রোহিঙ্গা সংকট

ন্যায়বিচারের এ পথ শেষ হওয়ার নয়

আইসিজের আদেশ আশা জাগালেও অগ্রগতি খুবই সামান্য
প্রতিকী ছবি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এখনো বসবাসকারী ছয় লাখ রোহিঙ্গার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে উঠছে। আইন বিশেষজ্ঞ এবং রোহিঙ্গা মানবাধিকার কর্মীদের মতে এটা স্পষ্টতই গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশকে বিদ্রূপ করারই নামান্তর।

তাদের মতে, রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলাটি জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে থাকায় তা উচ্চ প্রত্যাশা তৈরি করছে। তবে তাদের ন্যায়বিচার পেতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। সেই ন্যায়বিচার পাওয়া নির্ভর করবে ব্যবসায়িক স্বার্থ ও ভূ-রাজনীতিতে বিভক্ত বৈশ্বিক শক্তির উপর।

চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি আইসিজে গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন। রাখাইন রাজ্যের ছয় লাখ রোহিঙ্গা গণহত্যার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন উল্লেখ করে মিয়ানমারকে গণহত্যা রোধ করতে, প্রমাণাদি ধ্বংস করা বন্ধ করতে এবং এ বিষয়ে চার মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এরপর প্রতি ছয় মাস পর পর রিপোর্ট পেশ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের নভেম্বরে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসির) সহায়তায় গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলা দায়ের করলে তার শুনানির পর এই প্রাথমিক রায় আসে। গাম্বিয়ার অভিযোগে বলা হয়, প্রায় সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার ওপর নৃশংস সামরিক অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিয়ে, হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা, আহত ও নারীদের ধর্ষণ করেছে মিয়ানমার।

মিয়ানমার কয়েক দশক আগেই গণহত্যা নীতি গ্রহণ করেছিল। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দিয়ে এবং বৈষম্যমূলক নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিবাহ, জন্ম, সম্পত্তির অধিকার ও আন্দোলনের স্বাধীনতাসহ সব কিছু থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়। নৃশংস সামরিক অভিযানের মুখোমুখি হয়ে ১৯৮০-এর দশক থেকে তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন।

আইসিজের আদেশ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের আশা দিয়েছে। কিন্তু আদেশের ছয় মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এর কোনো অগ্রগতি নেই।

ফ্রি রোহিঙ্গা জোটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নায় সান লুইন বলেন, ‘বরং রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন ও বিদ্বেষ ছড়ানো অব্যাহত রয়েছে।’

তিনি জানান, আগামী নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছে মিয়ানমার। তবে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত দেশের সকল মৌলিক অধিকার ভোগ করলেও এখন রোহিঙ্গারা তা পাচ্ছে না। এবারের নির্বাচনে একজন ছাড়া বাকি সকল রোহিঙ্গা প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যাকে বৈধতা দিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘর্ষকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে দেশটি।

তিনি বলেন, ‘দুঃখের বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এর বিরুদ্ধে কথা বলছে না।’

লুইনের এই বক্তব্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে মিলে যায়। সংস্থাটি বলেছে, সেনাবাহিনীর এয়ার ও আর্টিলারি হামলায় কয়েক শতাধিক জাতিগত রাখাইন এবং কয়েক ডজন রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছেন। রাখাইন রাজ্য জুড়ে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার বেসামরিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেছেন যে এই হামলাকে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে পরিগণিত করা যায়। এ বিষয়ে তিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের আহ্বান জানান।

এইচআরডব্লিউ-এর আন্তর্জাতিক বিচার কার্যক্রমের সহযোগী পরিচালক পরম-প্রীত সিং গত ২৩ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছেন, গণহত্যা রোধ করার অর্থ শুধুমাত্র নতুন করে সহিংসতা বন্ধ করা না।

তিনি জানান, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ত্রাণ সহযোগিতা, চলাফেরা, গণমাধ্যম এবং ইন্টারনেটে ব্যবহারের ওপর নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। রাখাইনের ১৭টি শহরের মধ্যে আটটিতে মানবিক সহযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। খাদ্য, ওষুধ এবং বাসস্থানের সংকটে রয়েছে সেখানকার বাসিন্দারা। এটি ইঙ্গিত করে যে মিয়ানমার এই গোষ্ঠীটিকে পুরো কিংবা অংশিকভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেছেন, ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের কার্যকরভাবে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পেতে বাধা তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আইন সংশোধন করতে মিয়ানমার একটুও চেষ্টা করেনি।

আইসিজেকে মিয়ানমারের প্রথম প্রতিবেদন

আইসিজের আদেশ অনুযায়ী, গত ২৩ মে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের গণহত্যা থেকে বাঁচাতে মিয়ানমার কী করেছে, সে বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আদালতে। আইসিজে এখনও এটি প্রকাশ করেনি।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে পাঠানো হবে। ২০১৭ সালে প্রচেষ্টার পরও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে নিরাপত্তা কাউন্সিল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো দৃঢ় ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তখন নিজেদের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা ব্যবহার করেছিল চীন ও রাশিয়া।

আইসিজেতে প্রথম প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে মিয়ানমার রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা জারি করেছে, যাতে সেনা কর্মকর্তারা গণহত্যা না করে, রাখাইনে হওয়া ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ মুছে ফেলা না হয় এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্য না ছড়ানো হয়।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা যুব সমিতির নির্বাহী পরিচালক খিন মং বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার শুধু এটুকুই করেছে, এছাড়া আর কিছুই না।’

গণহত্যা গবেষক মফিদুল হক জানান, মিয়ানমারের উদ্দেশ্য ছিল স্বীকৃতি না দেওয়া রাখাইনের পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে, আইসিজের রায় বিশ্বব্যাপী তাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে, যা একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।

কানাডা ও নেদারল্যান্ডস ছাড়া গাম্বিয়াকে সমর্থন করেনি আর কোনো দেশ। যুক্তরাজ্য আইসিজের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারকে আইসিজের আদেশ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বড় শক্তিগুলো গাম্বিয়ার মামলাটি সমর্থন করা থেকে বিরত থেকে মানবিক সহায়তার দিকে মনোনিবেশ করছে।

তিনি জানান, আইসিজের রায় মেনে চলা বাধ্যতামূলক। তবে তা প্রয়োগ নিশ্চিত করা নির্ভর করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপর। তবে ভেটো শক্তি হিসাবে চীন ও রাশিয়া রোহিঙ্গাদের বিরোধিতা করার কারণে এ সমস্যা সমাধানে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক চাপ অপরিহার্য।

মফিদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এভাবে চলতে পারে না। গাম্বিয়ার মামলায় সমর্থন দেওয়া এবং মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের অধিকার পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে বিশ্বের নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

BGMEA wants 3-month window from India to clear pending shipments

The association urges the interim government to send a letter to India seeking the opportunity

5h ago