‘১০-১২ হাজার নমুনা পরীক্ষায় বলা উচিত নয় যে, করোনা সংক্রমণ হ্রাস পেয়েছে’
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেলেও, মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ভাইরাস এখনো প্রাণহানির ক্ষেত্রে ভয়াবহ রয়ে গেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, কম সংক্রমণের মধ্যেও মৃত্যুর হার বেশি হওয়ায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা মহামারির একটি বিপরীতমুখী চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।
প্রধানত, পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘উদাসীন’ মনোভাব, জনস্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে সাধারণ মানুষের ‘আত্মবিশ্বাসের’ অভাব, হাসপাতালে দেরিতে যাওয়া, ভুল চিকিৎসা এবং ওষুধের অপব্যবহারসহ নানাবিধ কারণকে করোনায় ক্রমবর্ধমান মৃত্যুহারের জন্য দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে তিন লাখ ১২ হাজার ৯৯৬ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন এবং মারা যান চার হাজার ২৮১ জন। দেশে তখন পর্যন্ত পরিচালিত মোট পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণের হার ছিল ২০.১৯ শতাংশ এবং শনাক্ত হওয়া রোগীর মোট সংখ্যার বিপরীতে ছিল সুস্থতার হার ৬৫.৪৬ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১.৩৭ শতাংশ।
গত ৩১ জুলাই বাংলাদেশে করোনা রোগীর সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৩৭ হাজার ৬৬১ জন, যখন পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণের হার ছিল ২১.৯৮ শতাংশ। একই সময়ে মোট মৃতের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ১১১ জন, যা শনাক্ত রোগীর ১.৩১ শতাংশ।
অর্থাৎ কেবল আগস্টেই মারা গেছেন ১১৭০ জন এবং মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে ০.০৬ শতাংশ এবং একই সময়ে সংক্রমণের হার হ্রাস পেয়েছে ১.৭৯ শতাংশ।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (এনটিএসি) সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা হলেও কমছে, তবে মৃত্যুর হার বাড়ছে।’
বয়স্ক ব্যক্তি এবং যারা একাধিক রোগে আক্রান্ত তারাই মূলত করোনার বিরুদ্ধে পরাজিত হচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমরা পর্যাপ্ত তথ্য পাচ্ছি না, এ জন্য মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান প্রবণতার পেছনের সঠিক কারণ বলা কঠিন। সরকার কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত ব্রিফিংও বন্ধ করে দিয়েছে, যা তথ্যের প্রবাহকে বাধা দিচ্ছে। এটি একটি ভুল... এটি ভুল বার্তা প্রেরণ করেছে।’
মানুষ এখন এ রোগটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না এবং হাসপাতালে যাওয়ার ক্ষেত্রেও কম আগ্রহ দেখাচ্ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক নজরুল আরও বলেন, ‘হাসপাতালের ওপর আস্থা না থাকায় অনেক করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি নিজ বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা মৃত্যুর হার বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ।’
এ ছাড়া, সাধারণ মানুষ এখন হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে না, কারণ সরকারি কর্তৃপক্ষ আইসিইউ সুবিধা, পর্যাপ্ত অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি এবং অন্য বিষয়গুলো নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে না বলে মনে করেন এনটিএসি’র এ বিশেষজ্ঞ।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে আমি মনে করি, করোনাভাইরাসের প্রতি সরকার এবং জনগণের উদাসীন মনোভাবই মৃত্যুর হার বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘প্রতিদিন ১০-১২ হাজার নমুনা পরীক্ষার ভিত্তিতে কারও এটি উচিত বলা উচিত নয় যে, করোনার সংক্রমণ হ্রাস পেয়েছে।’
‘তবে আমরা বলতে পারি যে, মৃত্যুর হার বেড়েছে কারণ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন,’ বলেন তিনি।
হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের উদাসীনতা এবং দেরিতে ভর্তি হওয়া মৃত্যুর হার বৃদ্ধির মূল কারণ হতে পারে উল্লেখ করে অধ্যাপক কনক কান্তি বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ করছি যে, অনেক লোক শেষ পর্যায়ে বা গুরুতর ফুসফুস সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। এ ধরনের রোগীদের বাঁচানো আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।’
