আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকীতে মৌলভীবাজারের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ

মৌলভীবাজারের সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ রোগীদের নিয়ে পরিচালিত একটি মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘স্কলারস জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড মেডিকেল সায়েন্স’-এ প্রকাশিত হয়েছে। চলতি জুলাই সংখ্যায় প্রবন্ধটি স্থান পেয়েছে।
প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে ব্যবহৃত সিটি স্ক্যানের একটি কপি। ছবি: সংগৃহীত

মৌলভীবাজারের সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ রোগীদের নিয়ে পরিচালিত একটি মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘স্কলারস জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড মেডিকেল সায়েন্স’-এ প্রকাশিত হয়েছে। চলতি জুলাই সংখ্যায় প্রবন্ধটি স্থান পেয়েছে।

মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের দুজন এবং দেশের আরও পাঁচটি মেডিকেল কলেজ ও ইন্সটিটিউটের পাঁচ জনসহ মোট সাত জন রেডিওলোজিস্টের সমন্বয়ে এ গবেষণা চালানো হয়েছে।

৫১ জন সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ রোগীর ওপর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের অনুমতি সাপেক্ষে এই গবেষণা চালানো হয়েছে। তাদের লক্ষণ ছিল এবং একই সঙ্গে আরটি-পিসিআর এবং বুকের সিটি স্ক্যান করিয়েছেন।

গবেষকদের সূত্রে জানা যায়, সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ রোগীদের শনাক্তের ক্ষেত্রে আরটি-পিসিআর এবং বুকের সিটি স্ক্যান পরীক্ষায় কোনটির সংবেদনশীলতা বেশি, তা নির্ণয়ের জন্য মৌলভীবাজারে এই গবেষণা চালানো হয়। এতে প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের রেডিওলোজী অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের চিকিৎসক মো. উবায়দুল ইসলাম। তার সঙ্গে ছিলেন একই হাসপাতাল ও বিভাগের চিকিৎসক লায়লা রুবাইয়াত।

এছাড়াও দেশের আরও পাঁচটি মেডিকেল কলেজ ও ইন্সটিটিউটের পাঁচ জন রেডিওলোজিস্ট তাদের সঙ্গে সমন্বিত ভাবে কাজ করেছেন। প্রায় তিন মাস ধরে এই গবেষক দল মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং বেসরকারি লাইফ লাইন হাসপাতাল ও কার্ডিয়াক সেন্টারে ৫১ জন সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ রোগীর ওপর গবেষণা পরিচালনা করেন।

সন্দেহভাজন এই রোগীদের করোনা পরীক্ষা আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে হয়েছে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। আর সিটি স্ক্যান পরীক্ষা হয়েছে লাইফ লাইন হাসপাতালে।

এই গবেষণা নারী-পুরুষ উভয়ের ওপরেই চালানো হয়। রোগীদের গড় বয়স ছিল ৪৫ বছরের মধ্যে এবং উপসর্গের সময়সীমা ছিল সাড়ে তিন থেকে পাঁচ দিন।

এই রোগীদের লক্ষণ ছিল জ্বর, কাশি ও বুক ব্যথা। প্রায় সবারই সিটি স্ক্যান পরীক্ষায় রোগের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এসময় কারও কারও আরটি-পিসিআরের প্রথম নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ‘নেগেটিভ’ এসেছে। কিন্তু তিন-চারদিন পরের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল এসেছে ‘পজিটিভ’। এভাবে কোভিড লক্ষণ যুক্ত সন্দেহভাজন রোগীদের মধ্য থেকে ২১ জনের ‘পজিটিভ’ এবং ৩০ জনের ‘নেগেটিভ’ রিপোর্ট আসে।

এই গবেষণায় দেখা গেছে, সিটি স্ক্যানে সঠিক ফলাফলের সংবেদনশীলতা ৯৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং প্রথম নমুনায় আরটি-পিসিআরের সংবেদনশীলতা ৮৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

বিশ্বের অন্যান্য দেশেও গবেষণা প্রবন্ধে দেখা যায় আরটি-পিসিআরের সংবেদনশীলতা সিটি স্ক্যানের তুলনায় কম। মৌলিক এই গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘স্কলারস জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড মেডিকেল সায়েন্সে’র জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

