আইএস নেতার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল: তানিয়া জয়া

জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর একজন নেতার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত তানিয়া জয়ার। বিট্রিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার জীবনের সেই চরম দুর্বিসহ সময় আর কেমন করে তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
তানিয়া জয়া। ফাইল ফটো এএফপি

জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর একজন নেতার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত তানিয়া জয়ার। বিট্রিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার জীবনের সেই চরম দুর্বিসহ সময় আর কেমন করে তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।

১৯৮৩ সালে উত্তর লন্ডনে এক বাংলাদেশি পরিবারে জন্মেছিলেন তানিয়া জয়া। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই একজন ইংরেজ হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার পরিবার চেয়েছিল আমি একজন “ভালো মুসলিম নারী” হই। তারা চেয়েছিলেন, আমি যেন পাশ্চাত্য সমাজ-সংস্কৃতি অনুসরণ না করি।’

দ্য গার্ডিয়ানকে তানিয়া বলেন, ‘কেউ যখন মা-বাবার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন তাদের কর্তৃত্ব, তখন তাদের শাসন-বারণ এগুলোও অবিশ্বাস্য মনে হয়।’

১৭ বছর বয়সে পরিবারসহ পূর্ব লন্ডনে চলে যান তানিয়া। নতুন জায়গায় নতুন মানুষের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়।

তানিয়া বলেন, ‘তারা খুব রক্ষণশীল ছিলেন। তারা আমার পশ্চিমা মনোভাবের কারণে অপমান করতেন। আমি এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যে, আমি নতুন একজন মানুষ হয়ে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। আমার এক কাজিন এসময় আমার উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তিনি আমাকে খেলাফত সম্পর্কে শিখিয়েছিলেন। আমি অনলাইনে প্রচুর সৌদি ইসলামিক ফতোয়া পড়তাম। আমি ভেবেছিলাম, সত্যের সন্ধান করে যাওয়াই আমার জীবনের উদ্দেশ্য।’

২০০৩ সালে লন্ডনে ইরাক যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন তানিয়া। সেসময় কয়েকজন লোক তাকে একটি মুসলিম ডেটিং ওয়েবসাইটের নাম লেখা একটি কাগজের টুকরো দিয়েছিলেন।

তানিয়া বলেন, ‘ওই ওয়েবসাইটেই আমার জন জর্জেলাসের সঙ্গে পরিচয় হয়। জন একজন মার্কিন নাগরিক যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। সে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছে। জন বহুভাষী ছিল। তাকে আমার খুব স্মার্ট বলে মনে হয়েছিল। আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে এরকমই একজনের খোঁজ করছিলাম।’

জনের প্রথম লন্ডন সফরেই তাকে বিয়ে করেন তানিয়া। ‘আমি জানতাম এটাই আমার বাড়ি থেকে পালানোর একমাত্র পথ। এর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। আমাদের প্রথম সন্তান জন্মায়।’

তানিয়া জানান, প্রথম সন্তান জন্মানোর কিছুদিনের মধ্যেই জনের মধ্যে কট্টরপন্থী আচরণ দেখা দিতে থাকে। আমি যেমন নিকাব পরা বন্ধ করে দিই, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে থাকি, জন ঠিক তার উল্টোটা করতে থাকে।’

২০০৬ সালে ইসরায়েলিপন্থী লবিং গ্রুপের ওয়েবসাইট হ্যাক করার অভিযোগে তিন বছরের সাজা হয় জনের।

তানিয়া বলেন, ‘আমি তখনও স্বামীর উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল ছিলাম। আমি বুঝতে পারিনি, নিপীড়নমূলক এক সম্পর্কের মধ্যে আছি।’

কারাগার থেকে জন বেরিয়ে এলে তিন সন্তানসহ ওই দম্পতি কিছুদিনের জন্য মিশর ও পরে ইস্তাম্বুল চলে যান।

তানিয়া বলেন, ‘জন তখন সিরিয়ায় যাওয়ার কথা আমাকে বলেছিল, কিন্তু সন্তানদেরকে নিয়ে আমি যুদ্ধ চলছে এমন কোনও দেশে যেতে চাইনি। এই ব্যাপারে আমি অনড় ছিলাম।’

‘ইস্তাম্বুলে থাকার মতো সামর্থ্য আমাদের ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় জন আমাকে ও তার পরিবারকে জানিয়েছিল যে, আমরা তুরস্কের আন্তকায় থাকবো। কিন্তু এর বদলে আমরা সরাসরি সিরিয়ার সীমান্তে চলে আসি।’

