প্রবাসে

আমার দেখা জাপান

পাহাড় আর সাগরের অপূর্ব সমন্বয়ের দেশ জাপান। জাপানের পথে চলতে চলতে যে জিনিসটা অনেক বেশি মনে হয় তা হচ্ছে এই দেশটা সম্ভবত কখনই সমতল ছিল না। প্রায় প্রতিটা শহরের পাশেই পাহাড় আর সমুদ্র চোখে পড়ে। বেশিরভাগ হাইওয়ে পাহাড়ের ভেতরে কোন না কোনভাবে টানেলের ভেতর দিয়ে গেছে। গত বছরের অক্টোবরে জাপানের ছোট্ট শহর তত্তরি-তে আসি পিএইচডি স্টুডেন্ট হিসেবে। ভার্সিটিতে আমিসহ বাংলাদেশি ছাত্রের সংখ্যা ছয় জন ছিলাম আর শহরে দশ জন। এদের মাঝে একজনের চাকরি হয়ে যাবার পর ওসাকায় চলে গেছে আরেকজন যাবার অপেক্ষায় আছে।
কোয়ামা লেক, তত্তরি, জাপান। ছবি: লেখক

পাহাড় আর সাগরের অপূর্ব সমন্বয়ের দেশ জাপান। জাপানের পথে চলতে চলতে যে জিনিসটা অনেক বেশি মনে হয় তা হচ্ছে এই দেশটা সম্ভবত কখনই সমতল ছিল না। প্রায় প্রতিটা শহরের পাশেই পাহাড় আর সমুদ্র চোখে পড়ে। বেশিরভাগ হাইওয়ে পাহাড়ের ভেতরে কোন না কোনভাবে টানেলের ভেতর দিয়ে গেছে। গত বছরের অক্টোবরে জাপানের ছোট্ট শহর তত্তরি-তে আসি পিএইচডি স্টুডেন্ট হিসেবে। ভার্সিটিতে আমিসহ বাংলাদেশি ছাত্রের সংখ্যা ছয় জন ছিলাম আর শহরে দশ জন। এদের মাঝে একজনের চাকরি হয়ে যাবার পর ওসাকায় চলে গেছে আরেকজন যাবার অপেক্ষায় আছে।

জাতি হিসেবে জাপানিজদের কথা বলতে গেলে এককথায় যেটা বলা যায় সেটা হচ্ছে অমায়িক। এদের অনেক গুণকে একসাথে সহজে এভাবে বলা ছাড়া প্রকাশ করা কঠিন। প্রথমত এরা প্রচণ্ড রকম হেল্পফুল। এখানে আসার আগে ভেবেছিলাম কেমন হবে পরিবেশ, কেমন হবে প্রফেসর আর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র আমাদের দেশে কতোটুকু রিসার্চের সুযোগ পায় সেটাও কমবেশি সবাই জানেন। কাজেই চিন্তা অনেক বেশি ছিল। প্রফেসরের সরল হাসিমুখ দেখে চিন্তা অনেকটাই কমে গিয়েছিল প্রথম দিনেই। ছাত্ররা শুরুতে হাতে ধরে কাজ শেখানোর মতো করে কাজ শিখিয়েছে। প্রফেসর এর কাছে যেতেও ভাবতে হয় না। যে কোনো বিষয়ে সাহায্য পাওয়া যায়। জাপানে ভার্সিটির শিক্ষকেরা সবচেয়ে বেশি মর্যাদা পাওয়া ব্যক্তি। কিন্তু আমার মতো একজন সাধারণ ছাত্র ডরমিটরি থেকে সরে যাওয়ার পর কোথায় থাকবে সেটাও এদের মাথায় থাকে। আমি খুবই অবাক হলাম যখন জানতে পারলাম যে সেপ্টেম্বরে আমাকে আমার ডরমিটরি ছেড়ে দিয়ে কোন বাসায় যাবো প্রফেসর সেটাও ঠিক করে দিয়েছেন।

জাপানিজদের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কথা দেশে থাকতে অনেক শুনেছি। এখানে আসার পর যতোটা বুঝেছি সেটা হচ্ছে এদের শহর পরিস্কার কারণ তারা ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকেই এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। রবিবারে দেখা যায় তুলনামূলকভাবে বয়স্ক ব্যক্তিরা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে অলি-গলি পার্ক আর রাস্তা পরিস্কার করছে। দুপুরে সাধারণত একসঙ্গে বসে লাঞ্চ করে পিকনিকের আমেজ নিয়ে।

জাপানিজদের অন্যতম প্রধান গুণ হচ্ছে এরা সময়ানুবর্তী। আমি যদি প্রতিদিন একই সময়ে বের হয়ে একই রাস্তা দিয়ে ভার্সিটিতে আসি তাহলে একই ব্যক্তিদের সাথে একই জায়গায় দেখা হবার সম্ভাবনা প্রায় নব্বই ভাগ। আমি ল্যাবে আসতে কখনো আগে আসি, কখনও দেরিও হয়। কিন্তু প্রফেসর বা অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের বেলায় এটা হতে দেখিনি। সময়ের সাথে নিজেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি এখন।

