ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আদালতে আরও দুটি হত্যার এজাহার
টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার, অন্যান্য পুলিশ সদস্য এবং পুলিশের সোর্সসহ স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে আরও দুটি পৃথক এজাহার দায়ের করা হয়েছে। আজ সোমবার কক্সবাজার আদালতে এ দুটি এজাহার দায়ের করা হয়।
কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আমলী আদালত-৩ (টেকনাফ) এর বিচারক মোহা. হেলাল উদ্দীন এজাহার দুটি আমলে নিয়ে টেকনাফ থানার ওসিকে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দিয়েছেন।
আজ প্রথম এজাহারটি দায়ের করেন টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৩নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরপাড়ার মৃত নূর মোহাম্মদের স্ত্রী লাইলা বেগম।
তিনি আদালতে দায়ের করা এজাহারে বলেন, ‘তার স্বামীর নাম নুর মোহাম্মদ। তার স্বামী একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং টেকনাফের একটি কৃষি সমবায় সমিতির সভাপতি। তিনি বীজ, সার, তেল ও কীটনাশক ওষুধের ব্যবসায়ী এবং সরবরাহকারী। গত বছরের ১৯ মার্চ সকাল ১১টার দিকে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ একদল পুলিশ নিয়ে তার স্বামীকে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে খুন করার উদ্দেশ্যে জোর করে ধরে টেকনাফ থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে টেকনাফ থানায় গেলে তার স্বামীকে ছাড়িয়ে নিতে হলে নগদ ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি। টাকা দিতে না পারলে স্বামীকে খুন করা হবে বলে জানিয়ে দেন। স্বজনদের কাছ থেকে ধার কর্জ করে নগদ পাঁচ লাখ টাকা ওসি প্রদীপের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর আরও ৩৫ লাখ টাকা দাবি করতে থাকেন ওসি। বাদী আর টাকা দিতে পারবে না বলে অপারগতা প্রকাশ করলে বাদীকে থানার হাজতখানায় বন্দী করে রাখা হয়। ২১ মার্চ দিবাগত রাতে বাদী এবং স্বামী নূর মোহাম্মদকে আলাদা দুইটি গাড়িতে করে মেরিন ড্রাইভ সড়কের রাজারছড়া এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে স্বামীকে হাত চোখ বাঁধা অবস্থায় গাড়ি থেকে নামিয়ে পাশের একটি জঙ্গলে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বাদী গুলির শব্দ শুনতে পান। এক সময় তার সামনে আনা হয় গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত স্বামীর লাশ। বাদী চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলে পুলিশ সদস্যরা তাকে ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। অস্ত্রের ভয় দেখায়। পুলিশ স্বামীর লাশসহ বাদীকে নিয়ে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে আসে। এরপর ময়না তদন্ত শেষে পুলিশ তার আত্মীয়দের কাছে স্বামীর মরদেহ হস্তান্তর করে। স্বামীর বুকে দুইটি ও তলদেশের বাম পাশে একটি গুলি লাগে এবং নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। পুলিশের নির্দেশ মতো ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে ২২ মার্চ রাতে স্বামীর মরদেহ দাফন করতে হয়। পরবর্তীতে ওসি প্রদীপসহ অন্যান্য আসামিরা জোর করে বাদীকে বাড়িঘর থেকে বের করে দেয় এবং তা দখল করে রাখে ও নানারকম হুমকি দিতে থাকে।’
বিচারক বাদীর দাখিল করা এজাহারটি আমলে নিয়ে এ হত্যার ঘটনায় টেকনাফ থানায় মামলা হয়ে থাকলে তার বর্তমান অবস্থাসহ মামলার অগ্রগতির প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার জন্য টেকনাফ থানার ওসিকে আদেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাদীর আইনজীবী মোসতাক আহমদ চৌধুরী।
