অবিচার, তাতে কী?
গত পরশু দ্য ডেইলি স্টারে দুটি বিপরীতমুখী প্রতিবেদনে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি আমাদের দ্বি-মুখী মানসিকতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে আমরা রিজার্ভ ভারী করতে অনেক বেশি উৎসাহী থাকি। যে টাকাগুলো আমরা অপচয় করি কিংবা দুর্নীতিবাজদের হাতে তুলে দেই। যাতে তারা কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাই বা অন্য কোনো দেশে তাদের দ্বিতীয়, তৃতীয় বা এর চেয়েও বেশি সংখ্যক বাড়ি (আমরা এগুলোকে ভিলা বা প্রাসাদ বলব?) বানাতে পারে।
কিন্তু, যখন প্রবাস থেকে শোষণ, প্রতারণা, নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয়ে, চাকরি হারিয়ে বা প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরেও চাকরি না পেয়ে এই শ্রমিকরাই আমাদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন, তখন আমরা এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেই, যেন তাদের চিনিই না। অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে তারা কোনো না কোনোভাবে দেশে ফিরে এসেছেন। যখন তারা নিজের ঘরে ফিরবেন, তখন তাদের আমরা জেলে আটকে রাখছি। কিন্তু কেন? কী কারণে? কারণ, ‘তারা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন!’ দেশের সাধারণ ও দরিদ্র নাগরিকদের ন্যায্যতার প্রসঙ্গে সরকারের আচরণে অন্যায্যতা বা অযৌক্তিকতার সীমা থাকে না। প্রবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এটা বেশ বিদ্রূপাত্মক। কারণ, তারা যে টাকা দেশে পাঠান, তার প্রত্যাশায় আমরা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে থাকি।
বিপরীত দুটি প্রতিবেদনের মধ্যে একটিতে, অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গত বছরের তুলনায় এ বছরের আগস্টে ৩৬ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই বাড়তি রেমিট্যান্স আসছে টানা তিন মাস ধরে। জুলাই-আগস্ট সময়কালে বার্ষিক ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রেমিট্যান্স এসেছে চার দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনার প্রভাবে বিদেশের মাটিতে আমাদের শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও বেড়েছে রেমিট্যান্স। পরিবার ও দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে অমানবিক পরিশ্রম আর দৈনিক অতিরিক্ত সময় কাজ করে দেশে টাকা পাঠান তারা। যাতে আমরা ভালো থাকি।
দ্বিতীয় প্রতিবেদনে রয়েছে, ৮১ জন অভিবাসী শ্রমিককে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন শেষে আদালতের আদেশে গত মঙ্গলবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর সপক্ষে তুরাগ থানার উপপরিদর্শক যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে এবং শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’ এসআই যুক্তি দিয়েছেন, এই প্রবাসী শ্রমিকদের মুক্তি দেওয়া হলে, তারা দেশে ডাকাতি, পারিবারিক সহিংসতা, হত্যা ও জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হতে পারে। আমরা কি তাহলে বুঝব যে তারা ভিয়েতনামে জঙ্গি হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন? বাহ, তাহলে তো আইএসআইএস সত্যিই ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই কাজের মাধ্যমে আমরা হয়তো ভিয়েতনাম সরকারকে এমন কিছু জানাচ্ছি, যা তারা এখনও খুঁজে পায়নি। সেদিক থেকে ভাবলে ভিয়েতনাম সরকারের বিশেষ উপকারই আমরা করছি।
তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই প্রবাসফেরতদের কারাগারেই রাখতে চায় পুলিশ। ম্যাজিস্ট্রেট তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তবে, এটা বলা হয়নি যে তারা কতদিন কারাগারে থাকবেন। তদন্ত প্রক্রিয়ার দিকে দেখলে বিষয়টি সম্ভবত এমন হবে যে, পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দেবে, সেখান থেকে চিঠি যাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, তারপরে সেই চিঠি যাবে ভিয়েতনামের হ্যানয়ে আমাদের দূতাবাসে, তারা স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, যাদের কাছে এই অভিযোগগুলো নতুনভাবে তদন্ত করার কোনো কারণ না থাকায় যে সরকারি অভিযোগ দায়ের করেছিল সেটাই আবার পাঠিয়ে দেবে। এরপর সেই একই পথ ধরে চিঠি ফেরত আসবে তুরাগ থানায়। ভিয়েতনাম থেকে আসা সেই চিঠিতে থাকা অভিযোগ অনুযায়ী প্রবাসফেরত এই মানুষগুলোর অপরাধের ‘প্রমাণ’ জমা দেবে তুরাগ থানা এবং তাদের সাজা চাইবে। আর এই পুরো সময়টা দেশের ভাবমূর্তি ‘ক্ষুণ্নকারী’ ৮১ জন কারাগারে পচতে থাকবেন।
ভিয়েতনাম-ফেরত প্রবাসীদের কেন কারাগারে পাঠানো হলো?, জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জিজ্ঞাসা করুন। তারা গ্রেপ্তার করেছে, আমরা না।’ উত্তরটি সঠিক ছিল। কিন্তু, এতে কোনো সহানুভূতি ছিল না। এমন উত্তর আমলাতন্ত্রের সঙ্গে মানানসই হলেও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো মন্ত্রীর সঙ্গে মানানসই নয়। কারণ, তিনি ‘প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের’ মন্ত্রী। এখানে প্রবাসী এই শ্রমিকদের জন্য ‘কল্যাণ’ কোথায়?
