‘করোনা এমনিতেই চলে যাবে’ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় দুই বিশেষজ্ঞ

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ও অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক।

* যেভাবে বাংলাদেশ এখন করোনা নিয়ন্ত্রণ করছে, এটা সঠিক কৌশল নয়। কারণ, বাংলাদেশ কোনো কৌশলই ঠিক করেনি।

* করোনা নিয়ন্ত্রণের সঠিক কৌশল-পরিকল্পনা বাংলাদেশে প্রথম থেকেই ছিল না এবং এখনও নেই।

* ভ্যাকসিনের কোনো বিকল্প নেই। ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে বাংলাদেশে অনেক পিছিয়ে আছে।

* এমনিতেই করোনা চলে যাবে, আমার কাছে মনে হয় এই কথাটা যৌক্তিক না। এমনিতেই কীভাবে যাবে?

* করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় তো ভ্যাকসিন।

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। নতুন শনাক্তের সংখ্যাও গড়ে প্রায় তিন হাজার। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন পেতে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে অন্যান্য দেশ।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা কমে গেছে। মৃত্যুর হার কমে গেছে, সুস্থতা বেড়ে গেছে। ভ্যাকসিন আসুক বা না আসুক কোভিড-১৯ বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই চলে যাবে।

বাংলাদেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতেও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের যথার্থতা কতটুকু, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ভ্যাকসিন লাগবে কি না, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ভ্যাকসিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে, এতে দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ল কি না, করোনা মোকাবিলায় দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগ কতটুকু?— এসব বিষয়ে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হকের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের যথার্থতা ও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না, জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘তিনি কোন পরিপ্রেক্ষিতে, কীভাবে এটা বলেছেন, কোনো বিশেষঞ্জের মতামত নিয়েছেন কি না, আমি জানি না। তবে, এমনিতে কীভাবে করোনা চলে যাবে তা বুঝতে পারছি না। আমার তো মনে হয় না এমনিতেই যাবে। একটা হয় যে, মানুষ যদি বেশি আক্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রতিরোধ ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি) ডেভেলপ করে, যাকে হার্ড ইমিউনিটি বলে। এখন উনি কি ওই সেন্সে বলেছেন কি না, তা তো বলতে পারছি না। তবে, এমনিতেই করোনা চলে যাবে, আমার কাছে মনে হয় এই কথাটা যৌক্তিক না। এমনিতে কীভাবে যাবে?’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ভ্যাকসিন আসুক বা না আসুক কোভিড-১৯ বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই চলে যাবে। যেখানে পুরো পৃথিবী ভ্যাকসিনের জন্যে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে, সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনে করছেন ভ্যাকসিন ছাড়াই করোনা চলে যাবে। এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভ্যাকসিন প্রয়োজন কি না বা কতটুকু প্রয়োজন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরাও তো ভ্যাকসিনের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কারণ, ভ্যাকসিন দিয়েই তো সুরক্ষার সম্ভাবনা বেশি। ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত আমাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মানা, সচেতন থাকা, এগুলো তো করতেই হবে। একমাত্র ভ্যাকসিন যদি আসে, সবাইকে দিতে পারলে হয়তো সুরক্ষা হবে। তার জন্যেই তো আমরাও অপেক্ষা করছি। একটা কার্যকরী, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন, ক্রয় ক্ষামতার মধ্যে, এমন একটা ভ্যাকসিনই তো আমরাও চাই। আমাদের জন্য ভ্যাকসিন অবশ্যই দরকার।’

‘পৃথিবীর যেকোনো দেশেই করোনা কমবেশি আক্রমণ করে চলেছে। আমাদের দেশে হয়তো বলতে পারেন, অন্য দেশের বিচারে তুলনামূলক হয়তোবা কম। কিন্তু, এখানে আত্মতৃপ্তি বা আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ আমি দেখি না। তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কোনো সুযোগ তো নেই। করোনা কবে যাবে, কেউ তো নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছে না। হয়তো অন্য অনেক ভাইরাসের মতো করোনাও সারাজীবনই রয়ে যাবে। সুতরাং এর সংক্রমণ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় তো ভ্যাকসিন। এখন পর্যন্ত গবেষণায় তো এটাই পাওয়া গেছে। আর নতুন কোনো তথ্য তো নেই। ভ্যাকসিন ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ, নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ তো নেই করোনার। এখন (করোনায়) আক্রান্ত হলে যেগুলো আমরা দেই, সেগুলো তো অন্য রোগের। আমরা জানি, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। এ কারণেই তো যেকোনো রোগের জন্যই ভ্যাকসিন দরকার’, যোগ করেন অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ।

তিনি আরও বলেন, ‘এখন ভ্যাকসিনের উপকার কতটুকু হবে এই বিষয়ে মন্তব্য করার মতো সময় তো এখনো হয়নি। কারণ, ভ্যাকসিন বাজারে আসবে, মানুষ ব্যবহার করবে, তখন বাস্তবে আমরা বলতে পারব। এটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়। যেহেতু ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে, চূড়ান্ত হয়ে গেলে, মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হলে তা নিয়ে বলা যাবে। কিন্তু, একমাত্র আশাপ্রদ খবর তো একটাই, ভ্যাকসিন আসবে। তাই আমরাও অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি।’

আমাদের এখানে চীনা কোম্পানির ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের কথা ছিল। কিন্তু, সেটা দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে আটকে আছে। সর্বশেষ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এই বিষয়ে ও অন্যান্য দেশ থেকে ভ্যাকসিন আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এতে দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ল কি না, করোনা মোকাবিলায় দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগ কতটুকু?— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু, আমি যেহেতু কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটিতে নেই, তাই বলতেও পারছি না যে এটা কেন, কোথায়, কীভাবে আটকে আছে। এটা মনে হয়, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আটকে আছে। এখন করোনা তো নিজের মতো করে চলতে থাকবে। করোনা তো আর এসব দেখবে না।’

