তারিক আলীর মুক্তিযুদ্ধ ‘মুক্তির গান’
যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি তারা ‘মুক্তির গান’ দেখেছেন। শরীরের লোমকূপগুলোতে শিহরণ জেগেছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে আনন্দাশ্রু।
মুক্তির গানের অন্যতম চরিত্র মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত মানুষটি আলাদা করে নজর কেড়েছেন। জন্মভূমির মাটিতে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে আসার আকুতি, পাখিকে ‘জয় বাংলা’ শেখানো, শরণার্থী শিবিরে বিচরণ... দর্শকও যেন তার অংশীজন হয়েছেন। বলছি মুক্তির গানের অন্যতম চরিত্র জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর কথা। চোখের সমস্যা তাকে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধের সুযোগ দেয়নি। থেমে থাকেননি। কণ্ঠ দিয়ে অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। ৭৫ বছরের সফল জীবন কাটিয়ে চলে গেলেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী।
‘মুক্তির গান’ দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পেরেছেন এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। মুক্তির গানের অন্যতম চরিত্র জিয়াউদ্দিন তারিক আলী চোখের পানি ধরে রাখতে পারতেন না জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময়।
সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর তারিক আলী সম্পর্কে বলছিলেন, ‘জাতীয় সংগীত পুরোটা তিনি গাইতে পারতেন না। কয়েক লাইন গাওয়ার পরেই তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরতে শুরু করত। তার কাছে জানতে চাইলেই বলতেন, “জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে লাখো মানুষের মৃত্যু, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর জীবন দেওয়া, আরও কত মানুষের ত্যাগের সেই চিত্র।”’
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেন আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক।
‘তারিক ভাই মনে প্রাণে মুক্তিযোদ্ধা, বাঙালি এবং ধর্ম নিরপেক্ষ একজন মানুষ ছিলেন,’- বলছিলেন নাট্য ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারা জাকের।
জিয়াউদ্দিন তারিক আলী পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দৃষ্টিনন্দন নতুন ভবনের সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। তার ধ্যানজ্ঞান সবই ছিল এই জাদুঘরটি ঘিরে।
সারা জাকের বলেন, ‘আমরা কেউ জাদুঘরে নিয়মিত যাই আর না যাই, তিনি নিয়মিত যেতেন। এত বেশি চলাফেরা করা ওনার উচিত ছিল না, তারপরও সেখানে না গেলে যেন তার ভালো লাগত না। বিভিন্ন মিটিং বা কাজ আমরা অনলাইনে সম্পন্ন করতে পারতাম। কিন্তু, তার মনে হতো যে সবসময় আমাদের সেখানে যাওয়া উচিত।’
একই কথা উঠে এলো আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠেও। ‘দীর্ঘদিন ট্রাস্টের সদস্য সচিব ছিলেন তিনি। যখন তিনি এই দায়িত্বটি ছেড়ে দিলেন, তখনও নিয়মিত জাদুঘরে যেতেন। ওটাই ছিল তার বাড়ি-ঘর, ওটাই ছিল তার সংসার, ওটাই ছিল তার পরিবার।’
জাদুঘরের প্রতি দায়িত্ব এবং ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আলী জাকের বলেন, ‘ট্রাস্টের আমরা আট জন ট্রাস্টি। সব সিদ্ধান্ত আমরা একসঙ্গেই নিতাম। আমার মনে হয়েছে, আমাদের সবার মধ্যে তারিকই সবচেয়ে বেশি আপোষহীন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করতে ১৯৭১ সালে এদেশে আসেন মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন। একদল সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গে ঘুরে তিনি তার ডকুমেন্টারির কাজ করতে থাকেন। যে দলটির সঙ্গে লিয়ার লেভিন ঘুরে ছিলেন তার নাম ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। এই দলের একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী।
একাত্তরের এই গানের দলটি ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘পেশায় প্রকৌশলী হলেও, ভীষণ গান পাগল ছিলেন তারিক। গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি বুলবুল একাডেমিতে গান শিখেছেন। পরবর্তীতে ছায়ানটের সঙ্গে তার যোগাযোগ বাড়ে। যতদূর মনে পরে, সেখান থেকেই তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ এবং সখ্যতা। এরপরই তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমরা যে যার মতো করে সীমান্ত অতিক্রম করে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে চলে গেলাম। পরে জানতে পারলাম, যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও চোখের সমস্যার কারণে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নেওয়া হয়নি। অনেক বেশি পাওয়ারের চশমা তাকে পরতে হতো, যা শেষ জীবন পর্যন্ত তাকে পরতে হয়েছে। পরে সে যোগ দেয় বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থায়।’
