জাতীয় শোক দিবসে রাবির ম্যাগাজিন ‘আত্মপ্রচার সর্বস্ব ও ভুলে ভরা’
গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে প্রকাশনার প্রচলিত নিয়ম উপেক্ষা করে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রস্তুতি ছাড়া তড়িঘড়ি করে প্রকাশ করায় কোনো প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখা ম্যাগাজিনটিতে স্থান পায়নি। এতে ম্যাগাজিনটি ‘অত্যন্ত নিম্নমানের’ হয়েছে। ম্যাগাজিনটি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করার পরিবর্তে কর্তৃপক্ষের আত্মপ্রচারে পরিণত হয়েছে।
তারা আরও বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা তাদের ইচ্ছেমত নিজেদের লেখাগুলো কোনোরকম সম্পাদনা ছাড়াই বানান, লেখার রীতি ও তথ্যগত ভুল-ত্রুটিসহ প্রকাশ করেছেন। এতে করে একদিকে যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সম্মানের প্রতি আঘাত করা হয়েছে, একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু’ ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘প্রকাশনাটি ছাপতে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি।’
‘প্রতিটি লেখা ১০ বার করে পড়ে দেখা হয়েছে। উপাচার্য নিজেই একাধিকবার পড়েছেন। গত ১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় শোক দিবস উদযাপন কমিটির তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে প্রকাশনাটি ছাপা হয়েছে। সেখানে বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী বানান ও ভাষারীতি মেনে চলা হয়েছে। তারপরেও তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে কিছু ভুল হতেই পারে। সময়ের অভাবে এই প্রকাশনায় বাইরের কারো লেখা নেওয়া সম্ভব হয়নি। হাতে সময় নিয়ে পরবর্তীতে আবার যখন প্রকাশনা বের করা হবে, তখন অনেকের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করা হবে’, বলেন তিনি।
অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা আরও বলেন, ‘আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, ভাষায় পণ্ডিত নই। তাই বলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি কিছু লিখলে সেখানে দোষের কী আছে! সেটা যদি মানসম্পন্ন নাও হয়, পাঠকরা সেটি চিহ্নিত করবেন।’
তিনি জানান, ম্যাগাজিনটি মোট ৩০০ কপি ছাপানো হয়েছে। মূল ম্যাগাজিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রেস থেকে ছাপানো হয়েছে। কভার বাহিরের একটি প্রেস থেকে ছাপানো হয়েছে এবং এতে খরচ হয়েছে আনুমানিক ১৮ হাজার টাকা। ম্যাগাজিনের কপি বিভিন্ন বিভাগ, সরকারি অফিস, লাইব্রেরী ও মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রহশালায় পাঠানো হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি রেজিস্ট্রার আহমেদ শফিউদ্দিন বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা ও জনসংযোগ দপ্তরের প্রধান হিসেবে ৩০ বছর কাটিয়েছি এবং তিনশর অধিক প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।’
‘প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় যখন কোনো ম্যাগাজিন প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন একটি প্রকাশনা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সার্বিক পরিকল্পনা নির্ধারণ করে। একটি সম্পাদনা পর্ষদ গঠন করে দেশের বরেণ্য লেখকদের কাছ থেকে লেখা আহ্বান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লেখা চাওয়া হয়। সেগুলো যাচাই-বাছাই ও সম্পাদনা করে এক একটি প্রকাশনা বের করা হয়’, যোগ করেন তিনি।
আহমেদ শফিউদ্দিন বলেন, ‘এই প্রকাশনায় সেসব প্রচলিত নিয়ম মানা হয়নি, সেটি প্রকাশনা দেখেই বোঝা যায়।’
‘ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ নিম্নমানের, শৈল্পিক ছোঁয়া নেই। লোগোর পাশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় লেটারিং অরনামেন্টাল হওয়া ছেলেমানুষি। অফিসিয়াল প্রকাশনায় উচিত নয়। প্রচ্ছদ ফন্ট সবই একই পয়েন্টের, যা বিরক্তিকর। ভেতরে ফুলপেজ রঙিন ছবি অস্পষ্ট। স্কুলের বালকের মত কিছু লেখা। অন্যদের লেখা প্রায় হুবহু নিজেদের নামে ছাপানো হয়েছে, তবে দায় এড়াতে রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়েছে। লেখাগুলো না সৃজনশীল, না গবেষণামূলক, না স্মৃতিচারণমূলক। বানান, বাক্য ও শিরোনামেও ভুল আছে’, বলেন আহমেদ শফিউদ্দিন।
