আড়ালের সূর্য মওলানা আকরম খাঁ

মওলানা আকরম খাঁ (৭ জুন ১৮৬৮- ১৮ আগস্ট ১৯৬৮)| ছবি: সংগৃহীত

এক সময়ের বাঙালি মনীষী হিসেবে অবিভক্ত বাংলায় যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন— আজ তারা আড়াল হয়ে গেছেন। জনসাধারণের কাছে তেমন পরিচিত নন। তার জন্য সাধারণ মানুষ কখনো দায়ীও না। আপামর জনতা ভূমিকা রাখে হয়তো কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কে সিলেবাসে থাকবে কে থাকবে না। আর এমনটা হয় শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সমাজে উদার চিন্তায় কীর্তিমানদের জীবন ও কর্মের আলোচনা অপ্রতুলতার কারণে। এভাবেই অবহেলা আর অনাগ্রহে পড়ে আছেন উনিশ শতকের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা নাম না জানা বহু গুণীজন। অনেক সময় দেখা যায়— কেন তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, তার ঠিকঠাক কোনো যুক্তিও নেই।

এমনি একজন আড়ালের সূর্য মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক এবং ইসলামি পণ্ডিত। তিনি বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক পত্রিকা দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা এবং মাসিক মোহাম্মদী সম্পাদনা করেছেন। ১৯৩৬ সালে মুসলিম সমাজকে জাগানোর জন্যই দৈনিক আজাদের পথ চলা। ব্রিটিশ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরও পত্রিকা দুটির অস্তিত্ব ছিল। বলা যায়, তার সম্পাদিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে তিনি মুসলিম বাংলা সাংবাদিকতার একটা দীর্ঘস্থায়ী ভীত রচনায় সক্ষম হন।

অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানের ভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে আকরম খাঁর ভূমিকা তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের প্রেক্ষিতে ছিল ঐতিহাসিক। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভাষ্যে ‘কিংবদন্তির রাজা’ আকরম খাঁ ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতসহ কয়েকজনকে হত্যার প্রতিবাদে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। এবং তিনি প্রথম শহীদ মিনার আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করেন।

এইভাবে দেখা যায় শুধু বঙ্গীয় মুসলিম রেনেসাঁ নয়, বৃহত্তর বাঙালি চেতনা বিকাশেও তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তার রচিত মোস্তফা-চরিত যেমন মহানবী (স.)-এর বস্তুনিষ্ঠ জীবনী, তেমনি তার রচিত মোসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থটি সামাজিক ইতিহাস প্রণয়নে অন্যতম আকর গ্রন্থ হিসেবে প্রাসঙ্গিক থাকবে আগামীতেও।

মুসলিম লীগের নেতা হলেও নিজস্ব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকারের ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। পাকিস্তান হওয়ার পর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে মুসলিম লীগের নেতা হওয়ার পরও তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন। ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’য় লেখেন, ‘দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী? উর্দু না বাংলা? এই প্রশ্নটা তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলবে, না বেল? বঙ্গে মুসলিম ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় তাদের লেখ্য, কথ্য ও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইবে।’

মওলানা আকরম খাঁর মৃত্যুর পরদিন প্রকাশিত দৈনিক আজাদী পত্রিকায় তার স্মরণে বিশেষ আয়োজন। ছবি: সংগৃহীত

খ.

১৮৬৮ সালে ৭ জুন পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আকরম খাঁ। তার মা বেগম রাবেয়া খাতুন, বাবা গাজী মাওলানা আবদুল বারি খাঁ এবং পিতামহ তোরাব আলী খাঁ। তার পিতামহ ছিলেন সৈয়দ হাজী নিসার আলী তিতুমীরের সহযোদ্ধা। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ব্রাহ্মণ। ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে পনের শতকে ইসলাম গ্রহণ করেন।

১৮৬৯ সালে তার বয়স যখন এক বছর, তখন তার মাতা-পিতা মারা যান। বাল্যকালে একই দিনে কলেরায় বাবা-মার মৃত্যু হওয়ার পর নানীর কাছে তিনি মানুষ হন। তার লেখালেখির শুরু আকবার-ই-মোহাম্মদী পত্রিকার মাধ্যমে। সাংবাদিকতা শুরু করেন সাপ্তাহিক আহলে হাদীসে। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম থাকলেও খুব অল্প বয়সেই তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন এবং সফল হন। ‘ছাগল বিক্রয়লব্ধ দশ আনা পয়সা নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে হাকিমপুর হতে কলকাতায় আসেন। আশি বছর বয়সেও তার কর্মদক্ষতা দেখে বিস্মিত হয়েছি। ইংরেজিতে Entrepreneur বলে একটি শব্দ আছে। উদ্যোক্তা বললে তার ঠিক অর্থ হয় না। মওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন Entrepreneur। কুশাগ্র বুদ্ধি তো ছিলই।’ (আত্মস্মৃতি: আবু জাফর শামসুদ্দীন)

