কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র: রক্ষকই যেখানে ভক্ষক

Joshore_Unnayan_Kendra.jpg
ছবি: সংগৃহীত

প্রায় ১৫ কিংবা ২০ বছর আগে রহিম নামে একটি ছেলের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে পরিচয় হয়েছিল। ছেলেটার বয়স তখন আনুমানিক ১৩ বা ১৪ বছর। সারা গায়ে লাল লাল দাগ। মুখটা দেখে কেন যেন খুব মায়া হয়েছিল। মনে হলো বাচ্চাটা ক্ষুধার্তও। নিজেই গিয়ে কথা বললাম। রহিম জানালো ও পালিয়ে এসেছে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে। বাবা-মা কেউ নেই। বস্তিতে খালার কাছে থাকতো। একবার বস্তিতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ রহিমকে আটক করে সংশোধনালয়ে পাঠায়।

যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে একটি গ্রুপ ছিল, যারা নিয়মিত ছোটদের মারধোর করতো। অভিযোগ করেও কাজ হতো না। পালিয়ে আসার দুদিন আগে রহিম ওদের হাতে মার খায়। তখনই সিদ্ধান্ত নেয়, আর কোনোদিন যাবে না। প্রয়োজনে হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাজ করবে। রহিমকে আমার পরিচিত একটি দোকানে কাজ দিয়েছিলাম। শুধু মায়া ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। রহিম এখনো কাজ করেই খাচ্ছে, যতদূর জানি।

প্রয়াত তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ সিনেমাটা দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল। আহা অবুঝ বাচ্চাগুলো কী ভয়াবহ নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছে। সিনেমাটা দেখে একবারও মনে হয়নি এ রকম নিপীড়নের শিকার কোনো বাচ্চার সঙ্গে আমার কখনো পরিচয় হবে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বেশ কিছু কিশোর শারীরিক নিপীড়ন ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে হোস্টেলে এবং এতিমখানায়।

এবার জানতে পারলাম যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ঘটনা। এই ঘটনা আলোর মুখ দেখলো এ জন্য যে, তিনটি কিশোর নিহত হয়েছে। তা না হলে এসব ঘটনা বাইরে প্রকাশ পেত না। সংশোধনাগারে যে শিশু-কিশোরদের রাখা হয়, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বন্দি শিশুগুলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের লোকজন যখন নিজেরাই অত্যাচারী হয়ে ওঠে, তখন তো বলতেই হয় রক্ষকই ভক্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও সমাজসেবা অধিদপ্তরের যশোরের উপপরিচালক ‘কিছুই জানতেন না’ দাবি করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা তার দায়িত্বহীনতারই নামান্তর। তিনি কোনোভাবেই এই দায় এড়াতে পারেন না। প্রশাসনের এই গোপনীয়তা ও জবাবদিহিতা না থাকার সংস্কৃতি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার রক্ষার সনদে প্রথমদিকে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। এই সনদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে— যেসব শিশু অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, তাদের সঙ্গে সদাসর্বদা এমন আচরণ করতে হবে যাতে শিশুর মর্যাদা রক্ষিত হয় এবং তারা যেন নিজেকে মূল্যবান ও মর্যাদাবান মনে করে। সেখানে আমরা তাদের পিটিয়ে হত্যা করছি। কারণ আমরা মনে করি, শিশুর ওপর নির্যাতন করা সহজ। শিশুরা প্রতিবাদ করতে পারে না। বিশেষ করে অপরাধে জড়িত অনাথ ও অসহায় শিশুদের অবস্থা আরও খারাপ। এদের কোনো অভিভাবক নেই, কাজেই এদের ওপর নির্য়াতন করাই যায়। খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট দেওয়াই যায়, মারতে মারতে মেরে ফেলাও যায়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এসব শিশু-কিশোরের অভিভাবক রাষ্ট্র নিজেই।

এর মধ্যে পত্র-পত্রিকায় মাঝেমাঝেই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, বিভিন্ন ছাত্রাবাসের শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কেউ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, কেউবা নিহত। এর মানে হোস্টেলে, হোমে বা এতিমখানায় অসহায় ছাত্রছাত্রীদের নির্যাতনের শিকার হওয়া নতুন কোনো ব্যাপার নয়। আমরা খবর দেখে সাময়িক হৈচৈ ও ক্ষোভ প্রকাশ করি কিন্তু পরে সব আবার আগের মতোই চলে।

বুয়েটে আবরারকে যে কায়দায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, তা শুনে আমাদের শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। দেশের মেধাবী ছাত্রদের এ রকম অমানবিক আচরণ দেখে দেশবাসী হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। বুয়েট প্রশাসন অপরাধী ছাত্রদের দোষত্রুটি ঢেকে তাদের শেল্টার দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ঘটনা যেন আরও ভয়াবহ মনে হলো। এই উন্নয়ন কেন্দ্র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসিয়ালি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন্দ্রের শিশুদের পিটিয়ে আহত করেছে এবং মেরেও ফেলেছে। এই পরিকল্পনা বৈঠকে উপস্থিত ছিল কেন্দ্রের ১৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী।

সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কেন্দ্রের প্রধান প্রহরীকে আঘাত করা কিশোরদের পেটাতে হবে অচেতন না হওয়া পর্যন্ত। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একে একে ১৮ কিশোরকে আবাসিক ভবন থেকে ধরে আনা হয়। এরপর তাদের দুই হাত জানালার গ্রিলের মধ্যে আটকে, পা বেঁধে ও মুখে গামছা গুঁজে দিয়ে রড এবং ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পেটানো হয়। এতে মারা যায় তিন কিশোর, গুরুতর আহত হয় ১৫ জন। সেদিন দুপুরে তাদের খেতেও দেওয়া হয়নি। সবই পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য।

দেশে এমন ঘটনা কি এটাই প্রথম? না। আড়ালে-আবডালে ঘটেই চলেছে। এবার ভয়াবহভাবে আমাদের সামনে এসেছে। যদি আমরা জানতে চাই কিশোর অপরাধের প্রতিকারে ‘কিশোর সংশোধনাগার’ কিংবা ‘শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র’গুলো কতটা কাজের? এ অভিযোগ নতুন নয় যে, এই কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ, প্রশিক্ষণ ও সেবা কার্যক্রম খুবই নিম্নমানের। আচরণ সংশোধনের চেয়ে বরং শিশুদের জেলখানার মতো আটকে রাখা হয়। শেখানো হয় না এমন কিছু, যা দিয়ে শিশুদের মননে, স্বভাবে-চিন্তায় আচরণে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসে। 

এখানে আচরণ পরিবর্তন করার বা শিশু-কিশোরদের সংশোধন করার কোনো পদ্ধতি আদৌ আছে কি না সেটাই খোঁজ করে দেখা দরকার। কারণ এসব স্কুলে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক দরকার, দরকার কাউন্সেলর, দরকার ডায়েটিশিয়ান, সৃজনশীল শিক্ষার জন্য আলাদা শিক্ষক। অথচ এর কিছুই পায় না তারা। ঠিক মতো খাওয়াও নাকি জোটে না। সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলরা যে এর ধারে কাছেও নেই— যশোরের ঘটনা সেই সাক্ষ্য বহণ করে। সামাজিক অবক্ষয়ের এসব কাহিনী আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। এর চেয়েও বড় কথা খুব অসহায়বোধ করছি। ভাবাই যায় না যে, সরকারি কর্মকর্তারা মিটিং করে অসহায়, দরিদ্র এবং আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় পাওয়া বাচ্চাগুলোকে পিটানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে কেমন করে!

সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই যদি নির্যাতন হয় অথবা এগুলোই যদি অপরাধের কেন্দ্র হয়, তাহলে বাকিদের অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। রাষ্ট্র কেন এই সংশোধনমূলক কেন্দ্র খুলেছে? কেন এর নাম আশ্রয়কেন্দ্র? সংশোধনমূলক বিচার ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত শিশু-কিশোরদের কারাগারে না রেখে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখার উদ্দেশ্য হলো, অভিযুক্তদের মানবিক উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসা। কারাগারে অন্য অপরাধীদের সঙ্গে থাকলে শিশুরা আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই এই সেফহোম-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সেই সেফহোমেই যদি নিপীড়ন-নির্যাতন চলে, তাহলে রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে এগুলো চালানোর মানে কী?

বেশ কয়েক বছর আগে খবরে দেখেছিলাম নারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে দুটি মেয়ে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এসব ঘটনার কথা বাইরে আসে না। মাঝেমাঝে কিছু এনজিও এসব নিয়ে কথা বলে বা তদন্ত করে। তবে সেটাও খুব সামান্য। গণমাধ্যমে বেশ কয়েকবার খবর বের হয়েছিল যে এসব কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে নানা ধরনের অনিয়ম, অত্যাচার চলে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানো হয়েছে এবং সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন কাজ হয় না। অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ভয়ের ও আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করলে এই শিশু-কিশোর-কিশোরীদের মানসিক কোনো উন্নতি হবে কি? যখন কোনো নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়, যখন কোনো শিশু অপরাধ করে ফেলে, তখন তাদের সেফহোম বা আশ্রয়কেন্দ্রে এমন করে রাখার বিধান যাতে এরা পূর্ণ মর্যাদায় সমাজে ফিরে আসতে পারে। সে কারণেই এসব হোমে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত, যেন সব সময় শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। চিকিৎসক ও মনোচিকিৎসক থাকা উচিত। কিছু কিছু ছোটখাটো কাজের ট্রেনিং সুবিধা থাকতে পারে। সঙ্গে গান-বাজনা প্রশিক্ষণও চলতে পারে। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা নিয়মিতভাবে থার্ড পার্টি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

দেশের কিশোর বা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার তো রয়েছেই। পাশাপাশি এগুলো অপরাধের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। শিশু অপরাধীদের সংশোধন করতে নেমে তারা নিজেরাই অপরাধ করছে। অথচ এসব জায়গায় যারা কাজ করবেন, তাদের হতে হবে মানবিক মানুষ।

লেখক: শাহানা হুদা রঞ্জনা

সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

US and China reach deal to slash tariffs

The two sides had reached a deal for a 90-day pause on measures and that reciprocal tariffs would come down by 115%.

9m ago