৪৯ বছর পর স্বীকৃতি পেল বগুড়ার কৈচর বধ্যভূমি

কৈচর বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ। ছবি: মোস্তফা সবুজ

বগুড়া সদর উপজেলার ফাপোর ইউনিয়নে অবস্থিত ২৬ জন শহীদের একটি গণকবরকে আনুষ্ঠানিকভাবে গণকবরের স্বীকৃতি দিল জেলা প্রশাসন। শহীদদের স্মরণে এখানে একটি স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করা হয়েছে।

মঙ্গলবার বিকেলে কৈচর বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন করেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার মো. হুমায়ন কবির খন্দকার।

১৯৭১ সালের মে মাসের শুরুর দিকে পাকিস্তানি বাহিনী ফাপোর উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে ২৬ জন পুরুষকে ধরে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। বগুড়া জেলা প্রশাসন এদের মধ্যে ২১ জনের পরিচয় এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পেরেছে। স্থানীয় লোকজন, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের পরিবারের লোকজন এই বধ্যভূমির অবস্থান আগে থেকে জানলেও এতদিন পর্যন্ত এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না।

এই ২৬ জন শহীদের মরদেহ মাটিচাপা দেওয়ার জন্য সেদিন গ্রামের ৬ জন যুবককে মিথ্যা কথা বলে ডেকে এনেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের একজন, মজিবুর রহমান এখনও বেঁচে আছেন।

সেই দিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী ৭৫ বছরের মুজিবুর বলেন, ‘মে মাসের শুরুর দিকে পাক বাহিনী সান্তাহার হয়ে বগুড়ায় আসে। একদিন ২৬ জন মানুষকে তারা ধরে আনে এখানে। কোমরে দড়ি বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয় তাদের। দুই দফায় ব্রাশ ফায়ার করে সবাইকে হত্যা করা হয়।’

‘আমাদেরকে মিথ্যা কথা বলে আনা হয়েছিল এখানে। সকাল ১০ থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত আমরা গর্ত খুঁড়েছিলাম। প্রথমে বেলচা দিয়ে, পরে কোদাল দিয়ে—স্মৃতি হাতড়ে বলেন মজিবুর রহমান।

২০১৪-১৫ সালে ফাপোর ইউনিয়ন পরিষদ ভবন তৈরি করতে গিয়ে এখানে মাটির নিয়ে মানবদেহের অনেকগুলো হাড় পাওয়া যায়। পরে তা ভবনের উত্তর পাশে পুঁতে ফেলা হয়।

২৬ জনের মধ্যে জেলা প্রশাসন যে ২১ শহীদের পরিচয় শনাক্ত করেছেন তারা হলেন- কালিপদ সিংহ, কর্ণ প্রসাদ সিংহ, গজেন্দ্রনাথ সিংহ, শ্যামল চন্দ্র সিংহ, শ্রীবাস দাস, গোলক চন্দ্র দাস, ননী চন্দ্র দাস, সুধীর চন্দ্র দাস, গুপি চন্দ্র দাস, গোবিন্দ মহন্ত, নিতাই চন্দ্র দাস, পল্লাদ চন্দ্র দাস, সুধাংশু চন্দ্র দাস, নিতাই চন্দ্র দাস, হরী দত্ত,গণেশ চন্দ্র, বিনয় চন্দ্র সাহা, নগেন্দ্রনাথ সাহা, নারায়ণ চন্দ্র প্রামাণিক, হীরেন্দ্রনাথ সাহা এবং গৌর গোপাল মোহন্ত।

বধ্যভূমির স্মৃতিফলক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শহীদ কর্ণ প্রসাদের স্ত্রী শিবানী বালা (৮১) বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু সময় মে মাসে আমরা নারী-পুরুষসহ প্রায় ৫০ জন এই পথে ভারত যাচ্ছিলাম। রাতে আমরা ফাপোর ইউনিয়নের ডুমুর গ্রামের এক ধনী হিন্দুর বাড়িতে আশ্রয় নেই। খোঁজ পেয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। রাত ৩টায় সেখান থকে আমার স্বামীসহ আরও তিনজন পুরুষকে ধরে নিয়ে যায় পাক বাহিনী। পরদিন সকালে শুনি তাদের এখানে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। ছয় দিন হেঁটে আমরা ভারতের মালদহ যাই।’

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা রফিকুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘১৯৯৮ সালে এখানে আমরা একটা গণকবর সংরক্ষণ কমিটি গঠন করেছিলাম। সেই সময়ে কৈচর বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি ওঠে। তখন আমরা আমরা বগুড়ার গণকবরগুলোর তালিকা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে প্রেরণ করি। এতদিন পর এই বধ্যভূমির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়ায় ভালো লাগছে।’

বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘এমন একটি মহান কাজের সাক্ষী হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমাদের তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা যখন এটি দেখবে তখন তারা এসব স্মৃতিসৌধের মাধ্যমেই জানতে পারবে বাংলাদেশর স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস।’

বগুড়ার জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক বলেন, ‘প্রথমে আমরা এই বধ্যভূমির নাম, তথ্য এবং শহীদদের নামের তালিকা সংগ্রহ করি। পরে স্থানীয় লোকজন, মুক্তিযোদ্ধা, প্রত্যক্ষদর্শী এবং শহীদদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলি এবং ২১ জনের নাম-ঠিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হই। খুব শিগগিরই এই বধ্যভূমির নাম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জাতীয় তালিকায় সংযুক্ত করা হবে।’

Comments

The Daily Star  | English
Nat’l election likely between January 6, 9

EC suspends registration of AL

The decision was taken at a meeting held at the EC secretariat

10h ago