পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ লাইনে ত্রুটি, নকশা সংশোধনের নির্দেশ
নির্মাণে ত্রুটি পেয়ে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে এর নকশা সংশোধন করতে বলা হয়েছে। মূল সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, রেললাইন যে উচ্চতায় হচ্ছে, তাতে সড়ক দিয়ে সেতুতে ওঠার সময় লরি আটকে যাবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প (পিএমবিপি) কর্তৃপক্ষ উদ্বেগ জানানোর পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ নির্দেশনা দিয়েছে। সেতুর দুই প্রান্তের ভায়াডাক্ট (সেতু থেকে সড়ক পর্যন্ত উড়াল রেললাইন) নকশায় একই সমস্যা আছে বলে জানা গেছে।
জাতীয় মহাসড়কের জন্য আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় প্রস্থ ও উচ্চতা দুই দিকেই জায়গা খুব কম থাকায় ত্রুটিপূর্ণ নকশাটি সংশোধন করার দাবি জানিয়েছে পিএমবিপি কর্তৃপক্ষ।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প (পিবিআরএলপি) ভায়াডাক্টগুলোর নকশা করেছে।
মূল সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেছেন, বর্তমান নকশা অনুযায়ী রেলওয়ে ভায়াডাক্ট নির্মাণ করলে আকারে উচ্চ লরিগুলো চলাচল করতে পারবে না। পিবিআরএলপি কর্তৃক করা নকশায় যে আনুভূমিক সীমার কথা বলা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়িত হলে দেশের দীর্ঘতম সেতুর সংযোগকারী রাস্তাগুলোকে সংকুচিত করবে।
এদিকে, রেল সংযোগ প্রকল্পের কর্তৃপক্ষের দাবি, ২৫(১) ও ২৫(২) নম্বর পিলার নিয়েই সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাদের ঠিকাদার এখন নকশা সংশোধন করছে। এ ছাড়াও, কর্মকর্তারা এখন সংকুচিত জায়গা নিয়ে বিকল্প সমাধান খুঁজতে বুয়েট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করছেন বলে জানা গেছে।
মূল সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধিতার মধ্যে জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে পিবিআরপিএল কর্তৃপক্ষ প্রশ্নবিদ্ধ পিলার নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। তবে, এটি প্রকল্পের সামগ্রিক ব্যয় ও সময়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি করেছে পিবিআরপিএল কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের (পিবিআরএলপি) পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নকশা সংশোধন করা জন্য আমাদের কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। আমরা সেগুলো অনুসরণ করছি।’
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে সড়ক ও রেল লাইনের মাধ্যমে রাজধানীর সঙ্গে সংযুক্ত করতে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশ রেলওয়ে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর উপরে ১৬৯ কিলোমিটার (ঢাকা থেকে যশোর) রেললাইন ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প’ বাস্তবায়নে কাজ করছে।
ট্রেনগুলো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার ডাবল ডেক ব্রিজের নিচের ডেক ব্যবহার করবে ও যানবাহনগুলো উপরের রাস্তাটি ব্যবহার করবে। যেহেতু সেতুর দুই পাশের রেলওয়ের ভায়াডাক্টগুলো দীর্ঘ স্লোপ প্রয়োজন, তাই এগুলো ব্রিজের
দুই দিকে সংযোগকারী রাস্তার ওপর দিয়ে অতিক্রম করবে।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ভায়াডাক্টের নিম্নভাগ থেকে সড়কের উচ্চতা হতে হবে ৫ দশমিক ৭ মিটার। যাতে সব ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারে। এ ছাড়াও, একটি জাতীয় মহাসড়কের আদর্শ প্রস্থ ১৫ দশমিক ৫০ মিটার হওয়া উচিত।
পিএমবিপি পরিচালক শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তবে, তাদের (পিবিআরপিএল) নকশা অনুযায়ী সেতুর দুই পাশের রেলওয়ে ভায়াডাক্টের উচ্চতা ও প্রস্থ প্রয়োজনের চেয়ে কম রয়েছে। তারা স্ট্যান্ডার্ড মানছেন না। আমি কর্তৃপক্ষকে এটা জানিয়েছি।’
