‘নির্যাতন করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা যায় না’
আজ ২৪ অগাস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) পালিত হচ্ছে ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতন দিবস।
১৩ বছর আগে ২০০৭ সালের এই দিনে রাবির আট শিক্ষক, এক কর্মকর্তা ও ১০ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এই ঘটনা তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
করোনা পরিস্থিতিতে দিবস পালনে কোনো কর্মসূচী নেওয়া হয়নি। তবে সামাজিক মাধ্যমে দিবস উপলক্ষে চলছে আলোচনা। আলোচনায় বলা হচ্ছে, ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতা যে দীর্ঘায়িত করা যায় না তার একটা উদাহরণ হয়ে আছে এই দিবস।’
কী ঘটেছিল সেদিন? কিসের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটেছিল? পরিণতি বা কী হয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সেই আট শিক্ষকের একজন অধ্যাপক ও নাট্যকার মলয় ভৌমিকের সঙ্গে।
মলয় ভৌমিক ১৪ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরেন ১৯৭১ এর ১০ ডিসেম্বর। কাকতালীয় হলেও ২০০৭ সালের নির্যাতন ভোগের পর আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অন্যান্য সহকর্মীর সঙ্গে তার মুক্তি হয় ১০ ডিসেম্বর তারিখেই।
মলয় ভৌমিক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৭ এর জুলাইয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকরা জরুরি অবস্থার মধ্যে প্রতিবাদ করার এক অভিনব পন্থা খুঁজে বের করেন। তারা এক সঙ্গে ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে শিক্ষকরা গণছুটিতে গেছেন বলে প্রচার করেন। ছাত্ররাও ক্লাস বর্জন শুরু করে।’
‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার নানাভাবে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনার গ্রেপ্তার সে প্রক্রিয়ার একটি অংশ ছিল। সেজন্য প্রতিবাদ প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু, জরুরি অবস্থায় সভা-মিছিল বন্ধ ছিল। অতীতে সব আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। কাজেই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও সচেষ্ট ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো আন্দোলন যাতে তৈরি না হয়। শিক্ষকরা গণছুটি নেওয়ায় কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে।’
‘আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও। আগস্টের ২১ তারিখে শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে মৌন মিছিল বের করেন। পরদিন ও ২৩ তারিখে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন উস্কানির পরিপ্রেক্ষিতে সহিংস ঘটনা ঘটে। তখন ডিজিএফআইয়ের একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এসব ঘটনায় কোনো ছাত্র-শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা কখনই কোনো আদালতে প্রমাণিত হয়নি। ধারণা করা হয় আন্দোলনরত ছাত্র-শিক্ষকদের দমাতে কৌশলগত কারণে সহিংসতা ছড়ানো হয়েছিল। কারণ, আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ।’
‘টেলিভিশনে তৎকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্য থেকে ধারণা নিয়ে আমি আমার সহকর্মীদের সতর্ক করে দেই,’ যোগ করেন অধ্যাপক ভৌমিক।
‘২৪ আগস্ট ভোররাত ১টায় রাবির প্রগতিশীল শিক্ষকদের আহবায়ক অধ্যাপক আব্দুস সোবহানের বাসা ঘিরে ফেলে সেনা নেতৃত্বের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভোররাত ৩টায় তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই আবাসিক এলাকা বিহাস থেকে অধ্যাপক সাইদুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
‘আগের দিন আমার ঘোড়ামারার বাড়িতে রেইড দেওয়া হয়। কিন্তু, আমি অসুস্থার কারণে বেশ কয়েকদিন ধরে ক্যাম্পাসেই বোনের বাসায় ছিলাম। কারণ আমার স্ত্রী ও মেয়ে ঢাকায় ছিল, আমাকে দেখার কেউ ছিল না।’
‘আমাকে খোঁজাখুজি করেছে। তারা জেনেছে আমার বাড়িওয়ালাকে আমি আমার অবস্থান জানিয়ে রাখি। ২৪ আগস্ট বিকেলে আমার বোনের বাসা ঘিরে ফেলে। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর আমাকে একটি গাড়িতে করে সাধারণ মানুষের মতোই ক্যাম্পাসের বাইরে তৎকালীন শ্যামপুরস্থ র্যাবের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। চোখ কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়।’
‘পরদিন আমাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। সেখানে আমি খেয়াল করেছি র্যাবের পুলিশ সদস্যরা আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। সেনা সদস্যরাই খারাপ ব্যবহার করেছিলেন। আমাকে ইলেকট্রিক শক পর্যন্ত দিয়েছে।’
‘পরদিন সন্ধ্যায় আমাদের তিন জনকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। রাতে আদালত বসানো হয়। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তিনটি: এক গণছুটি নেওয়া, মৌন মিছিল করা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া। আমাদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন নুরুল ইসলাম সরকার আসলাম। তার কথা যথাযথভাবে না শুনেই আদালত আমাদের বিরুদ্ধে ১০ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করে।’
‘একই মামলায় অভিযুক্ত করা হয় সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের আরও তিন শিক্ষককে। তারা হলেন দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস, সেলিম রেজা নিউটন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন। তারা পরে আত্মসমর্পণ করেন।’
‘আরও একটি পৃথক মামলা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান সজল ও গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার সাদিকুল ইসলাম ও ১০ ছাত্রের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ডিজিএফআইয়ের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার। তারাও আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।’
‘আদালত থেকেই আমাদেরকে মতিহার থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিন দিন রেখে ঢাকায় কচুক্ষেত ক্যান্টনমেন্টের টাস্কফোর্স ইনটারোগেশন সেলে নেওয়া হয়। অভুক্ত রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। দুদিন পর রাজশাহীতে আনা হয়। অন্য সব শিক্ষককেও সেখানে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।’
‘আমাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্র-শিক্ষকের পাশাপাশি সাধারণ জনতাও বিক্ষুব্ধ হন। কিন্তু, তড়িঘড়ি করে আমাদের বিরুদ্ধে চাজশিট দিয়ে বিচারও শুরু হয়। বিচারে সাইদুর রহমান ও আব্দুস সোবহান মুক্তি পান তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার কারণে।’
‘দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস, সেলিম রেজা নিউটন, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও আমাকে মিছিল করার অভিযোগে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।’
‘কিন্তু, ততক্ষণে জনতার চাপে শিক্ষকদের মুক্তি দেওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করে সরকারি সংস্থাগুলো। সরকারের কাছে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইতে সংস্থাগুলো শিক্ষকদের পরিবারের ওপরও চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু, কেউই এই চাপে নতি স্বীকার করেননি। পরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নিজের ক্ষমতাবলে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে চার শিক্ষককে মুক্ত করে দেন। অন্যান্য শিক্ষকরা পর্যায়ক্রমে অভিযোগ থেকে মুক্তি পান।’
‘আন্দোলন বেগবান হয়। পরে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।’
Comments