এখানে সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে যায় না। ভার্সিটিতে শুধুমাত্র তারাই ভর্তি হয় যারা রিসার্চ করতে ইচ্ছুক। যারা রিসার্চ করবে না তারা আগেই চাকরিতে ঢুকে যায়। এখানে অবশ্য একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করার আগেই প্রত্যেকের চাকরি হয়ে যায়। ভার্সিটিতে ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী ছাত্র ভাগ হয় না। এখানে ছোট ছোট রিসার্চ গ্রুপ থাকে। একেক প্রফেসরের গ্রুপে একেক বিষয়ে গবেষণা চলে। অনার্স চতুর্থ বর্ষে এসে ছাত্র-ছাত্রীরা গ্রুপ নিজেরা পছন্দ করে নেয়। প্রফেসর স্টুডেন্ট চয়েস করতে পারে না। প্রফেসররা ঠিক ততোটাই সম্মানিত হন যার গ্রুপ থেকে যতো বেশি রিসার্চ পেপার পাবলিশ হয়। ছাত্র ছাত্রীদেরকে টেক্সটবুকের পাশাপাশি সাম্প্রতিক পাবলিশ হওয়া রিসার্চ পেপারগুলিও পড়ানো হয়।

সর্বোপরি আমার ভালোলাগার বিষয় হচ্ছে এখানে সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। জাপানে লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি একদিনের জন্যও। কারণ শিনজো আবের ক্ষমতা নাই জনগণকে ঘরে থাকতে বাধ্য করার। এমনকি ইমারজেন্সি ঘোষণা করারও ক্ষমতা ছিল না। পরে সংবিধান সংশোধন করে ইমারজেন্সি ঘোষণা করেছিলেন। তাতেই জনগন অপ্রয়োজনে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এখানে কমবেশি সবাই সাইকেল চালায়। অনেক বয়স্ক মানুষও এখানে সাইকেল চালান। তবে সাইকেল চালানোর সময় হাতে ছাতা থাকা যাবে না। এক ঝুম বৃষ্টির দিনে আমি সাইকেল চালানোর সময় হাতে ছাতা ফুটানো ছিল। পথে খেয়াল করলাম কিছু মানুষ আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন মানুষ না ভিনগ্রহের কোন অদ্ভুত প্রাণী দেখছে। আমি আসলে তখনও আইনটা জানতাম না। সামান্য এগোতেই আমার এক ইন্দোনেশিয়ান বন্ধুর সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করলাম এবং সে আমাকে বুঝিয়ে বলল। এই ভুল পরবর্তীতে আর করিনি। আমার ফিরতে ফিরতে কখনো অনেক রাত হয়ে যায়। রাস্তা ক্রস করতে সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু মাঝরাতেও কোন ভারী গাড়ি কিংবা স্কুটিকেও আইন ভাঙতে দেখিনি।

এখানে আসার আগে শুধু শুনেছি আর আসার পর দেখছি। যতই দেখছি মুগ্ধতা ততোটাই বাড়ছে। বরাবর সকালে উঠেই দেশের সংবাদপত্র না পড়লে ভালো লাগে না। কিন্তু সংবাদপত্র দেখলে খারাপ খবর দেখতেই হয়। মন খারাপ হয়ে যায়। দেশে থাকতে কথিত উন্নয়ন শব্দটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। কিন্তু এখন খুব ভালো করে যেটা বুঝি যে শিক্ষার মান উন্নয়ন ছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন আসলে কোন উন্নয়নের পর্যায়ে পড়ে না। আর ওইখানেই আমরা সবচেয়ে পিছিয়ে। বছর বছর বিসিএস ক্যাডার বের হয় কিন্তু গবেষক বের হয় না।

আমরা এখানে ছাত্র হিসেবে এলেও পরিবারের আয় উপার্জনকারী ব্যক্তি হিসেবেও ভূমিকা রাখতে হয়। আমার মতো আরও দুই একজন আছে যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কাজেই আমাদের পড়াশোনা করতে হয়, উপার্জন করতে হয়। দেশে বাবা মা ভাই বোন আছে তাদের জন্যও একটা অংশ পাঠাতে হয়। আমাদের মতোই অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী শ্রমিকদের পাঠানো টাকা দিয়েই দেশের ফরেন কারেন্সির ভাণ্ডার বাড়ে বলে নিউজ পড়ে খুবই ভালো লাগে। 

আমরা ভালো থাকি, মন্দ থাকি, সুখে বা কষ্টে থাকি পরিবারকে মিস করি। তবুও দেশের একটা ভালো সংবাদ আমাদের মন ভালো করার জন্য অনেক বড় নিয়ামক। প্রতিদিন সংবাদপত্র খুলে ওই একটা জিনিসই দেখতে চাই। একটা ভালো সংবাদ। মিত্থ্যা করে লেখা না সত্যিকারের ভালো সংবাদ।

(লেখক: পিএইচডি স্টুডেন্ট, তত্তরি ইউনিভার্সিটি, তত্তরি, জাপান)

Comments

The Daily Star  | English
Garment factory owners revise minimum wage upwards to Tk 12,500

Workers’ minimum wage to be reviewed

In an effort to bring normalcy back to the industries, the government will review the workers’ wage through the minimum wage board, the interim government has decided.

2h ago