জেলা পর্যায়ে পরিচালিত এমন একটি মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকীতে প্রকাশিত হওয়ায় গবেষক দলটি অনেক উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত।

গবেষণা দলের সদস্য রেডিওলোজী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক লায়লা রুবাইয়াত বলেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখি, আগামীতে বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায় থেকেও এধরনের আরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হবে।’

গবেষণা দলের আরেক সদস্য সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের রেডিওলোজী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসক সুদীপ্তা গোপ বলেন, ‘জেলা শহরের এমন অ্যাকাডেমিক কাজে যুক্ত হয়ে বুঝতে পারলাম কতো ভালো কাজ হচ্ছে সেখানে।’

এই গবেষণার প্রধান সমন্বয়ক ও মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের রেডিওলোজী অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের চিকিৎসক মো. উবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘মফস্বলে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও আমাদের এই গবেষণা কাজ আলোর মুখ দেখেছে, এটাই বড় ব্যাপার। এই মহামারির সময়ে রোগীদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সিটি স্ক্যান করা ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ।’

এই গবেষণা কাজে সহযোগিতার জন্য তিনি মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক পার্থ সারথি দত্ত কাননগো, জেলা সিভিল সার্জন চিকিৎসক তউহীদ আহমেদ, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি চিকিৎসক শাব্বির হোসেন খান ও সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক শাহজাহান কবীর চৌধুরীসহ জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের সকল চিকিৎসক নার্স, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও লাইফ লাইন হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। সকলের সহযোগিতা না পেলে এ গবেষণা কাজটি চালানো কঠিন হতো বলে তিনি যোগ করেন।

মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক পার্থ সারথি দত্ত কাননগো বলেন, ‘কোভিড-১৯ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো জেলা শহরে এটাই প্রথম কাজ, যা আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে প্রকাশ পেল। এজন্য তরুণ চিকিৎসক মো. উবায়দুল ইসলাম ও লায়লা রুবাইয়াতসহ গবেষণা দলের সবাইকে অভিনন্দন। এ ধরনের গবেষণা কার্যক্রমকে সকলের উৎসাহ প্রদান করা উচিত।’

সিভিল সার্জন চিকিৎসক তউহীদ আহমেদ বলেন, ‘গবেষণা চিকিৎসা শাস্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশে সম্পদ, অবকাঠামো এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে গবেষণাকর্ম কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারছে না। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে মৌলভীবাজারের মতো একটি ছোট শহরে করোনার মতো একটি নতুন রোগের উপরে এই গবেষণাকর্ম অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এই গবেষণালব্ধ জ্ঞান পরবর্তী সময়ে রোগীর চিকিৎসার উন্নতি সাধনে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।’

প্রধান সমন্বয়ক জানিয়েছেন, এই গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও কোভিড-১৯ জাতীয় কমিটির সদস্য চিকিৎসক রোবেদ আমিন বলেছেন, এটা একটা চমৎকার প্রবন্ধ এবং খুব ভালোভাবে লেখা হয়েছে। তবে দলটি সেনসিটিভিটি ও স্পেসিফিসিটি নিয়ে তাদের প্রবন্ধে আরও দুটি আলাদা টেবিল রাখতে পারতো।

দুজন রোগীর প্রাথমিক অবস্থায় আরটি-পিসিআর নেগেটিভ হলেও তারা কিভাবে পরে কোভিড গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হলেন, তার আরও বেশি ব্যাখ্যা হলে ভালো হতো। তিনি আশা করেছেন, ভবিষ্যতে আরও বড় কলেবরে দলটি কাজ করবে।

লাইফ লাইন হাসপাতাল ও কার্ডিয়াক সেন্টারের পরিচালক (প্রশাসন) মৃন্ময় রায় রতন বলেন, ‘এই ক্রান্তিকালে এরকম একটা গবেষণার অংশ হতে পেরে আমরা গর্বিত।’

গবেষণা দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন- বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, ঢাকার রেডিওলোজিস্ট ডা. ইয়াসির আহমেদ মাসুম, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট, ঢাকার রেডিওলোজিস্ট ডা. রুবাইয়া ইসলাম বনী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রেডিওলোজিস্ট ডা. জাস্টিন ক্লাম্প, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রেডিওলোজিস্ট ডা. মৌসুমী অনুরাধা সাংমা।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago