মায়ের আহাজারি, হাসপাতালে হৃদয়বিদারক একটি রাত
গত শুক্রবার রাতে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির জরুরি বিভাগের গেটে মানুষের ভিড়। তাদের সবাই নারায়ণগঞ্জ মসজিদের বিস্ফোরণে দগ্ধ রোগীদের আত্মীয়-স্বজন, গণমাধ্যমকর্মী ও কৌতূহলী সাধারণ মানুষ।
গেটটি সাধারণত ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। তবে বিস্ফোরণে আহত রোগী ও রোগীর স্বজনদের অত্যধিক চাপের কারণে দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা রোগী এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের ছাড়া আর কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি।
রাত ১১টা ২০ মিনিটে ভেতরে ঢুকতে পেরে, দগ্ধ রোগীদের জন্য নির্মিত ১৮তলা হাসপাতালটির যে জিনিসটি সবার আগে চোখে পড়েছে তা হলো— সাদা টাইলসের পুরো মেঝেটাতে রক্তের দাগ।
উপস্থিত চিকিত্সক ও নার্সরা জরুরি বিভাগে তিন জন দগ্ধ রোগীকে চিকিত্সা দিচ্ছিলেন। তাদের ক্ষততে ব্যান্ডেজ ও অন্যান্য প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছিলেন পঞ্চম তলায় নিয়ে যাওয়ার আগে।
চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকটা মানুষ রীতিমতো দৌড়াচ্ছে। সবার চেষ্টা, যতটা দ্রুত সম্ভব এই দগ্ধ রোগীদের যন্ত্রণা একটু প্রশমনের ব্যবস্থা করা।
এখানকার পরিবেশ ও ব্যস্ততা পঞ্চম তলার একটা নমুনা মাত্র। সেখানে নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণে দগ্ধ ৩৭ জনকে একটি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল।
উদ্বিগ্ন ও কান্নারত স্বজনরা জড়ো হয়েছিলেন একটি রুমে। তাদের কেউ কাঁদছেন, কাউকে দেখা গেল প্রিয়জনের জন্য দোয়া করতে।
তাদের কারো শার্ট বা পাঞ্জাবিতে রক্তের দাগ। বেশিরভাগেরই পায়ে জুতা বা স্যান্ডেল নেই, কর্দমাক্ত পা। জানালেন, দগ্ধ স্বজনদের নিয়ে ছুটে আসার সময় আর কিছুই খেয়াল করেননি।
ওয়ার্ডে ঢুকতেই এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখের সামনে। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করছেন দগ্ধ রোগীরা। তাদের চিৎকারে যেন আকাশ ভেঙে পড়বে।
ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. হোসাইন ইমাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পরিস্থিতি অসহনীয়। দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা অবিশ্বাস্য। ব্যথা উপশমের জন্য তাদের মরফিন দেওয়া হয়েছে। পুরো ফ্লোরেই যখন এমন রোগী দিয়ে ভর্তি, তখন সেই পরিস্থিতি সহ্য করাও অনেক কষ্টের।’
ধরে যাওয়া কণ্ঠে তিনি বলছিলেন, ‘প্রায় ৩৭ জনের মুখসহ পুড়ে গেছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত রোগীদের কষ্ট একটু লাঘব করতে চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ড বয়রা তাদের প্রাণান্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
রোগীদের স্বজনরা একজন আনসার প্রহরীকে অনুরোধ করছিলেন যেন তাদের ভেতরে যেতে দেয়, তাদের প্রিয়জনদের দেখার সুযোগ দেয়।
চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছিল সেই আনসার সদস্যের। রোগীদের স্বজনদের কাছে অনুরোধ করে তিনি বলছিলেন, ‘একটু অপেক্ষা করেন। ডাক্তাররা চলে গেলে আপনাদের ভেতরে ঢুকতে দেবো। একটু বোঝার চেষ্টা করেন, আমি এখন নিরুপায়।’
ভিড়ের মধ্যেই কান্না জড়ানো কণ্ঠে রোকসানা বেগম সবার কাছে অনুরোধ করছিলেন তার ছেলে এবং স্বামীকে তিনি দেখতে চান।
তিনি অনুনয় করে বলছিলেন, ‘আমি শুধু আমার ছেলেকে দেখতে চাই। আমার ছেলে আর স্বামী মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল। এখন তারা হাসপাতালে। আমি আমার ছেলেকে দেখতে চাই।’
আকাশের দিকে হাত তুলে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আল্লাহ, তুমি আমাকে নিয়ে যাও, আমার ছেলেটাকে বাঁচিয়ে রাখো।’
ভোররাত ১টার দিকে একজন চিকিৎসক জানান, দগ্ধ রোগীদের মধ্যে জুয়েল নামে সাত বছরের একটি ছেলে মারা গেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে তারা বিষয়টি আরও পরে জানাবেন ছেলেটির মায়ের কাছে।
হাসপাতালের ভেতরে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের জন্য এটা ছিল একটা কঠিন রাত। পেশাগত কারণে সাহস জুটিয়ে হাসপাতালে থাকলেও, শিশুটির মাকে বলার সাহস হয়নি যে আপনার ছেলেটি আর বেঁচে নেই।
Comments