এই যে শিল্পী দল গান করে বেড়াত তার সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল আলী জাকেরেরও। কেমন সম্পৃক্তা ছিল, সে সম্পর্কে আলী জাকের বলেন, ‘মুক্তির গানের যে কমেন্টারিটা পড়া হতো, সেটা আমার কণ্ঠে রেকর্ড করে নেওয়া হয়েছিল। সেটাই সব অনুষ্ঠানে বাজানো হতো। এ কাজটি করতে গিয়েই তারিকের সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।’
চোখের সমস্যার কারণে অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলা করতে না পারলেও সম্মুখ যোদ্ধাদের মনোবল শক্ত করতে তারিক আলী যুদ্ধের ময়দানেই ছিলেন। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সঙ্গে থেকে মার্কিন নির্মাতা লেভিন প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। যুদ্ধের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেলেও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ডকুমেন্টারিটি তৈরি করতে পারেননি তিনি।
১৯৯০ সালে লেভিনের কাছ থেকে সেই ফুটেজ সংগ্রহ করেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ। একে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য আরও বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ নেন এবং যোগাযোগ করেন সেই সময়ের শিল্পীদের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত তার হাত ধরে পূর্ণতা পায় ‘মুক্তির গান’।
ছবিটির সম্পর্কে বলতে গিয়ে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘তারিক আলীর সুবাদেই তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ ওই নেগেটিভগুলো (লিয়ার লেভিনের কাছ থেকে) উদ্ধার করেন। জিয়াউদ্দিন তারিক আলীও তখন তাদের সঙ্গে ছিলেন এবং সহযোগিতা করেছিলেন। ছবিতে তরুণ তারিক আলী অন্যতম মূল ভূমিকায় আছেন।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরির পটভূমি কী? কিভাবে শুরু হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রচেষ্টা? উত্তর পাওয়া যায় আসাদুজ্জামান নূরের কথাতেই। এই জাদুঘর তৈরির সূচনা এবং জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর অবদান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে ঠিক করলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু করব। প্রথমে বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা করলেও বেশ কয়েকটি জায়গায় যাওয়ার পরে বুঝলাম, এত বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা আমাদের জন্য একটা বিশাল কাজ হয়ে যাবে। সেটা আমরা পারব না, আমাদের সাধ্যের বাইরে। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার। এই সিদ্ধান্তগুলোর একদম শুরু থেকেই আমাদের সঙ্গে ছিলেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী।’
জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠাকালীন আট সদস্যদের সবাই কোনো না কোনো ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমেতো আমরা ভাঙা বাড়িতে শুরু করেছিলাম। পরবর্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আমরা অনেক এগিয়ে যাই। আমাদের এই জাদুঘর তৈরিতে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে স্কুলের বাচ্চারাও তাদের অনুদান দিয়ে গেছেন।’
আসাদুজ্জামান নূর বলছিলেন, তারিক আলী ছিলেন ভীষণ প্রাণবন্ত মানুষ। প্রতিটি আড্ডা তিনি মাতিয়ে রাখতেন গান দিয়ে। ‘মনে প্রাণে একজন বাঙালি হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষও। বাঙালি চেতনাটাই ছিল এই মানুষটির কাছে সবচেয়ে বড়,’ যোগ করেন তিনি।
আজ সোমবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী।
সারা জাকের বলেন, ‘এত আগে ওনার চলে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমাদের জন্য অনেক বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল।’
কান্না বিজড়িত কণ্ঠে আলী জাকের বলেন, ‘ও চলে যাওয়াতে আমার মনটা একদম ভেঙে গেছে।’
জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর মতো স্বাধীনচেতা এবং বাংলাদেশের পক্ষের মানুষ আজকাল খুঁজে পাওয়া যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওর জীবনীটা যদি আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে সবাই উপকৃত হবে। বাংলাদেশের পক্ষের বলতে কেবল মাতৃভাষা বা স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রশ্নে নয়, এদেশের সংস্কৃতিতেও তিনি একজন বড় মাপের সহযোদ্ধা ছিলেন আমাদের।’
Comments