বর্তমান নকশা অনুযায়ী রেলপথের ভায়াডাক্টগুলো নির্মিত হলে বড় বড় লরিগুলো সেতুটি ব্যবহার করতে পারবে না বলে জানিয়েছেন বিবিএ’র নির্বাহী পরিচালক বেলায়েত হোসেন।
তিনি বলেন, ‘তাদেরকে (পিবিআরএলপি) নকশা সংশোধন করতে বলা হয়েছে।’
বিষয়টি সমাধানের জন্য গত ১৯ আগস্ট পিবিআরএলপি একটি বৈঠক করেছে ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পাঠানো এক চিঠিতে সমস্যার কিছু বিবরণ দিয়েছে।
পদ্মা সেতুর সংযোগকারী রাস্তাটি সেতুর জাজিরা পয়েন্টে রেলপথের ২৫ (১) ও ২৫ (২) পিলারের নিচে দিয়ে যাবে।
মূল সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদার যখন পিলার বসাতে রাস্তাটি খনন করেন, তখনই (১৯ জুলাই) ঠিকাদারকে কাজ বন্ধ করতে বলেন তারা। সেসময় উচ্চতা, প্রস্থ ও সংযোগ পয়েন্টের নকশা সম্পর্কে নথিও চেয়েছিলেন।
চিঠিতে জানানো হয়েছে, ঠিকাদার কাজটি বন্ধ করে দেয়। পিবিআরএলপির পক্ষ থেকে সেই নথিগুলো পাঠানো হয়।
পিলারের নিচে ও সংযোগকারী রাস্তার মধ্যে উচ্চতার সীমা ৫ দশমিক ৫১ মিটার এবং দুটি পিলারের মধ্যে পাশাপাশি দূরত্ব জায়গা ৯ দশমিক ৬৫ মিটার রয়েছে বলে চিঠিতে জানানো হয়। চিঠিতে আরও জানানো হয়, সংযোগকারী রাস্তার প্রস্থ ৯ দশমিক ৩৬ মিটার রয়েছে।
পিএমবিপি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই উল্লম্ব ও আনুভূমিক সীমা পর্যাপ্ত নয়। উচ্চতায় ৬ মিটার ও প্রস্থে ১৫ দশমিক ৫ মিটার হওয়া উচিত।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বিবিএ’র কাছ থেকে মতামত নিয়ে রেল সংযোগ প্রকল্পের নকশা তৈরি করা হয়েছিল। উভয় প্রকল্পের ইন্টারফেস কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।
২৫ (১) ও ২৫ (২) পিলারের পাইল স্থাপন এবং ২৭ থেকে ৪৭ পর্যন্ত সব পিলার নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং রেললাইনের স্তর পরিবর্তন করা সম্ভব না।
তাই পিবিআরপিএল কর্তৃপক্ষ ভায়াডাক্টের উচ্চতা যা আছে তা রেখে সংযোগ সড়কের স্তরকে কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। তবে, পিএমবিপি জানিয়েছে, নকশাটি মোটেই গ্রহণযোগ্য না।
এ বিষয়ে পিবিআরএলপির পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এটা কোনো সমস্যা না। আমরা একটি প্রয়োজনীয় প্রস্তাব পেয়েছি। সে অনুযায়ী আমরা এখনই সমাধান করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘২৫ নম্বর পিলারের ক্ষেত্রে ত্রুটি হয়েছে। সেটি এখন ঠিক করা হচ্ছে।’
তবে, পিএমবিপি’র পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের আপত্তি সেতুর দুই পাশে ভায়াডাক্টগুলোর ডিজাইন এবং সেটার উচ্চতা ও প্রস্থ উভয় সীমা নিয়েই।’
২১টি পিলারের নকশা (২৭ থেকে ৪৭ নম্বর) পরিবর্তন ও পুনর্গঠন করতে হবে কি না, জানতে চাইলে ফখরুদ্দিন বলেন, ‘না। আমাদের কেবল ২৫ নম্বর পিলারের নকশা পরিবর্তন করতে হবে। অন্যান্য পিলার সংক্রান্ত কোনো সমস্যা নেই।’
তিনি আরও জানান, ঠিকাদারকে নকশার সংশোধন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা করতে সর্বোচ্চ এক মাস সময় লাগতে পারে।
প্রস্থ নিয়ে বিবিএ ও পিএমবিপি কর্তৃপক্ষের আপত্তি প্রসঙ্গে ফখরুদ্দিন বলেন, ‘আমরা রাস্তাটি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব।’
পিএমবিপি প্রস্তাবটি গ্রহণ করবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। আমরা এ বিষয়ে বুয়েট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করছি। অবশ্যই এর সমাধান খুঁজে পাব।’
মোট প্রকল্পের ব্যয় ও সময়কাল নিয়ে এর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে দাবি করেন তিনি।
বিবিএ’র নির্বাহী পরিচালক বেলায়েত হোসেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা ও উভয় প্রকল্পের শীর্ষ কর্মকর্তারা আজ প্রকল্পের সাইটটি পরিদর্শন করবেন।
বিবিএ’র নির্বাহী পরিচালক বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘সমস্যা সমাধানের জন্য ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা গিয়ে দেখব কীভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায়।’
Comments