এই শ্রমিকদের দিক থেকে ঘটনাটি সম্পূর্ণ আলাদা এবং সম্ভবত সরকার সে বিষয়ে তদন্ত করতে বা জানতে আগ্রহী না। গত বছরের শেষের দিকে এবং এ বছরের শুরুর দিকে জনশক্তি এজেন্টরা এই মানুষগুলোকে ৫০০ থেকে ৬০০ মার্কিন ডলার বেতনে কর্মসংস্থানের কথা বলে ভিয়েতনামে পাঠায়। আর তাদের চাকরি নিয়ে বাইরে যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল সরকারি।
এখানে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) একটি ভূমিকা ছিল। কারণ, তারাই শ্রমিকদের বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার আগে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং অফিসিয়াল ‘ছাড়পত্র’দেয়। বিএমইটির দায়িত্ব হলো— শ্রমিকদের ‘ভুয়া চাকরি’ নিয়ে বিদেশে যাওয়া রোধ করা। একশর বেশি শ্রমিকের ভিয়েতনামে চাকরি নিয়ে যাওয়ার সময় বিএমইটি কর্তৃপক্ষ তাদের সবার জন্য সরকারি ছাড়পত্র দিয়েছে। বিএমইটি যে চাকরির জন্য ছাড়পত্র দিয়েছে, তার জন্য চাকরিপ্রার্থীদের প্রত্যেকে এজেন্টদের চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে দিয়েছিল।
যাওয়ার সময় এই শ্রমিকদের প্রত্যেককে ভিয়েতনামে থাকা এজেন্টের প্রতিনিধির হাতে দেওয়ার জন্য এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার ডলার নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। এভাবে টাকা বহন করা সম্পূর্ণ অননুমোদিত হওয়ায়, নিশ্চিতভাবেই এটা অর্থপাচার। ভিয়েতনামে পৌঁছানোর পর তাদের পাসপোর্ট এবং টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। একইসঙ্গে কোনো কাজের অনুমতি না নিয়ে দিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন কারখানায় পাঠানো হয় কাজ করতে। তারপর তাদের সঙ্গে সেটাই হয়েছে যেটা বিদেশে যেকোনো অসহায়, কাগজ ও পাসপোর্টবিহীন মানুষের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। তাদের নির্যাতন করা হয়, ক্রীতদাসের মতো খাটানো হয়, ছোটখাটো অজুহাতে নির্মমভাবে মারধর করা হয়, ন্যূনতম খাবার দেওয়া হয় বা হয় না, নামমাত্র কিছু বেতন দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে যেন তাদেরকে মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না।
হতাশ হই যখন শুনি, আমাদের দেশের কিছু মানুষ ভিয়েতনামিদের মতোই অমানবিক শোষণের সঙ্গে জড়িত। অত্যাচারের শিকার হয়ে ‘হতভাগ্য’মানুষগুলো স্থানীয় পুলিশের কাছে গেলেও কোনো সাহায্য পায় না। এই বাংলাদেশি শ্রমিকরা, যাদের ‘আয়ের’ ওপর আমাদের উন্নয়নের অনেকটা নির্ভর করে, ভিয়েতনামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হ্যানয় যাওয়ার পথ খুঁজে নেন। সেখানে গিয়ে বাংলাদেশি দূতাবাসের সহায়তা চান।
ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন যে তিনি দুই বছর ধরে আমাদের স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকটি চিঠি দিয়েছেন। যেখানে আমাদের শ্রমিকদের ওপর চলা শোষণ ও নিপীড়নের বিষয়ে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে চলা পৈশাচিক বাণিজ্য সম্পর্কেও তাদের অবহিত করেছিলেন যে কিছুক্ষেত্রে মানবপাচারের ঘটনাও ঘটছে। তবে, তিনি তার চিঠির কোনো উত্তর পাননি, এমনকি কোনো প্রাপ্তিস্বীকারও পাননি।
এসব বাস্তবতা ও অমানবিক নির্যাতন সহ্য করে দেশে এসে তাদেরকে ‘দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা ও শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত করার’ অপরাধে জেল খাটতে হচ্ছে। এমন সিদ্ধান্তকে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি দ্বিচারিতা,অনিয়ম ও শোষণের চিত্র হিসেবেই অভিহিত করা যায়। বিদেশের মাটিতে তারা তাদের অধিকার, স্বাধীনতা ও মর্যাদা হারিয়ে এক অমানবিক পরিস্থিতিতে ছিলেন। আর দেশে এসে তারা এখন ‘তদন্ত’ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে পচতে থাকবেন।
‘আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায় এবং শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার’ পেছনে আসলে দায়ী কারা? শোষণের শিকার এই প্রবাসীরা? নাকি তাদের যারা পাঠিয়েছে এবং সেসব কর্মকর্তারা যাদের সহায়তায় শোষণ সম্ভব হচ্ছে? বিএমইটি কীভাবে তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে? স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় যদি হ্যানয়ে নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূতের কথা শুনতেন, তাহলে অনেক দুর্দশা ও ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ হওয়া থেকে বাঁচা যেত।
দ্য ডেইলি স্টার এবং অন্যান্য পত্রিকায় প্রতিবেদনের পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী গত জুলাইয়ে একটি ‘তদন্ত কমিটি’গঠন করেছিলেন। নিশ্চিতভাবেই সেই কমিটির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। মন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছেন যে, তিনি এজেন্টদের প্রতি কঠোর হতে চান না। কারণ এরইমধ্যে তারা করোনা মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আমার ধারণা, অফিসিয়াল ছাড়পত্র দেওয়া বিএমইটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও তিনি কঠোর হতে চাইবেন না। কারণ তারাও তো বিদেশে কর্মী পাঠিয়ে দেশের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছেন। বিদেশে পাঠানো কর্মী সঠিক চাকরি নিয়ে যাক আর ভুয়া চাকরি, তাতে কি বা আসে যায়। কষ্ট করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী শ্রমিকরা পচুক না জেলে। এতে কার কী আসে যায়?
মাহফুজ আনাম, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক
Comments