সাতক্ষীরায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তিনমাস পরও সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভেঙে যাওয়া অধিকাংশ বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় এবং সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে জোয়ার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিতে ভাসছে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ও শ্রীউলা, আনুলিয়া ও সদর ইউনিয়ন এবং শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশাশুনির প্রতাপনগর ও শ্রীউলা।
অন্যদিকে, খুলনার কয়রা উপজেলার ১০টি এবং পাইকগাছা উপজেলার পাঁচটি গ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। কয়রার ৬টি গ্রাম আম্পানের পর থেকেই পানির নিচে আছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, খোলপেটুয়া নদীর ভেঙে যাওয়া পাউবোর বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের মধ্যে ২০টি গ্রামের উপর দিয়ে জোয়ার-ভাটা চলছে আম্পানের পর দিন থেকে। গত দুই দিন এই পানি আরও দুই ফুটের বেশি উচ্চতায় প্রবেশ করছে। প্রতাপনগর ইউনিয়নের ১৮টি গ্রামের মধ্যে তিনটি গ্রাম ছাড়া অন্যসবগুলো পানির তলে।
প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পানে নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া বেড়ীবাঁধ সংস্কার শেষ হতে না হতেই ফের বাঁধ ভেঙে সব ভেসে গেছে। আমার ইউনিয়নের ১৮ গ্রামের মধ্যে প্রতাপনগর, কামালকাটি, সোনতনকাটি, কল্যাণপুর, নাকলা, কুড়িকাউনিয়াসহ ১৫টি গ্রমের উপর দিয়ে জোয়ার-ভাটা চলছে গত তিনমাস ধরে, সেই আম্পানের দিন থেকে। এই মুহূর্তে কোনো মানুষ মরে গেলে তার দাফন করার মত জায়গাও নেই। খাবার পানি তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। পানির তোড়ে এলজিইডির পাকা সড়ক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উপজেলা সদরসহ পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘বরাদ্দ থাকার পরও যথা সময়ে কাজ না করায় এলাকার বেড়িবাঁধ বারবার ভাঙছে।’
শ্রীউলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের নাছিমাবাদ, থানাঘাটা, কাঁকড়াবুনিয়া, মহিষকুড়, কলিমাখালি, নাঙ্গলদাড়িয়া, হাজরাখালি, মাড়িয়ালাসহ ২টি গ্রামের ২৫-২৬ হাজার মানুষ গত তিনমাস ধরে পানিবন্দি। চিংড়ি ঘের, বসতবাড়ি, বিল সব একাকার হয়ে গেছে। মানুষ অমানবিকভাবে জীবনযাপন করছেন। খাবার পানির আধারগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে।’
কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীতে জোয়ার শুরু হলে প্রবল বেগে ভাঙা স্থান দিয়ে পানি ঢুকে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বিকেল ৫টার পরে ভাটার টানে কিছুটা পানি সরে গেলেও বসবাসের মতো পরিবেশ নেই। চারিদিকে পানি আর পানি। মানুষের কষ্টের যেন শেষ নেই।
প্রতাপনগর গ্রামের আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে চাচাতো ভাই আব্দুস সালাম মারা গেছে। তার দাফনের জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গা ইউনিয়নের কোথায় না পেয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে খাজরা খেয়া ঘাটে দাফন করেছি। একইভাবে প্রতাপনগর গ্রামের বাহার মাস্টার সাতক্ষীরা সিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন বৃহস্পতিবার রাতে। দাফনের জায়গা না থাকায় তাকে শহরের রসুলপুরস্থ সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।’
প্রতাপনগর ইউনিয়ন জলোচ্ছাসে ইউনিয়নের গড়ইমহল কালভার্ট সংলগ্ন প্রধান পিচ ঢালা রাস্তা ভেঙে গেছে। কল্যাণপুর ক্লিনিক মোড় থেকে তালতলা বাজার পর্যন্ত সকল রাস্তা ছাঁপিয়ে জোয়ারের পানি সকল জায়গায় প্রবেশ করেছে। পুরো ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে ইউনিয়ন সদরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে টানা বৃষ্টির সঙ্গে নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩-৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতাপনগর ইউনিয়নের কোলা ও হরিষখালী এলাকার নতুন নির্মিত বিকল্প রিংবাঁধ ভেঙে এবং চাকলা, কুড়িকাউনিয়া ও শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজরাখালী পূর্বের ভাঙন পয়েন্টে দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২০ মে অম্পানের আঘাতে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্রীউলা, আনুলিয়া, খাজরা এবং শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ ও কাশিমাড়ী ইউনিয়নের কয়েকটি বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েন এসব এলাকার মানুষ। অথচ, অম্পানের ৩ মাস অতিবাহিত হলেও সে সব স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে রিংবাঁধ দেওয়া হলেও গত দুই দিনের প্রবল বর্ষণে রিংবাঁধগুলো ভেঙে ফের প্লাবিত হয় এসব এলাকা।
এ বিষয়ে আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মীর আলিফ রেজা বলেন, ‘উপজেলার বানভাসি মানুষের জন্য জেলা প্রশাসক ২৫ মে. টন চাল বরাদ্দ দিয়েছেন। পানিবন্দি মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দ্রুত বেড়িবাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা হয়েছে। ইতোমধ্যে হাজরাখালীতে প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পূর্বেই বৃষ্টির কারণে তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তারা বলছেন নভেম্বর আগে আর সেখানে বাধ নির্মাণ সম্ভব না।’
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, ‘নিম্নচাপের প্রভাবে জোয়ারের উচ্চতা বেশি হওয়ায় রিংবাঁধগুলো ভেঙে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আমার দ্রুত পানিবন্দি মানুষদের রক্ষার জন্য আগামীকাল একটি পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করবো।’
জোয়ারের পানির চাপে খুলনার কয়রা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের অন্তত ৮টি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে দশটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি গ্রাম আইলার দিন থেকে পানির নিচে। গত বুধবারে কপোতাক্ষের পানির চাপে কয়রার ঘাটাখালি এলাকা ভেঙে কাজীপাড়া, হরিণখোলা, কাশির হাটখোলা, ঘাটাখালি, কাটমরচর, হাজতখালিসহ দশটি গ্রাম তলিয়ে যায়। এখনো সেখানকার মানুষ পানিবন্দি।
শিবসা নদীর বাঁধ ভেঙে পাইকগাছা উপজেলার পাঁচটি গ্রাম তলিয়ে যায়।
খুলনা-৬ আসনের (পাইকগাছা-কয়রা উপজেলা নিয়ে গঠিত) সংসদ সদস্য আকতারুজ্জামান বাবু বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বেড়িবাঁধ খারাপ ছিলো। এখন বর্তমানে ৫৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের খুব খারাপ অবস্থা । সরকার ইতোমধ্যে ৯৫৭.৩৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছে কয়রায় বেড়িবাধ উন্নয়নে। এই কাজ করলে সমস্যার সমাধান হবে।’
ঘূর্ণিঝড় আইলায় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ উপকূলের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৫৯৭ কিলোমিটার বাঁধ পানির তোড়ে ভেসে যায়। উপকূলের মানুষের দাবি ছিল, টেকসই বেড়িবাঁধ। ২০০৯ সালে আইলার পর ১০ বছরেও তা নির্মিত হয়নি।
Comments