কী দোষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে উত্তরাঞ্চলের মানুষ?
২০০৬ থেকে ২০২০ সাল। এই ১৪ বছরে দেশে একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যাদের প্রিয় খেলা ক্রিকেট। তাদের অনেকে আবার বয়সভিত্তিক দলে খেলতে শুরু করেছে। অনেকের প্রিয় খেলোয়াড় হয়তো সাকিব আল হাসান কিংবা মুশফিকুর রহিম। তাদের সবাই কম-বেশি আইপিএল-বিপিএলের মতো জনপ্রিয় আসরগুলো দেখে। দেশ-বিদেশের বড় বড় খেলোয়াড়দের নাম, বৈশিষ্ট্য ও পরিসংখ্যান হয়তো তাদের নখদর্পণে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, দেশের এই প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েই জানে না যে, বগুড়ায় একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু ছিল!
বলছি বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের কথা। ২০০৬ সালের পর এখানে আর কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়নি। ঠিক কেন-কী কারণে হয়নি, সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই দেশবাসীর। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নাকি বিসিবির উদাসীনতা?
তবে প্রায় দেড় দশক ধরে কোনো ম্যাচ না হওয়াতে, দেশের ক্রিকেট অনুরাগীরা যদি ভুলে গিয়ে থাকেন যে, উত্তরবঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম ছিল, তবে তাদের দোষ দেওয়ার উপায় নেই।
গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের যুবারা তাদের বিশ্বজয়ের আগে মাসব্যাপী প্রস্তুতি নিয়েছিল বগুড়ার এই মাঠে। তখন যুব দলের কাপ্তান আকবর আলী, কোচ ও মানেজার বলেছিলেন যে, বগুড়ার উইকেটে ঘাস বেশি ও বাউন্স রয়েছে। সেকারণেই তারা তাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সারেন চান্দু স্টেডিয়ামে। গত ২৫ অগাস্ট দেশের তারকা ব্যাটসম্যান মুশফিক এই মাঠে অনুশীলন করে তার স্বীকৃত ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও আপলোড করে লিখেছিলেন যে, বগুড়ার উইকেট সম্ভবত দেশের সেরা টার্ফ উইকেট।
এখন এই মাঠে ঘরোয়া বিভিন্ন আসর, যেমন- জাতীয় লিগ, স্থানীয় প্রিমিয়ার ডিভিশন ও প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের মানুষের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দেখার স্বপ্ন তো পূরণ হচ্ছে না!
বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম আইসিসির স্বীকৃতি পাওয়ার আগে পরিচিতি ছিল বগুড়া জেলা স্টেডিয়াম হিসেবে। ২০০৩ সালের ৩ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পরের বছর আইসিসি যুব বিশ্বকাপের তিনটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। অংশগ্রহণ করেছিল অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে ও কানাডা। পরবর্তীতে বিভিন্ন পর্যায়ের ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন দেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দল, ‘এ’ দল, হাই পারফরম্যান্স দলের মুখোমুখি হয় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। আর ঘরোয়া আসরের মধ্যে কর্পোরেট ক্রিকেট লিগ ও জাতীয় ক্রিকেট লিগ প্রায় নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
২০০৬ সালের ৩০ জানুয়ারি আইসিসি বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে ঘোষণা করে। একই বছরে স্টেডিয়ামটি আন্তর্জাতিক টেস্ট ভেন্যুর স্বীকৃতিও পায়।
ওই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এই ভেন্যুতে পাঁচটি ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হয়, যার চারটিতেই জয় লাভ করেছিল স্বাগতিক বাংলাদেশ। ২০০৬ সালের ২২ ফ্রেব্রুয়ারি এই মাঠেই টাইগাররা প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কাকে হারাতে সক্ষম হয়। একটি টেস্ট ম্যাচও গড়িয়েছিল স্টেডিয়ামটিতে যেখানে লঙ্কানদের কাছে ১০ উইকেটে হেরে যায় বাংলাদেশ।
পরিসংখ্যান বলছে, শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম বাংলাদেশের জন্য একটি পয়া ভেন্যু। কিন্তু ২০০৬ সালের পর আর জ্বলে ওঠেনি স্টেডিয়ামটির ফ্লাড লাইটগুলো। আলোড়িত হয়নি উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মানুষের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দেখার একমাত্র মঞ্চ।
এই মাঠে সবশেষ ইংল্যান্ড ‘এ’ দল এসে খেলে গেছে ২০০৭ সালের মার্চ মাসে (ত্বত্তাবধায়ক সরকারের আমলে)। এরপর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এখানে কোনো ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়নি।
উত্তরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের ধারণা, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা চান্দু স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ফেরাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না রাজনৈতিক কারণে।
বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি ও বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক সাগর কুমার রয় বলেন, ‘শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ ফেরানোর জন্য আমরা প্রতিনিয়ত ক্রীড়ামন্ত্রী ও বিসিবির কাছে আবেদন করছি। কিন্তু তারা কোনো ইতিবাচক সাড়া দেননি এখনো। বিসিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, বগুড়ায় আকাশ পথে যাওয়ার সুযোগ নাই।’
