‘কেবল পোশাক দিয়েই মুক্তমনটা দেখা যায় না’
বোরকা পরা মা ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিলেন। ছবিটি তুলেছিলেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী ফিরোজ আহমেদ। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। শুরু হয় পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক-তর্ক এবং কূতর্ক। যা এখনও চলছে।
আলোচনা সমালোচনায় মুখরিত বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে।
মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির বলেন, ‘আমি বোরকা পছন্দ করি না, কিন্তু তিনি বোরকা পরেছেন, এটি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। পছন্দ থেকে, সামাজিক চাপের কারণে বা পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে তিনি যদি বোরকা পরেন, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি পছন্দ করি না, কারণ আমার মনে হয় এটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার একটি প্রতিচ্ছবি। তাই বলে তার বোরকা পরা নিয়ে মন্তব্য করার কী আছে?’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। হত্যা, সরকারি কর্মকর্তার ওপর আক্রমণ, পুলিশের হাতে নির্বিচার হত্যা ও নারীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে সামাজিক বিচার করার চেষ্টা, দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নয়ন না হওয়াসহ আরও অনেক কিছু আছে আমাদের চিন্তা করার। একজন নারী তার সন্তানের সঙ্গে খেলছেন, সেটি চিন্তা করার মতো কোনো বড় বিষয় নয়। আমি বোরকা পছন্দ না করলেও তিনি বোরকা পরে খেলছেন বলেই সেটি নিয়ে সমালোচনা করতে হবে বা তাকে খেলতে দেওয়া হবে না, এটি কোনো যুক্তির কথা নয়। কারও ওপর আমার পছন্দ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন নেই। অতিরিক্ত মেকআপ করাটাও যেমন আমার পছন্দ না। কিন্তু, যে করে সে নিশ্চয়ই কোনো কারণে করে। তিনি বোরকা পরে খেলছেন, নাকি না পরে খেলছেন, সেটি তো কোনো বড় কথা না। যেকোনো নারী খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করলে সেটিকে আমি অভিনন্দন জানাই।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত জানিয়ে খুশি কবির বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হয়ে আলোচনা করা উচিত, সেগুলো রেখে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হইচই করা হচ্ছে।’
একই প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর কথাতেও। তিনি বলেন, ‘পোশাকের বিষয়টি মানুষের নিজস্ব ব্যাপার। আমি পান্তাভাত খাচ্ছি নাকি ইলিশ মাছ খাচ্ছি, তা নিয়ে কারও যদি কিছু বলার না থাকে, তাহলে পোশাকের ব্যাপারে থাকবে কেন? এটি যদি কারও কোনো ক্ষতি করে, তাহলে তা নিয়ে কথা হতে পারে। কিন্তু, বোরকা পরলে কারও ক্ষতি হচ্ছে, এটি কি প্রমাণ করতে পারবে? এটি একজনের নিজস্ব পছন্দ।’
তিনি আরও বলেন, ‘বোরকা বাঙ্গালি সংস্কৃতির অংশ না। সেটি তো আমরাই আমদানি করেছি, সবার হাতে তুলে দিয়েছি। এখন সেটি কে পরবে আর কে পরবে না সেটি তাদের ব্যাপার। আমার অবাক লাগে, সমাজের একশ্রেণীর মানুষ সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে কথা বলে না, কিন্তু বোরকা পরলে সেটি নিয়ে কথা বলে।’
এসব বিষয় নিয়ে কাউকে কথা বলতে হবে কেন, এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘একজন নারীর ওপর যেকোনো কিছু যদি চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা তার মানবাধিকার লঙ্ঘন। কেউ যদি স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে বোরকা পরে, সেটি তার নিজস্ব ব্যাপার। এটিও তার মানবাধিকারের অংশ। এটি নিয়েও কথা বলা শোভনীয় নয়।’
খেলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আছেন যারা দ্বিমুখী, যাদের মধ্যে প্যারাডক্সিক্যাল আচরণ থাকে। তারা একদিকে চাকরিজীবী নারীদের বলবে, সন্তানদের সময় না দিয়ে তারা কাজ করে বেড়ায়। আবার আরেকদিকে কোনো নারী যদি সময় দেয় তাহলেও সেখানে সমস্যা বের করবে। যেখানে তারা ক্রিকেট খেলেছে, সেই প্রতিষ্ঠানের যদি সমস্যা না হয়, তাহলে আমাদের সমস্যা কেন হবে? মা তার ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলবেন, নাকি পার্কে ঘুরে বেড়াবেন, নাকি নাগরদোলায় চরবেন, এটি তার ব্যাপার।’
‘আমাদের সমাজে কতগুলো রীতি-নীতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মায়েরা যখন সন্তানদের স্কুলে নিয়ে গিয়ে লাইন ধরে বসে থাকেন, তখন তো কিছু বলা হয় না। বলা হয় না কারণ এখানে তো বলার কিছু নেই। তাহলে, মা যদি সন্তানকে নিয়ে ক্রীড়া শিক্ষার ব্যাপারে সময় দেন, তাহলে কারও কিছু বলার অধিকার নেই বলে আমি মনে করি’, যোগ করেন রাশেদা কে চৌধুরী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এখানে মা আর ছেলের সম্পর্কটাই মুখ্য। সেটি বিকিনি পরে হোক আর বোরকা পরেই হোক। এখানে আমার কাছে মূল বিষয় হচ্ছে- একজন মা তার সন্তানকে কীভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি, তিনি বোরকার নিচে জিনস পরছিলেন, নাকি অন্য কিছু তা নিয়ে কিছু মানুষ মন্তব্য করেছে। এগুলো কোনো কথা?’
এই করোনাকালে মানুষ মুক্তি খুঁজছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের সন্তানরা খেলার তেমন সুযোগ পায় না। সেখানে একজন নারী তার সন্তানকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করছেন। আমাদের সময় বাবা-মায়েরা সন্তানদের চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হতে বলতেন। আমাকে তো দূরে থাক, আমার ভাইকেও খেলোয়াড় হতে বলেনি। সেখানে এই মা নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তার সন্তানকে খাপ খাওয়াচ্ছেন এবং সেটাও নিজে সঙ্গে থেকে, এটি অনেক বড় বিষয়।’
ঝর্ণা আক্তারের এই কাজ আরও অনেককে উৎসাহিত করবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছেলের সতীর্থরা তখনো পর্যন্ত আসেনি বলে নিজেই তিনি খেলতে নেমে গেছেন, এটি আমার কাছে ব্যতিক্রমী এবং অবশ্যই খুবই প্রশংসনীয় মনে হয়েছে। বোরকা পরলে ক্রিকেট খেলা যাবে না, এমন তো কোথাও বলা নেই। মানুষের মুক্তমনা হওয়াটা তার ভেতরের ব্যাপার। কেবল পোশাক দিয়েই মুক্তমনটা দেখা যায় না। মুক্তমন দেখা যায় তার কর্মকাণ্ডে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই মা তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্ত ও প্রগতিশীল মানসিকতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আর সবচেয়ে ভালো লেগেছে, তিনি আর এই প্রগতিশীল চিন্তার সঙ্গে তার পরবর্তী প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করেছেন।’
পোশাক একজন মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপারে অন্য কারও আর কিছু বলার নেই। আমি একটি সুন্দর শাড়ী পরলে আপনি আমাকে বলতে পারেন শাড়ীটা সুন্দর। কিন্তু আপনি আমাকে বলতে পারেন না, আপনি শার্ট-প্যান্ট না পরে শাড়ী পরেছেন কেন। এটা বলার অধিকার আপনার নেই। এটা অনধিকার চর্চা। যারা এসব বলছেন, তারা অনধিকার চর্চা করছেন।’
‘একজন নারীবাদী হিসেবে না দেখে নারী ক্ষমতায়নের দৃষ্টিতে দেখতে চাই। ক্ষমতায়নের অনেক রূপ আছে। ওয়েস্টার্ন পোশাক পরলেই কেউ ক্ষমতায়িত আর ফুল হাতা ব্লাউজ পরলেই তিনি ক্ষমতায়িত নন, এটা আমি মনে করি না। কারণ ক্ষমতায়নের সঙ্গে মনের একটি ব্যাপার আছে। নিশ্চয়ই সংবাদ দেখেছেন, করোনা পরিস্থিতিতে ওয়েস্টার্ন দেশগুলোতে গৃহবিবাদ এবং নারীর ওপর সহিংসতা বেড়ে গেছে। তারা তো বোরকা পরেন না, কিন্তু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সুতরাং ভিতরের মূল্যবোধটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
Comments