করোনা সংক্রমণে মারা যাওয়া বেশিরভাগ রোগীদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট এবং অন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘গুরুতর অসুস্থতা রয়েছে এমন কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে আসার ক্ষেত্রে তাদের বেশি সময় নেওয়া উচিত নয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলেই কেবল তারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা না নেওয়ার কারণেও অনেক করোনা রোগী ফুসফুসের গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন।’
বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, ‘মানুষের মাঝে বাড়িতে চিকিৎসা গ্রহণ এবং তাদের আত্মীয়দের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করার প্রবণতা বাড়ছে। আমি মনে করি এটি একটি বিপজ্জনক অনুশীলন। সচেতনতার অভাবে মানুষ এটি করছে। ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে আসতে লোকদের আমি পরামর্শ দিতে চাই। চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেবেন যে, রোগীদের অবস্থা ও উপসর্গগুলো পরীক্ষা বা হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন কি না। অন্যথায়, আমরা মৃত্যুর হার হ্রাস করতে সক্ষম হব না।’
দেশে করোনায় মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘কারণগুলো জানতে আমরা চিকিৎসক এবং হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। প্রথম কারণ হলো, মানুষজন হাসপাতালে খুব দেরিতে আসছেন। হালকা লক্ষণ রয়েছে এমন অনেকেই বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে তারা অক্সিজেন-স্যাচুরেশন লেভেল পরীক্ষা করছেন না, যা আকস্মিকভাবে কমে যেতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের সংক্রমণের কারণ হতে পারে।’
ভুল চিকিৎসা এবং ওষুধের ভুল ব্যবহার ক্রমবর্ধমান মৃত্যুহারের পেছনে আরও একটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবাই এখন করোনার চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন এবং তাদের ইচ্ছামতো ওষুধ গ্রহণ করেন। এমনও কিছু গুজব রয়েছে যে, কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ বা ভেষজ গ্রহণের মাধ্যমে মানুষেরা দ্রুত করোনা থেকে সুস্থ হতে পারেন এবং অনেকেই সেগুলো গ্রহণ করছেন। এ ছাড়া, কিছু মানুষ ফোনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন এবং বাড়িতে থাকছেন। কিন্তু সব করোনা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে একই ধরনের লক্ষণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না। সঠিক পরীক্ষা, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া একটি ভুল অনুশীলন।’
ডা. ইকবাল বলেন, ‘চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী করোনাভাইরাস এখন আরও মারাত্মক হয়ে উঠছে এবং দ্রুত মানুষের ফুসফুস ও শ্বাসযন্ত্রকে প্রভাবিত করছে, যার কারণে বেশি সংখ্যক মানুষরে মৃত্যু হচ্ছে। বেশিরভাগ রোগী এখন ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। সুতরাং, আমরা মনে করি ভাইরাসটি এখন অতীতের চেয়ে মারাত্মক হয়ে উঠেছে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এখন করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছুটা নিরুদ্বেগ মনে হচ্ছে উল্লেখ করে আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘গুরুতর রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে হাসপাতালগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ এখন কম। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্ভবত আত্মবিশ্বাসী যে শিগগিরই দেশ থেকে করোনা দূর হয়ে যাবে। তবে এটি হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই।’
যেসব দেশে এর আগে করোনার সংক্রমণ কমে গিয়েছিল, সেসব দেশে পুনরায় করোনার উত্থান ঘটছে উল্লেখ করে ডা. ইকবাল বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা বিধি বজায় রাখতে জনগণকে সচেতন করতে হবে। সাধারণ মানুষকে করোনার পরীক্ষা করাতে এবং সঠিক সময়ে হাসপাতালে আসার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। অন্যথায়, অদূর ভবিষ্যতে এর চড়া মূল্য দিতে হবে আমাদের।’
Comments