বগুড়া জেলা যুব লীগের সভাপতি ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি শুভাশীষ পোদ্দার লিটন জানান, ‘পদাধিকার বলে ডিসি সাহেব (জেলা প্রশাসক) হলেন জেলা ক্রীড়া পরিষদের সভাপতি। তারা প্রশাসনের লোক। তাই আমরা বললেও তারা অনেক সময় এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখেন না। তবে এই বিষয়টি নিয়ে আমি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলার চেষ্টা করে আগামী ছয় মাসে একটা রেজাল্ট (ফল) নিয়ে আসার চেষ্টা করব।’
দেশসেরা ব্যাটসম্যান মুশফিকের পাশাপাশি বর্তমানে বগুড়ার অন্তত ১০ জন ছেলে-মেয়ে জাতীয় দল, অনূর্ধ্ব-১৯, অনূর্ধ্ব-১৬ ও হাই পারফরম্যান্স দলে নিয়মিত ক্রিকেট খেলছে। তাই এমন ধারণা খুবই যুক্তিসঙ্গত যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরলে ভবিষ্যতে আরও অনেক ক্রিকেটারের যোগান দেবে বগুড়া।
হতে পারে বিপিএলের হোম ভেন্যু
শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে দ্রুত উপযোগী করে তুলতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিপিএলের যে কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলে খুব বেশি সময় লাগবে না সংস্কার করতে। বিপিএলের দল রংপুর রেঞ্জার্স কোনো হোম ভেন্যু নেই। তাই কর্তৃপক্ষ চাইলেই স্টেডিয়ামটিকে রংপুরের হোম ভেন্যু করতে পারে। তাতে উত্তরাঞ্চলের মানুষ বগুড়ায় বসে বিপিএল উপভোগ করতে পারবে।
গত বছরের বিপিএল জুড়ে ছিল দর্শকখরা। কিন্তু বগুড়ায় লম্বা সময় পর ক্রিকেট ফিরলে দর্শকদের জায়গা দিতে যে হিমশিম খেতে হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বগুড়ার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উত্তরাঞ্চলের যে কোনো জেলা থেকে এখানে এসে সহজেই খেলা উপভোগ করা যায়। সকালে পৌঁছে ব্যাট-বলের লড়াই দেখে সন্ধ্যায় বাসে বা ট্রেনে বাড়ি ফেরা যায়। রাত্রি যাপনের জন্য হোটেলে থাকার প্রয়োজন হয় না।
যোগাযোগ ও আবাসন ব্যবস্থা
বগুড়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভালো। ঢাকা-রংপুর হাইওয়ের চার লেনের কাজও অনেক দূর এগিয়েছে। এখানে চার তারকা হোটেল নাজ গার্ডেন, পাঁচ তারকা মম-ইনসহ ভালোমানের প্রায় পাঁচ-ছয়টি হোটেল-মোটেল আছে। ফলে খেলোয়াড়দের আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে কোনো সংকট তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই।
দরকার একটু সংস্কার কাজ
২০০৩-০৪ অর্থ বছরে মাত্র ২১ কোটি টাকায় বগুড়া জেলা স্টেডিয়ামকে একটি আন্তর্জাতিক ভেন্যুতে (ফ্লাড লাইটসহ) উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। এই মাঠে আগে থেকেই ভালো মানের পাঁচটি উইকেট (পিচ) রয়েছে। আরও দুইটি নতুন উইকেট বানাতে বেশি খরচও করতে হবে না। আউটফিল্ড, গ্যালারি, মিডিয়া সেন্টার ও ড্রেসিং রুমের অবস্থা এখনো বেশ ভালো। তাই খুব অল্প টাকায় স্টেডিয়ামটিকে সংস্কার করে আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চালু করা খুব বেশি কঠিন হবে না।
শহীদ চান্দু অবহেলায় পড়ে থাকলেও বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম তৈরি করেছে কক্সবাজার, সিলেট ও খুলনায়। ২০১১ সালে খুলনার শহীদ শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮০ কোটি টাকারও বেশি। পূর্বাচলে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি।
বর্তমানে স্টেডিয়ামটির দায়-দায়িত্ব বিসিবির। তবে গত ১৪ বছরে এখানে ছোঁয়া লাগেনি সংস্কার কাজের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেছেন, যদিও ২০০৬ সালের পর থেকে ফ্লাডলাইটগুলো খুব কমই জ্বালানো হয়েছে, তারপরও বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য প্রতি মাসে ৯০ হাজারেরও বেশি টাকা দিতে হয় বিসিবিকে। তাছাড়া, স্টেডিয়ামের কর্মীদের বেতন ও নামমাত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও প্রতি মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বগুড়ার এই মাঠ সংস্কারে খুব বেশি অর্থ খরচ করতে হবে না। ২০০৬ সালে স্টেডিয়ামটির দর্শক ধারণ ক্ষমতা ছিল সাড়ে ১৮ হাজার। এই মাঠের চারপাশে যে ফাঁকা জায়গা আছে, তাতে গ্যালারি সম্প্রসারণ করলে ৪০ হাজার দর্শক একসঙ্গে মাঠে বসে খেলা উপভোগ করতে পারবে। মাঠের আউটফিল্ডের উন্নয়নের জন্য স্যান্ড ফিলিং করে ফিল্টার সিস্টেম করলে বৃষ্টির পর মাত্র ৩০ মিনিটে খেলা পুনরায় শুরু করাও সম্ভব।
আর যদি আকবর ও মুশফিকের কথাগুলোর ন্যূনতম কোনো মূল্য থেকে থাকে, তবে এই স্টেডিয়ামটি জাতীয় দলের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদও বটে। কারণ, যুবা টাইগারদের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ের ক্ষেত্রে এই মাঠের উইকেটগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
জনগণের অর্থে নির্মিত একটি স্টেডিয়ামকে নষ্ট হতে না দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরানো কোনো কঠিন কাজ নয়। কেবল একটু উদার মনোভাবই যথেষ্ট। এই মাঠে ক্রিকেট ফিরলে উত্তরবঙ্গের ক্রিকেটেপ্রেমীরা আবার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গর্জনে মাতিয়ে তুলবে এবং তা করতে তারা মুখিয়েও আছে।
সবশেষে, ক্রিকেটকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া এবং নতুন নতুন প্রতিভা খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করলে বগুড়াকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত করে রাখার বিষয়টি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
Comments