস্ফোরণ হয়েছে বন্দরে। এই বিস্ফোরণে অন্তত ১৩৭ জন মারা গেছে এবং আহত হয়েছে আরও প্রায় ৫০০০ মানুষ। লেবাননে উদ্ধারকর্মীরা এখনো ধ্বংসস্তুপের নিচে কোন মৃতদেহ বা আহত কেউ আছে কী না খুঁজছেন। আমরা প্রবাসীরা সবসময় অন্যদের খোঁজ রেখেছি।
বৈরুতের বোমা বিস্ফোরণে পাঁচ জন বাংলাদেশি নিহত ও ১০৭ জন আহত হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। নিহতরা হলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেহেদি হাসান, রাসেল মিয়া, কুমিল্লার রেজাউল, মাদারীপুরের মিজান ও নারায়নগঞ্জের মোহাম্মদ রাশেদ। বৈরুতের এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি এখনো আতঙ্কে রয়েছেন। আমরা জেনেছি, যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেই সমুদ্রবন্দরে আমাদের নৌবাহিনীর একটি জাহাজ ছিল বিএনএস বিজয়। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২১ জন সদস্য এই বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন।
ঘটনার পরদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আল মুস্তাহিদুর রহমান ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, লেবাননের এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় খোঁজখবর রাখছেন। পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশি কমিউনিটির সবার খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও পরষ্পরের খোঁজ নিচ্ছে। আহতদের চিকিৎসা চলছে।
ঘটনার পর লেবাননে তিন দিনের জাতীয় শোক পালন করা হয়েছে। আমরা বাংলাদেশিরাও তাতে একাত্মতা ঘোষণা করেছি। বেশিরভাগ এলাকা বিধ্বস্ত। রাজধানী বৈরুতের অনেক ভবন ও পার্ক করা গাড়িগুলো এখনো বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে। দেখলে মনে হবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত। সব মিলিয়ে এখানকার অবস্থা ভালো না। ডলারের দাম নিয়ে সংকটের কারণে অনেক বাংলদেশি ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না।
ওদিকে বৈরুতের বন্দরে বিস্ফোরণের ঘটনার পর বিক্ষোভ হয়েছে পুরো দেশে। ক্ষুব্ধ জনগণ সেদেশের সরকারি কার্যালয়গুলোতে হামলা চালিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষে অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। তারা দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতিবাদ করছেন। অনেক মানুষ রাজপথে। বর্তমানে দেড় লাখ প্রবাসীর মনে যেই আতঙ্ক রয়েছে তাতে করে তারা এক মুহূর্তও যেন এখানে থাকতে চাইছেন না। একদিকে প্রবাসীরা যেমন আতঙ্কিত তেমনি দেশে তাদের পরিবার পরিজনও দুশ্চিন্তায়। অনেকে হয়তো চলেও যাবেন। কিন্তু যারা সেদিন বৈরুতে ছিল তারা কী কখনো সেই দিনের ঘটনা ভুলতে পারবে?
(লেখক: লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশি)
Comments