নিজ প্রচেষ্টায় ইংরাজিতে প্রচুর জ্ঞান অর্জন এবং বাংলা ভাষার একজন বলিষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। আর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আকরম খাঁ। ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ব্রিটিশবিরোধী আজাদি আন্দোলন, অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সম্মুখ সারির নেতা ছিলেন তিনি।

ফলে নানাবিধ কারণে তৎকালীন মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। দাবিদার ছিলেন সমাজ সংস্কারে কৃতিত্বের। মতভেদ থাকত তার চিন্তা নিয়েও। আহলে হাদীসে ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন একসময়। প্রখ্যাত ব্যাঙ্গ রচয়িতা সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের আয়না গল্পগ্রন্থের মধ্যে দুটি গল্প লিখেন। শিরোনাম রাখেন : ‘লিডরে কওম ও মুজাহেদিন’। গল্পদ্বয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন মাযহাবি দ্বন্দ্বকে ব্যঙ্গ করেছেন তিনি। ‘লিডরে কওমে চিত্রায়িত হয়েছে– হানাফি ও আহলে হাদিস দ্বন্দকে পুঁজি করে, একটা পত্রিকার মাধ্যমে ভণ্ড মৌলবির মানসিক বিকাশ!

প্রাবন্ধিক নূরুল আনাম মিঠুর বয়ান পাওয়া যায়। যার মতামতের নমুনা: জনৈক ইসমাইল সাহেব মাদরাসা ও স্কুল উভয় পরীক্ষায় বার বার ফেল করে বিধবা ফুফুর একমাত্র অবলম্বন ছাগলটি বিক্রি করে দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদে আশ্রয় নেন। এটি ছিল আহলে হাদিস গোষ্ঠীর। তিনি পূর্বে আহলে হাদিস বিরোধী হলেও এখানে এসে আহলে হাদিসপন্থী হয়ে যান। তথাকথিত হানাফিদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায় লিপ্ত হয়ে ধনাঢ্য হাজী পরিবারে উঠে আসেন এবং হাজী সাহেবকে বুঝিয়ে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতে সক্ষম হন। তথাকথিত হানাফি বিদ্বেষ ছড়াতে ছড়াতে এক সময়ে পত্রিকাটি ব্রিটিশ সরকারেরও সমালোচনা শুরু করে। পুলিশী হামলার ভয়ে অতঃপর হাজী সাহেব পত্রিকা অফিস স্থানান্তরের পরামর্শ দিলে ইসমাইল সাহেব অন্যত্র চলে গিয়ে পত্রিকার মাথায় লিখতে শুরু করেন ‘মওলানা মোহাম্মদ ইসমাইল প্রতিক্ষিত’। অতঃপর তিনি ‘আঞ্জুমান’ নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে হাজার হাজার টাকা চাঁদা তুলতে শুরু করেন। সেই টাকার হিসাব কোনোকালেও পাওয়া যায়নি। মওলানা এবার যোগ দেন খেলাফত আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেসে। পত্রিকার বেশ কাটতি হয় তার। এক সময় তিনি জেলে যান এবং ভগ্ন স্বাস্থ্যের অজুহাতে মুক্তিও পান। এরপর তিনি ইসলামী পুস্তক লেখার ঘোষণা দিয়ে অগ্রিম মূল্য পাঠানোর জন্য আবেদন জানান দেশবাসীর কাছে। এখানে ব্যঙ্গ গল্পটির সমাপ্তি।

গল্পটি যখন পাঠ করি তখন থেকেই মনে খানিকটা খটকা লেগে গিয়েছিল। তখনই কেন জানি মনে হয়েছিল এটা মওলানা আকরাম খাঁকেই নির্দেশ করছে। কেননা পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে সেই সময় আর তেমন কোন মুসলিম ব্যক্তিত্বের সন্ধান মেলে না। কিন্তু তখনও আমার জ্ঞান ছিল সীমাবদ্ধ। এছাড়া অন্যকোন সূত্র থেকে এর স্বপক্ষে কোন সমর্থন জানা ছিল না। কিন্তু আগেই উল্লিখিত অন্যান্য লেখকদের বক্তব্যে (আবুল মনসুর বাদে) এর সমর্থন পেতে শুরু করলাম এবং আবুল মনসুর আহমদের ব্যাঙ্গ রচনা নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তারাও প্রায় সবাই এর ঈসমাইল সাহেবকে মওলানা আকরম খাঁকেই শনাক্ত করেছেন।

