করোনার প্রভাবে অনিশ্চিত বিদেশে অধ্যয়ন ও গবেষণা

ছবি: এএফপি

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং বৃত্তিপ্রাপ্ত হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অধ্যয়ন ও গবেষণা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে অনেক দেশের দূতাবাস এবং কনস্যুলেটরা ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণ করছেন না। করলেও তা সীমিত আকারে। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই আশঙ্কা করছেন যে, তারা বৃত্তির সুযোগ হারাতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদের ভর্তিও বাতিল হতে পারে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক মো. আকিবুর রহমান দুটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরের জন্য বৃত্তির আমন্ত্রণ পেয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য ভর্তি হতে চাই। গত ১৯ জুন আমার তত্ত্বাবধায়ক আমাকে জানিয়েছেন এই সেপ্টেম্বরের মধ্যে যদি আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে না পারি, তাহলে আমার বৃত্তি বাতিল হয়ে যাবে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে তহবিল সংকটের কারণে তারা এই বৃত্তিটি পিছিয়ে দিতে পারবে না।’

‘এটা জানার পর, আমি যখন বাকি দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার ভর্তির ব্যাপারে যোগাযোগ করি, তারা জানায় যে ইতোমধ্যে তাদের আসনগুলো পূরণ হয়ে গেছে। দূতাবাস এখনো ভিসার অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া শুরু করেনি। যার কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমি আর দেখতে পাচ্ছি না। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও আমি কোথাও ভর্তি হতে পারছি না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বলেন, ‘আমি দুটি বৃত্তি পেয়েছি। একটি কমনওয়েলথ স্কলারশিপের অধীনে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে এবং আরেকটি কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু আমি ভিসা কবে পাব তা জানি না। আমাকে বলা হয়েছে যে প্রাথমিকভাবে আমার ক্লাসগুলো অনলাইনে হবে। কিন্তু, আমার গবেষণাটি পরীক্ষাগার ভিত্তিক। যার কারণে, ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে আমাকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে হবে।’

করোনা পরিস্থিতির কারণে এ দেশের অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন দেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি এবং বৃত্তির প্রস্তাব পেয়েও ভর্তি হতে পারছে না। অথচ এর জন্য তারা কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং অনেকে লক্ষাধিক টাকাও খরচ করেছেন।

আকিবুর রহমান বলেন, ‘আপনি যদি জিআরই পরীক্ষার ফি, টোফেল বা আইইএলটিএস পরীক্ষার ফি, ভর্তি ফি, একাডেমিক কাগজপত্র বিদেশে পাঠানোর জন্য কুরিয়ার সার্ভিস চার্জ এবং ভিসা ফি হিসাব করেন তাহলে আমাদের অন্তত দেড় লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। খরচের পাশাপাশি বৃত্তি পেতে জিআরই এবং ইংরেজি ভাষার পরীক্ষায় খুবই ভালো নম্বর অর্জন করতে হয়েছে। পরাজিত করতে হয়েছে দেশ ও বিদেশের কয়েক হাজার প্রতিযোগীকে। এত বাধা পেরিয়ে যখন আমি দেখি যে সুযোগ পেয়েও আমি ভর্তির সুযোগ হারাচ্ছি, তখন এটা সত্যিই খুব বেশি হতাশাজনক।’

এ ছাড়া, এখন অনেক শিক্ষার্থীকে অনলাইন ক্লাসের জন্য অতিরিক্ত টিউশন ফি দিতে হচ্ছে। যা অনেক ক্ষেত্রে টিউশন ফি মওকুফ এবং বৃত্তির আওতায় থাকে না।

ফারহানা হাসান যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ভর্তির প্রস্তাব পেয়েছিলেন। এর জন্য তার টিউশন ফি মওকুফ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে মহামারির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি অক্টোবর থেকে অনলাইন ক্লাস চালু করবে এবং অনলাইন ক্লাসের জন্য এক হাজার ডলার ফি দিতে হবে ফারহানাকে। এই ফি এর ক্ষেত্রে তাকে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি।

ফারহানা বলেন, ‘পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে ২০২১ সালের মার্চ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে হবে। এখন যদি আমি অনলাইন ক্লাসের জন্য ফি পরিশোধ করি, আর করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে না পারি তাহলে খুবই সমস্যায় পড়ে যাব।’

ফারহানা হাসান এবং আকিবুর রহমানের মতো হাজারো শিক্ষার্থী বাংলাদেশে রয়েছেন এবং এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শিরোনামে ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭-১৮ সালে প্রায় ৬০ হাজার বাংলাদেশি উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে গেছেন।

বাংলাদেশ থেকে যারা পড়াশুনার জন্য বাইরে যায় তাদের পছন্দের গন্তব্য হিসেবে শীর্ষ পাঁচটি গন্তব্য মালয়েশিয়া (২০ হাজার ৮১১), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (সাত হাজার ২৮), অস্ট্রেলিয়া (চার হাজার ৯৮৬), যুক্তরাজ্য (দুই হাজার ৫৩৬) এবং জার্মানি (দুই হাজার ৩১১)।

বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা বিষয়ক সুবিধা প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে এই পছন্দ পরিবর্তিত হয়। যেমন, ২০১৩ সালে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ ছিল যুক্তরাজ্য। এরপর ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া এবং কানাডা।

ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০০০ সালে বাংলাদেশ থেকে মাত্র সাত হাজার ৯০০ জন শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। যে সংখ্যাটি গত ১৭ বছরের ব্যবধানে ৬০ হাজার হয়েছে।

ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফএসিডি-সিএবি) তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে দেশের ভর্তি পরামর্শদাতারা এক লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীকে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। গত বছর কমপক্ষে ৭০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়েছে। ২০২০ সালের প্রথম আট মাসে তারা মাত্র তিন হাজার শিক্ষার্থীকে এই সেবা দিয়েছেন। আর এর বেশির ভাগই হয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে।

এফএসিডি-সিএবির সভাপতি কাজী ফরিদুল হক হ্যাপী বলেন, ‘আমরা এক অভূতপূর্ব সংকটে আটকা পড়েছি। আমরা শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার চেষ্টা করছি। তবে দেশগুলো যদি ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট না দেয় তাহলে আর আমরা কী করতে পারি। এটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।’

‘আমাদের শিক্ষার্থীদের মতো আমরাও কোভিড-১৯ এর কারণে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের ৪০০ সদস্যের মধ্যে ৪০টিরও বেশি সদস্য তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। পরিস্থিতি যদি আরও দীর্ঘ দিন ধরে চলে তাহলে আরও অনেকেই এই পথে এগুবে।’

ফারহানা হাসান বলেন, ‘আমরা বিশেষ নিয়মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভিসা দেওয়ার জন্য দেশগুলোকে অনুরোধ করছি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগদানের পরে আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা চালিয়ে যেতে পারবো। যার ফলে সমগ্র মানবতা এবং দেশগুলোও উপকৃত হবে। সেটা না করে গবেষণা তহবিল কমিয়ে দিলে এবং উচ্চ শিক্ষায় সবার অংশগ্রহণের সুবিধা কমিয়ে দিলে তা সমগ্র বিশ্বের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’

Comments

The Daily Star  | English
Nat’l election likely between January 6, 9

EC suspends registration of AL

The decision was taken at a meeting held at the EC secretariat

8h ago