‘এক্ষেত্রে করোনাকে জয় করা ছাড়া তো আর কোনো পথ নেই। এ ছাড়া, সহজ কোনো পথ তো নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানা তো আছেই, তবে, এক্ষেত্রে একটাই পথ, তা হলো— ভ্যাকসিনের জন্য আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ভবিষ্যতে গবেষণায় কী আসবে তা আমরা জানি না। তবে, এখন পর্যন্ত করা গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, এর কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যবিধি তো মানতেই হবে। এর সঙ্গে কার্যকরী একটা ভ্যাকসিনের জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি যখনি বাজারে ভ্যাকসিনটা আসবে, সেটা আমরাও যাতে পাই, এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, উন্নত দেশ টাকা দিয়ে আগে কিনে নেবে, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশ দেরিতে পাবে, তার জন্য এখনি কার্যকরি ব্যবস্থা নিয়ে আসতে হবে। জনগণ ও দেশের স্বার্থে এটা করতে হবে।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের যথার্থতা ও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না, জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা রাজনৈতিক বক্তব্য। বিজ্ঞানের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞান বলছে, বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে এবং মৃত্যুও হচ্ছে। ডব্লিউএইচও’র মতে, যেসব দেশগুলোতে করোনার সংক্রমণের হার বেশি, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সুতরাং আমাদের সংক্রমণ সারাদেশব্যাপী যে পর্যায়ে আছে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক কৌশল ও পরিকল্পনা দরকার। যেটা বাংলাদেশে প্রথম থেকেই ছিল না এবং এখনও নেই।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ভ্যাকসিন আসুক বা না আসুক কোভিড-১৯ বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই চলে যাবে। যেখানে পুরো পৃথিবী ভ্যাকসিনের জন্যে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে, সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনে করছেন ভ্যাকসিন ছাড়াই করোনা চলে যাবে। এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভ্যাকসিন প্রয়োজন কি না বা কতটুকু প্রয়োজন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘করোনা নিয়ন্ত্রণের দুটো উপায়। একটা হলো— ভ্যাকসিন। আরেকটা হলো— ডব্লিউএইচও’র নির্দেশনা ব্যক্তি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক, সব পর্যায়ে প্রয়োগ করা। এখন এই দুটোর ব্যাপারেই গুরুত্ব দিতে হবে। তবে, আমাদের মনে রাখতে হবে, আলটিমেটলি ভ্যাকসিনের কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদেরকে স্বাস্থ্যবিধিগুলো যেমন মানতে হবে, পাশাপাশি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য আমাদের যা করণীয়, সেটা করা উচিত। ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে বাংলাদেশে অনেক পিছিয়ে আছে।’

‘কেন পিছিয়ে আছে? এক্ষেত্রে প্রথম বিষয়ে হলো— আমরা নিজেরা ভ্যাকসিন নিয়ে কোনো গবেষণা করছি না। দ্বিতীয়ত— আমরা কোনো গবেষণার অংশীদারও হচ্ছি না। আর তৃতীয়ত হলো— ভ্যাকসিন পাওয়ার আর যে উপায় আছে, এর মধ্যে একটি হলো, দাতব্য সংস্থা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমুনাইজেশনের (গ্যাভি) মাধ্যমে বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন পাওয়া, আরেকটা হলো, ভ্যাকসিন কেনা এবং সেই জন্য যারা উৎপাদন করবে তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। অর্থাৎ, আমাদের যেসব ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আছে, এর মধ্যে যারা ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম, তাদের সঙ্গে যারা ভ্যাকসনি তৈরি করছে, তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া’, বলেন তিনি।

আমাদের এখানে চীনা কোম্পানির ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের কথা ছিল। কিন্তু, সেটা দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে আটকে আছে। সর্বশেষ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এই বিষয়ে ও অন্যান্য দেশ থেকে ভ্যাকসিন আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এতে দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ল কি না, করোনা মোকাবিলায় দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগ কতটুকু?— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিএমআরসি অ্যাথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স দিতে পারে যে, হ্যাঁ, এটা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেটা সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে তারা দিয়েছে। অনুমোদন দেওয়ার দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। এখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার কোনো কিছু নেই। এখানে প্রধানমন্ত্রী আসবেন কেন? এটাতো বৈজ্ঞানিক দিক দেখে ঔষধ প্রশাসন অনুমতি দেবে। এর উপরে কারো কাছে যাওয়ারও দরকার নেই। মন্ত্রীর কাছেও যাওয়ার দরকার নেই। এখানে মন্ত্রীর কী করার আছে? প্রধানমন্ত্রী তো পরের কথা। ঔধষ প্রশাসন তাদের গাইডলাইন অনুযায়ী অনুমতি দেবে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর তো কিছু করার নেই।’

দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেভাবে বাংলাদেশ এখন করোনা নিয়ন্ত্রণ করছে, এটা সঠিক কৌশল নয়। কারণ, বাংলাদেশ কোনো কৌশলই ঠিক করেনি। দ্বিতীয় হলো— যেভাবে চলছে এখন, এতে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ অনেক বেশিদিন থাকবে। দীর্ঘায়িত হবে।’

আরও পড়ুন:

করোনা এমনিতেই বাংলাদেশ থেকে চলে যাবে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ভ্যাকসিন আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে’

Comments

The Daily Star  | English

Uncovering the silent deaths of migrant women

In the shadows of booming remittance flows and the quiet resilience of Bangladesh’s labour diaspora, a disturbing reality persists: numerous Bangladeshi female migrant workers, particularly those employed as domestic help in Gulf countries, are returning home in coffins.

17h ago