বেদনাবিধুর নারায়ণগঞ্জ
স্বজন হারানোর বেদনা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না নারায়ণগঞ্জে বিস্ফোরণে নিহত কুদ্দুস ব্যাপারীর পরিবার। বাড়ির উঠানে বসা স্ত্রী ও চার সন্তানের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। সন্তান হারানোর বেদনায় বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন কুদ্দুস ব্যাপারীর মা। আবার জ্ঞান ফিরলে বিলাপ করছেন। সান্ত্বনা দিতে আসা প্রতিবেশীরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না।
শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে সদর উপজেলার পশ্চিম তল্লা এলাকায় বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া কুদ্দুস ব্যাপারীর (৭০) বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে।
এ সময় কুদ্দুস ব্যাপারীর স্ত্রী সাফিয়া বেগম বলেন, ‘বলেছিল নামাজ শেষ করে এসে ভাত খাবে। কিন্তু, আর ভাত খেতে বাড়ি এলো না। আমাদের সবাইকে ছেড়ে একেবারেই চলে গেল।’
কুদ্দুসের বড় মেয়ে সুমি আক্তার আহাজারি করছিলেন, ‘আব্বা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। আমি বলছি ঘরে নামাজ পড়েন, রাতের অন্ধকারে নোংরা পানি পার হয়ে মসজিদে যাইয়েন না। কিন্তু বলে আব্বা বলেন মসজিদে গিয়ে নামাজ না পড়লে আমার ভালো লাগে না। নামাজ শেষ করে দেরি করবো না। আজকে আমার আব্বা ফিরে আসে নাই। আব্বা কেন দেরি করতেছে?’
তল্লায় ‘শোকের ছায়া’
শুক্রবার রাতে শিশু জুয়েলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। আজ শনিবার সকাল ১০টায় আরও ১০ জনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে পুরো এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। লাশ দাফনের খাটিয়া এনে পশ্চিম তল্লা মাঠে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। এলাকার টং দোকান থেকে শুরু সবকিছুই ছিল বন্ধ। প্রতিটি দোকান, ক্লাব ও বাড়ির গেটে উড়ছিল কালো পতাকা। ময়লা ও নোংরা পানি পার হয়ে সবাই ছুটে যাচ্ছেন নিহত ও দগ্ধের পরিবারের কাছে। মিশে যাচ্ছেন তাদের শোকের সঙ্গে। মসজিদে মসজিদে নিহত ও দগ্ধদের জন্য দোয়া করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকারীদের বর্ণনায় সেই কালো রাত
মসজিদ থেকে মাত্র ১০ গজ দূরে বাস করেন আসাদুজ্জামান। বিস্ফোরণের খবর পেয়ে মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেনকে হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি।
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আগুনে দেলোয়ার সাহেব এমনভাবে পুড়েছে যে ওনাকে চিনতে পারছিলাম না। শরীরের চামড়া উঠে সাদা হয়ে গেছে। খুবই বীভৎস সে দৃশ্য। আমার চোখে এখনো সেই দৃশ্য ভাসছে।’
নামাজ শেষ করে আগেই বের হয়ে যান বাতেন মিয়া। গতকালও তিনি আগেই বের হন। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে মসজিদে নামাজ পড়েছি। দোকান খুলতে হবে তাই আগেই চলে আসি। যাদের সঙ্গে নামাজ পড়েছি তারাই এখন নাই। এটা কীভাবে মেনে নিবো।’ এই বলেই কাঁদতে শুরু করেন তিনি।
বদলে গেছে মসজিদের চিত্র
শুক্রবার রাতে যেখানে এশার নামাজ পড়তে মুসল্লিদের ভিড় ছিল, শনিবার সকাল থেকে সেখানে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃশ্য। সকাল হতেই নারায়ণগঞ্জ শহর ও আশেপাশের এলাকার হাজার হাজার মানুষ মসজিদের সামনে ভিড় জমান। সবাই জানালা দিয়ে ভেতরের দৃশ্য দেখছিল আর আফসোস করছিল এই ঘটনা নিয়ে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদের সামনে সরু রাস্তায় জমে থাকা নোংরা-ময়লা পানি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এর পাশের বালির বস্তার উপর দিয়ে মানুষ চলাচল করছে। তবে, মসজিদে প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও সাংবাদিক ছাড়া অন্য কারো প্রবেশে বারবার নিষেধ করা হচ্ছিল।
মসজিদের ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, জমে থাকা লাল রঙের পানিতে থাইয়ের গ্লাসগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। চারপাশের জানলাগুলোও ভাঙা। ফ্লোরে মানুষের শরীরের পুড়ে যাওয়া চামড়ার অংশ পড়ে আছে। জায়নামাজ পুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছয়টি এসির অংশবিশেষ ছিল ঝুলে। মাথার উপরে থাকা বৈদ্যুতিক পাখাগুলো বাঁকা হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে তিনটি ভেন্টিলেটর ফ্যান। তবে, সবকিছু পুড়ে গেলেও অক্ষত ছিল পবিত্র কোরআন শরীফ।
আহতের বর্ণনায় সেই ঘটনা
মুসল্লিদের বাঁচাতে গিয়ে আহত হওয়া আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘রাত সোয়া ৮টায় এশার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। অনেক মুসল্লি অন্যান্য নামাজ আদায় করছিলেন। আমি তখন নামাজ শেষ করে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় আসি। এ সময় বিকট আওয়াজ হয়। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আমি আটকা পড়ি। কিছুক্ষণ পরে নেমে দেখি ভেতরে ৪০ জনের মতো সবার শরীরে আগুন। এ সময় পুরো মসজিদ ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে ছিল। আমি জুতার বক্স দিয়ে থাই গ্লাস ভাঙি। পরে সবাই সেখান দিয়ে বেরিয়ে বাইরে পানিতে গড়াগড়ি করে। সবার শরীরেই আগুন ছিল।’
নিহত ও দগ্ধদের জন্য অনুদান
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নিহতের মরদেহ দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে।’
যা জানাল ফায়ার সার্ভিস
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেনটেইন্যান্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রাথমিক অবস্থায় আমরা দেখেছি দুই তলা মসজিদের নিচতলার ফ্লোরের নিচে তিতাস গ্যাসের একটি লাইন আছে। বর্তমানে এ ফ্লোরে পানি থাকার কারণে পানিতে বুদবুদ উঠছে। এতে বুঝা যায় গ্যাস নির্গত হচ্ছে। আমরা অনুমান করছি, যেহেতু নামাজের সময় এসি চালু ছিল। তার মানে পুরো ঘরটা এখানে বদ্ধ অবস্থায় ছিল। বদ্ধ থাকায় গ্যাস জমে যায়। এ সময় হয়তো কোনো একজন লাইট বা ফ্যানের সুইচ অন করার সময় প্রেশারের কারণে এটা ঘটতে পারে। আর যখন আগুনের সূত্রপাত হয় তখন এসিগুলো চালু ছিল। এতে এসির পাইপ লিকেজ হয়ে আগুন এসির মধ্যে চলে যায়। আপাতত মনে হচ্ছে এসিগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। এসিগুলো বিস্ফোরণ হলে আশেপাশে আরও কালো দাগ পাওয়া যেত। কিন্তু, এখনো কোনো দাগ পাওয়া যায়নি।’
তিতাস গ্যাস কর্মকর্তাদের অবহেলার অভিযোগ
পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘১৯৯০ সালে চার জনের অনুদানের আট শতাংশ জায়গার চার শতাংশের মধ্যে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০০ সালে একতলা ভবন করা হয়। পরে ধপে ধাপে দ্বিতীয় তলা এবং তৃতীয় তলা নির্মাণাধীন।’
তিনি বলেন, ‘গ্যাস বিস্ফোরণে এ দুর্ঘটনা ঘটছে। মসজিদে কোনো গ্যাস সংযোগ নেই। কিন্তু, এর পাশ দিয়ে বিভিন্ন বাসা বাড়িতে গ্যাসের লাইন গেছে। তাছাড়া, মসজিদের সামনে মাটির নিচে অনেক বাড়ির গ্যাসের রাইজার আছে। এগুলো লিকেজ হয়ে গ্যাস বের হয়। সেই গ্যাস মসজিদের ভিতরে জমা হয়। পরে বিদ্যুতের সুইচ দিতে গিয়ে শট সার্কিট হয়ে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।’
তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘২০ দিন আগে আমাদের মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি আব্দুল হান্নান সাউদ সাহেব তিতাস গ্যাস কর্মকর্তাদের মৌখিকভাবে জানায় গ্যাসের লাইন লিকেজ আছে। এসব লিকেজ দিয়ে গ্যাস বের হয়। তাই লাইনগুলো মেরামত করতে বলা হয়। কিন্তু, তখন মেরামত খরচের জন্য ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয় (কারা দাবি করেন সেটা তিনি জানাতে পারেননি)। তখন ফান্ডে টাকা ছিল না, তাই ওই টাকা জোগাড় করার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু, এর মধ্যেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে।’
তিতাস কর্মকর্তাদের বক্তব্য
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নারায়ণগঞ্জের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মফিজুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ওই এলাকায় সকলেরই বৈধ সংযোগ। মাটি খুঁড়ে দেখতে হবে মসজিদের নিচ দিয়ে কোনো লাইন গেছে কিনা। যদি মসজিদের ভেতর দিয়ে লাইন থাকে তাহলে লাইনটা আগে গেছে, সেক্ষেত্রে মসজিদ পরে করা হয়েছে। এখন লাইনের উপর যদি তারা মসজিদ নির্মাণ করে থাকে তাহলে সেটা তাদের অপরাধ।’
‘যদি এমন কোনো লাইন থাকে তাহলে তারা নির্মাণের আগে অফিসকে জানাবে। অফিসকে তারা কখনো কিছু জানায়নি। তাছাড়া, কোনো ভবনের নিচ দিয়ে লাইন দেওয়ার অনুমতি তিতাস থেকে দেওয়া হয় না,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে মূল লাইন আছে। সেই লাইন থেকেই বাসা-বাড়িতে লাইন গেছে। গতকাল রাত ৪টা থেকে মূল লাইনে গ্যাস বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে।’
তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল মামুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ মসজিদের জন্য কোনো গ্যাস সংযোগ নেই। এখন দেখতে হবে বাইরে থেকে আসছে কিনা। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। এ বিষয়ে পরে জানানো হবে।’
মসজিদের কমিটির অভিযোগ ও টাকা চাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে জানি না। এমনকি আমার জিএম-ডিজিএমরা আছেন, তারাও জানেন না এমন একটি অভিযোগ এসেছে। কেউ যদি অভিযোগ করার পরও কাজ না হয়, সেটা আমাদের তদন্ত কমিটি দেখবে। তদন্তে যদি এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিদ্যুতের স্পার্ক থেকে গ্যাসের বিস্ফোরণ
আহতদের বরাত দিয়ে পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদ কমিটির সম্পাদক মাওলানা মো. আল আমিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মসজিদে দুটি বিদ্যুতের লাইন আছে। শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে একটি লাইনে বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন গিয়ে লাইনের সুইচ পরিবর্তন করে দেয়। এর ঠিক ১৫ মিনিট পর আবার বিদ্যুৎ এলে লাইন পরিবর্তন করতে যান মুয়াজ্জিন। তখন বিদ্যুতের স্পার্ক থেকে গ্যাসে আগুনের স্পর্শ পায় এবং বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।’
বিদ্যুতের স্পার্ক নিয়ে কর্মকর্তাদের বক্তব্য
নারায়ণগঞ্জ পূর্ব জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোর্শেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে বিদ্যুতের কোনো ত্রুটি আমরা পাইনি। তাছাড়া, আগামীকাল আমাদের কর্মকর্তারা একটি প্রতিবেদন দেবে যে সেখানে কোনো সমস্যা আছে কিনা। এ বিষয়ে পরে জানাতে পারবো।’
মসজিদে দুটি বিদ্যুৎ সংযোগ থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক আগে লোডশেডিং বেশি থাকার কারণে পাশাপাশি দুটি লাইন থাকলে মসজিদের মুসল্লিদের সুবিধার্থে নামাজের জন্য দুটি লাইন দেওয়া হতো, এটা বৈধভাবেই দেওয়া হতো। যদিও এখন লোডশেডিং নেই, তাই প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু, অনেক আগে দুটি লাইন দেওয়ার ফলে এখনো এ মসজিদে লাইনগুলো রয়ে গেছে।তবে, দুটি লাইনের জন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।’
যা বললেন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিষয়টি এখনো পর্যন্ত আমাদের কাছে দুর্ঘটনা মনে হচ্ছে। অন্য কোনো কিছু মনে হচ্ছে না। এ ঘটনায় আজকে সকালে পুলিশ বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে ফতুল্লা মডেল থানার এসআই বাদী হয়ে ওই মামলাটি দায়ের করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, তিতাস, ফায়ার সার্ভিস ও বিদ্যুৎ বিভাগের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর যদি কারো বিরুদ্ধে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়, তখন তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া, তদন্তের পরই আরও বিস্তারিত বলা যাবে।’
আরও পড়ুন:
Comments