এ সম্পর্কে প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক আবু জাফর শামসউদ্দিন তার ‘আত্মস্মৃতি’তে যা উল্লেখ করেছেন, তা অনেকটা অবিকল আবুল মনসুর আহমদের উল্লিখিত গল্পের সঙ্গে মিলে যায়।

আবু জাফর শামসউদ্দিনের তুলনায় আবুল মনসুর আহমদ ১০ বছরের বড় হওয়ায় কিছু অগ্রবর্তী তথ্য দিতে পেরেছেন। যেমন: তাবলীগ মিশনের নামে চাঁদা তোলা ও আত্মসাৎ এবং পরবর্তীতে নানান অজুহাতে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা।

তবে খেলাফত আন্দোলনে সম্পর্কিত বিষয়ে উভয়ের মধ্যেই মিল লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও আবু জাফর শামসুদ্দীন তার সুবিখ্যাত সুবৃহৎ ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ নামক উপন্যাসে আকবর খান নামে যে চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন তাও অবিকল মওলানা আকরম খাঁর সঙ্গে মিলে যায়।

গ.

১৮ আগস্ট ১৯৬৮ সালে বংশালের আহলে হাদিস মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন আকরম খাঁ। কিন্তু রেখে যান কীর্তিমান জীবন ও লিখিত গ্রন্থাদি। আর সাংবাদিকতার ইতিহাসের নিরিখে গবেষকরা দাবি করেন— মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক খাদেম, দৈনিক আজাদসহ আকরম খাঁ সম্পাদিত সংবাদপত্র নিয়ে আজকের সাংবাদিকদের যেমন অনুপুঙ্খ গবেষণা করা প্রয়োজন, তেমনি তার স্মৃতি রক্ষার্থে তার নামে স্মারক বক্তৃতাও চালু করা জরুরি। এছাড়া তার প্রজ্ঞামণ্ডিত রচনাবলীর নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ অত্যন্ত জরুরি।

প্রাসঙ্গিকভাবে মওলানা আকরম খাঁকে নিয়ে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ’র মত: ‘মওলানা আকরম খাঁ সাহেব বহু বিষয়ে আমাদের বাঙালি মুসলিম সমাজের অগ্রপথিক। পত্রিকা পরিচালনার ব্যাপারে তিনিই প্রথম হিন্দু সমাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।... কাগজে ছবি ছাপানো জায়েজ কি না-জায়েজ, এ নিয়ে যখন আমাদের আলেম সমাজে তুমুল তর্ক চলছিল, তখন তিনি ‘সমস্যা ও সমাধান’ লিখে এ তর্কের সমাধান করেন। ...কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু সংস্কৃতির লালন, বিকাশ, বিস্তারের জন্য যে ব্যাপক আয়োজন চলছিল, তার পাশে বাংলার মুসলমানের সংস্কৃতিকেও স্থান দিতে হবে, এ আন্দোলন মওলানা সাহেবই শুরু করেন বলে মনে পড়ে। বাংলার মুসলমানরা আরবি ও ফারসি ভাষার যেসব শব্দ তাদের কথায় হামেশা ব্যবহার করে থাকেন, সেই সব শব্দকে সাহিত্যে স্থান দেওয়ার জন্য মওলানা সাহেব যে প্রচার করেন, তা নিষ্ফল হয় নাই। ...এ দেশে বহু বিষয়ে মওলানা আকরম খাঁ একক।

বিশিষ্ট অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বাংলা একাডেমিতে এক বক্তব্যে বলেন, ‘বিভাগ পূর্বকালের বৃহৎ বাংলাকে বুঝতে হলে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে অনিবার্যভাবে স্মরণ করতে হবে।’

সর্বোপরি মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বঙ্গীয় মানুষের গভীরে প্রোথিত। তিনি যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠেছিলেন এবং বুক ফুলিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন, তা ইতিহাসে বিরল। তাই বলা যায়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, ততদিন মওলানা আকরম খাঁও প্রোজ্জ্বল আলোকবর্তিকাস্বরূপ থাকবেন আড়ালে আবডালে।

ইমরান মাহফুজ: কবি ও গবেষক।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
problems faced by Bangladeshi passport holders

The sorry state of our green passports

Bangladeshi passports are ranked among the weakest in the world.

7h ago