ম্যাগাজিনটির একটি কপি দ্য ডেইলি স্টার’র কাছে এসেছে। এতে ছয়টি লেখা স্থান পেয়েছে এবং সবগুলোই কর্তৃত্ব স্থানীয়দের লেখা। মূল্য ধরা হয়েছে ২৫ টাকা। সম্পাদকীয় পর্ষদ থাকলেও কোনো সম্পাদকীয় লেখা হয়নি। প্রকাশনাটি ছাপানোর কোনো পটভূমিরও বর্ণনা নেই।
এতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান ম্যাগাজিনটির পৃষ্ঠপোষক। তার লেখা ‘বাঙ্গালির একান্ত আপনজন অসাম্প্রদায়িক শেখ মুজিব’ শিরোনামে ম্যাগাজিনের প্রথমে স্থান পেয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক। তার দুটি লেখা ‘বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-দর্শন’ ও ‘বঙ্গবন্ধুর অন্তিম শয়ন’ শিরোনামে ছাপা হয়েছে।
ম্যাগাজিনের সম্পাদক হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া। তার একটি লেখা ‘বাংলাদেশে মুজিব আদর্শের পুনরুত্থান’ শিরোনামে ছাপা হয়েছে।
ম্যাগাজিনের সহযোগী সম্পাদক বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানিয়া তহমিনা সরকার। তার একটি লেখা ‘মানবতাবাদী বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে ছাপা হয়েছে।
সম্পাদনা পরিষদে নেই এমন ব্যক্তির শুধু একটি লেখা ছাপা হয়েছে। ‘মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে লিখেছেন মো. হাসিবুল আলম প্রধান। তিনি আইন বিভাগের অধ্যাপক ও শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক আবুল কাশেম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা কোনো ক্লাব বা স্কুল-কলেজের বা ছাত্রদের প্রকাশনার মত নয়, যেখানে দায়সারা গোছের কিছু হলেও কিছু আসে যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব অর্জন মুখ্য হতে হয়। যেটি শত শত বছর ধরে পঠিত হতে পারে এবং উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। প্রকাশিত ম্যাগাজিনের লেখাগুলোর সূচনা পড়ার পর আর পড়া এগোনো যায়নি, এতটাই মানহীন।’
তিনি বলেন, ‘ম্যাগাজিনে লেখার জন্য দেশবরেণ্য লেখকদের অনুরোধ করা যেত, অথবা তাদের পুরনো লেখা পুনরায় মুদ্রণও করা যেত। অনেক প্রথিতযশা লেখক ও বঙ্গবন্ধুর জীবনকাল নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়েই আছেন। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, গবেষক সনৎ কুমার সাহা এবং কবি জুলফিকার মতিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই বাস করেন। তাদের কাছ থেকেও লেখা নেওয়া হয়নি।’
যোগাযোগ করা হলে হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কোন ম্যাগাজিন বের করছে, সেটি আমি জানি না। আমার কাছে লেখাও চায়নি। প্রকাশিত ম্যাগাজিনটি আমি এখনো দেখিনি।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি স্মরণিকা প্রকাশ করেছে, তা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু প্রকাশনার মান আমাকে লজ্জিত করেছে। এখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখা নেই। একটা বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এই প্রকাশনা।’
তিনি বলেন, ‘পাঁচ জন লেখকের চার জনই প্রকাশনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। উপাচার্যসহ যাদের লেখা ছাপা হয়েছে, তাদের লেখাগুলোতে নতুন কিছু নেই। এই স্মরণিকা থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষণীয় কিছুই পাবে না। সব দায়সারা লেখা। লেখার মান নিম্নমানের ও লেখায় অজস্র বানান ভুল। উপাচার্যের লেখার শিরোনামের প্রথম শব্দটির বানানই ভুল। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে আধাপৃষ্ঠা। সেখানে নয়টি বানান ভুল। শেষ পৃষ্ঠায় রয়েছে ১৫টি ভুল বানান। এর চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় আর বলার দরকার নেই। বেশি খারাপ লেগেছে এই ভেবে, প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত আছেন বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষক। ধারণা করি, প্রকাশনাটি নির্ভুল করার দায়িত্ব তারই ছিল। তার নিজের লেখাটিও নির্ভুল নয়। একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এমন আত্মপ্রচার সর্বস্ব প্রকাশনা মোটেই কাম্য নয়। এখান থেকে নতুন প্রজন্মের কিছুই পাওয়ার নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ব্যবহার করে ব্যক্তিগত চর্চা করা হয়েছে। অনর্থক টাকাগুলো নষ্ট। বোঝাই যায় না লেখাগুলো কোনো গবেষকদের।’
Comments