এই মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৫ জনকে। তারা হলেন- সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক রাকিকুল ইসলাম খান, এসআই স্বপন চন্দ্র দাশ, সুজিত চন্দ্র দে, এএসআই হিল্লোল বড়ুয়া, কনস্টেবল রুবেল বড়ুয়া, সাগর দেব, নাজমুল ইসলাম, মো. আল আমিন, সাব্বির আহমদ, সৈকত, মোহা. হোসেন, মো. হালিম মিয়া ও এরশাদুল ইসলামকে। এ মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ১১ জনকে।
একই আদালতে আজ দ্বিতীয় এজাহার দায়ের করেন টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের ডেইলপাড়ার সালেহ আহমদের স্ত্রী হালিমা খাতুন(৫৫)। এই মামলায় ওসি প্রদীপসহ মোট ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। তার মধ্যে ১৪ জন পুলিশ সদস্য। অপর দুইজন পুলিশের সোর্স ও গ্রাম পুলিশ।
বাদীর পক্ষের আইনজীবী জয়নাল আবেদীন বলেন, আদালত এজাহারটি গ্রহণ করে এই হত্যার ঘটনায় ইতোপূর্বে মামলা হয়ে থাকলে তার অগ্রগতি এবং ময়না তদন্তের রিপোর্টসহ ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য টেকনাফ থানার ওসিকে আদেশ দিয়েছেন।
এই মামলার আসামিরা হলেন- ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই সুজিত চন্দ্র দে, কামরুজ্জামান, রাসেল আহমদ ও জামশেদ, এএসআই আমির হোসেন, রামধন চন্দ্র দাশ, মিটুন কুমার ভৌমিক ও রাজু মজুমদার, কনস্টেবল রুবেল শর্মা, সাগর দেব, রুমন দাশ, পুলিশের সোর্স নুরুল হোসাইন ও গ্রাম পুলিশ আবদুস সোবাহান।
বাদী তার এজাহারে বলেন, ‘তার ছেলে দিনমজুর আবদুল আজীজসহ তিনজনকে গত বছরের ১৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে নয়টায় ডেইলপাড়া থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এরপর পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ওসি প্রদীপ আজীজের বাবাকে জানান, ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে হলে নগদ ৫ লাখ টাকা দিতে হবে। আবদুল আজীজের বাবা ও মা ধারকর্জ করে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ৫০ হাজার টাকা দেন। টাকাগুলো লেনদেন করেন পুলিশের সোর্স নুরুল হোসাইন। দাবীকৃত বাকি সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিতে না পারায় ১৯ অক্টোবর রাত আনুমানিক ১১টা ৪৫ মিনিটে মেরিনড্রাইভ সড়কের মহেশখালীয়াপাড়া ঘাট এলাকায় নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে আবদুল আজীজকে উপর্যপুরী গুলি করে হত্যা করা হয়। পরেরদিন ওসি প্রদীপ তার পুলিশ দল নিয়ে আবদুল আজীজদের বসতঘর ভাঙতে যায়। লবণ মাঠের পলিথিনের ছাউনীযুক্ত ছোট্ট কুড়েঘর দেখে বাদীকে উদ্দেশ্য করে ওসি প্রদীপ বলেন, তোমার ছেলেকে মেরে ফেলতে দুটি গুলির বেশি মারতে হয়নি। এরপর দীর্ঘদিন পুলিশ নানা ভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল।’
আজকের দুটিসহ ওসি প্রদীপসহ টেকনাফ থানায় তখন কর্মরত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মোট ১০টি হত্যা মামলার এজাহার দায়ের করা হয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার আদালতে।
আরও পড়ুন:
বন্দুকযুদ্ধের নামে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগ ওসি প্রদীপসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে
৩ জনকে হত্যার অভিযোগে ওসি প্রদীপসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে আরও একটি এজাহার
ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরও একটি হত্যা মামলা
ওসি প্রদীপসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে অটো চালককে সাত মাস আটকে রেখে হত্যার অভিযোগ
টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশ হেফাজতে
ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
Comments