দ্য গার্ডিয়ানকে তানিয়া বলেন, ‘মধ্যরাতে যখন আমরা বাস ধরলাম তখনও আমি বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। আমি তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমি আর আমার সন্তানেরা বাসে বসে ঘুমাতে পারবো এটা ভেবে স্বস্তি পেয়েছিলাম। সূর্য ওঠার পর আমরা সিরিয়ার একটি চেকপয়েন্টে পৌঁছাই। জন তখন আমাকে কোনো ধরনের আপত্তি না করার জন্য হুমকি দেয়।’

সেখানে একটা ফোন খুঁজে পেয়ে শ্বশুড়বাড়িতে ফোন করেন তানিয়া।

তানিয়া বলেন, ‘আমি তার মাকে ফোন করে জানাই যে জন আমাদের মিথ্যা কথা বলেছে। আমি কাঁদতে কাঁদতে মাকে বলেছি এফবিআইয়ের এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।’

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এর পরের কয়েক বছর ধরে জনের খোঁজ করেন। এফবিআই থেকে তানিয়াকে বলা হয়েছিল, স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেলে তার বিরুদ্ধে কোনও চরমপন্থী সংগঠনে যোগ দেওয়ার অভিযোগ আনা হবে না।

তানিয়া বলেন, ‘সিরিয়াতে আমাদের পানির কল থেকে কোনো পানি পাওয়া যেত না। কারণ বাসার উপরে থাকা পানির ট্যাঙ্কটিতে গুলি চালানো হয়েছিল। আমি ও আমার সন্তানরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছিলাম। আমি সারাক্ষণ সন্তান হারানোর ভয়ে থাকতাম।’

‘এফবিআইকে খবর দেওয়ার জন্য জন আমার উপর রেগেছিল। নিজের পরিবারকে ঠকানোর জন্য আমি তার উপর ক্ষুব্ধ ছিলাম।’ ক্ষোভে নিজের মুখ ঢাকতে অস্বীকার করেন তানিয়া।

এটি জনকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। তানিয়া বলেন, ‘হয় আমাকে ছেড়ে চলে যেতে অথবা নিয়ন্ত্রণ করতে তার বন্ধুরা তাকে চাপ দিতে থাকে। অবশেষে জনের করুণা হয়। সে আমাদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে।’

রাস্তা অবরোধ ও সংঘর্ষের কারণে এর পরের তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করেন তানিয়া।

‘আমরা কয়েক মাইল হেঁটে, কাঁটাতার ঘেরা গর্ত পেরিয়ে স্নাইপারের গুলির মুখে ট্রাকে উঠি। যে লোকটির আমাদেরকে বাস স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সে আমাদের মাঝপথে ফেলে রেখে চলে যায়। অবশেষে একজন তুর্কি লোক আমাদের সাহায্য করেন।’

তানিয়া বলেন, ‘আমি বেঁচে ফিরে আসতে পারায় কৃতজ্ঞ। আমি চেয়েছিলাম আমার সন্তানরা ভালো জীবন কাটাবে, সুস্থ পৃথিবীতে ফিরে আসবে এবং এই পৃথিবীকে কিছু দেবে।’

খেলাফত প্রতিষ্ঠায় এবং ইসলামি স্টেটের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন জন। পাশ্চাত্যের অনেককে আইএসে যোগ দেওয়া, তাদের জঙ্গি হিসেবে তৈরি হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তার।

তানিয়া বলেন, ‘আমি জনকে আর দেখিনি। পরে শুনেছিলাম সে সিরিয়ায় আবারও বিয়ে করেছে।’

২০১৯ সালে জনের মৃত্যুর খবর পান তানিয়া। ২০১৭ সালে মার্কিন বোমা হামলার সময় তিনি মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়।

বর্তমানে যুক্তরাজ্যের কাউন্টার-এক্সট্রিমিজম গ্রুপ ‘ফেইথ ম্যাটার্স’ এর সঙ্গে কাজ করছেন তানিয়া জয়া।

আমি এখন টেক্সাসে থাকি। জনের বাবা-মা আমার বাসার খুব কাছেই থাকেন। কাছাকাছি থাকায় বাচ্চাদের এবং তাদের জন্য এটি ভালো হয়েছে। আমার বর্তমান স্বামী আমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্বশীল। আমি আমার স্বাধীনতা ভালোবাসি।

দ্য গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, ‘চরমপন্থা থেকে দূরে থাকার মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। আপনাকে সঠিক ডেটা, তথ্য ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে হবে। এটাই আমাকে বদলেছে। আমি অনেক পড়েছি, নিজেকে শিক্ষিত করেছি। আমাদের বোঝা জরুরি যে, শান্তিতে থাকার জন্য আমাদের প্রত্যেককেই অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, ভিন্ন মত, ধারণার মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মূল্যবোধ থাকতে হবে।’

Comments

The Daily Star  | English
Yunus-led interim govt takes charge

2 months of interim govt: Hopes still persist

The interim government had taken oath two months ago with overwhelming public support and amid almost equally unrealistic expectations.

1h ago