গত ২ বছরে সারা দেশেই বেড়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘ক্রসফায়ার’
সম্প্রতি মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যুর পর সকলের মনোযোগ টেকনাফ পুলিশের দিকে। তার এই মৃত্যুর ঘটনাটি পুলিশ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হিসেবে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘শুটআউট’ এবং ‘ক্রসফায়ার’ এখন সারা দেশের সকল প্রান্তের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। ২০১৮ সালের মে মাসে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার পর এই সংখ্যা আকাশ ছুঁয়েছে।
পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)- এই তিন বাহিনীর সঙ্গে হয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’গুলো।
সারা দেশে বাংলাদেশ পুলিশের মোট থানা ৬৪৯টি, বিজিবি ব্যাটেলিয়ন ৬১টি এবং র্যাবের ব্যাটেলিয়ন রয়েছে ১৫টি। দ্য ডেইলি স্টারে ২০১৮ সালের ১ আগস্ট থেকে শুরু এ বছরের ১ আগস্ট পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় ‘ক্রসফায়ার’ নামক এই জাতীয় সংকটে সম্পৃক্ত রয়েছে এই তিন বাহিনীই।
গত দুই বছরে কক্সবাজারে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ১৮৪ জন। যার মধ্যে জেলার টেকনাফ পুলিশের হাতেই মৃত্যু হয়েছে ৮৭ জনের। টেকনাফ থানা বা কক্সবাজারে এমন মৃত্যুর যে সংখ্যা তার ধারের কাছেও নেই আর কোনো জেলা।
চট্টগ্রাম, ফেনী, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলার ১৬টি উপজেলা নিয়ে কাজ করে র্যাব-৭। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে চলতি মাস পর্যন্ত দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এই চার জেলায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন ৬৮ জন। যার মধ্যে শুধু র্যাব-৭ এর সঙ্গেই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়েছে ৩১টি।
এসব ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সম্পর্কে র্যাব-৭ এর বক্তব্য ছিল প্রায় একইরকম। তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে যে অপরাধীরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হয়েছে এবং সেখানে পৌঁছলে অপরাধীরা র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি করে। আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায় র্যাবও।
এর মধ্যে কয়েকটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতদের সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ডেইলি স্টার। খবর সংগ্রহের সময় পুলিশের এই এলিট ফোর্সের দেওয়া ব্যাখ্যার সঙ্গে মেলেনি মৃতের পরিবারের দেওয়া তথ্য। পরিবারের দাবি ছিল, আগেই তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাড়ি থেকে।
একটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনা পাওয়া যায় প্রমাণসহ। চলতি বছর ১২ জানুয়ারি রাজধানীর মালিবাগ বাস কাউন্টারগুলোর সামনে র্যাব-২ এর সঙ্গে এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান সৈয়দ ইকবাল আহমেদ (৪২)। ঘটনাটি ঘটে সকাল ৭টার দিকে। ঐ এলাকার বিভিন্ন দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পরে পুরো ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনাটি। দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাতকারে সেসব দোকানে মালিকরা জানান, র্যাব কর্মকর্তারা এসে সেসব ফুটেজ ডিলিট করে দিয়ে গেছে এবং কাউকে দেখতেও দেননি সেখানে কি ছিল।
কেন এটা করা হলো? জানতে চাইলে কোম্পানি কমান্ডার বলেন যে তারা তদন্তের জন্য দোকানগুলো থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন।
দ্য ডেইলি স্টারের খবরে অনুযায়ী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এবং সুন্দরবনের আশেপাশের এলাকায় গত দুই বছরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অন্তত ৪৬ জন মারা গেছেন। যার বেশিরভাগই হয়েছে র্যাব-৬ এবং র্যাব-৮ এর সঙ্গে।
প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধই হয়েছে রাতে এবং সাধারণত সুন্দরবনের কোনো খালের পাশে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, গত বছর ১ অক্টোবর ভোররাত ২টায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান ২৬ বছর বয়সী মনীশ সাহা ও আরও তিন জন। এই ঘটনার বিবরণেও র্যাব-৬ এর কোম্পানি কমান্ডার তোফাজ্জল হোসেনের বক্তব্য ছিল পরিচিত।
তবে ব্যতিক্রম হিসেবে গণমাধ্যমে কথা বলেন নিহত মনীশের ভাই মিঠুন। সে সময় মিঠুন দাবি করেন, ‘গত ১ অক্টোবর সাদা পোশাকের কয়েকজন নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে খুলনার রূপসা উপজেলার আইচগতিতে আমাদের বাসভবন থেকে আমার ভাইকে তুলে নিয়ে যায়। ১০ অক্টোবর আমরা র্যাব-৬ কে বিষয়টি জানাই। তারপর আমরা জানতে পারি যে ডাকাতির ঘটনায় সুন্দরবনে তার মৃত্যু হয়েছে। অথচ, আমার ভাই ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।’
র্যাব যখন বন্দুকযুদ্ধে অপরাধীদের গুলির শিকার হয়ে পাল্টা গুলি ছুড়ছে, তখন সাতক্ষীরা সদর থানায় ঘটছে ভিন্ন ঘটনা। এই থানার অধীনে থাকা এলাকায় কমপক্ষে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে প্রতিপক্ষের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনায়।
বিভিন্ন সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাবি করে, তাদের সদস্যরাও আহত হয়েছেন বন্দুকযুদ্ধে। দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে এসব দাবি কখনও যাচাই করা হয়নি। তারা কিভাবে এবং কতটা আঘাত পেয়েছেন সে সম্পর্কে কখন বিস্তারিত বিবরণ দেয়নি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।
এই দুই বছরে যেখানে প্রায় প্রতিদিন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ‘অপরাধীরা’ মারা গেছেন, সেখানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হতাহত হওয়ার সংখ্যা বেশ অস্বাভাবিক।
এই সময়ের মধ্যে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত সংবাদ থেকে দেখা যায়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্র একজন মারা গেছেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনায়। গত বছর ২৬ জুন যশোরের বেনাপোলে মাদক চোরাকারবারিদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গুরুতর ভাবে আহত হন বিজিবি ব্যাটালিয়ন-২১ এর ৪৫ বছর বয়সী হাবিলদার আকমল হোসেন। রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
কক্সবাজার সফরকালে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ মো. খানের মৃত্যুকে ‘একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছেন পুলিশ প্রধান ও সেনাপ্রধান।
যদিও সারা দেশে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হওয়া মৃত্যুর সংখ্যা তা বলে না।
সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে ‘Crossfires’, ‘Gunfights’ in Last 2 yrs: Body count high, not just in Teknaf
Comments