ব্যক্তিস্বাধীনতা, মাতৃত্ব আর বোরকার পরের প্রশ্ন

ঝর্ণা আক্তার সাংবাদিকদের বলতে শুনেছিলেন, বোরকা পরা মা ও সন্তানের ক্রিকেট খেলার ছবি বিশ্ব কাঁপাবে। ছবিটি বিশ্বকে কাঁপিয়েছেও। শত শত নিউজ, মতামত আর মন্তব্যের বন্যায় ভেসে গেছে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। লক্ষণীয় বিষয় হলো রক্ষণশীল, উদার-সেকুলার, প্রগতিশীল বা নারীবাদী - সবধরনের আলোচনার প্রায় কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ঝর্ণার বোরকা, মাতৃত্বের জয়গান অথবা নারীর পছন্দ করা না করার স্বাধীনতার বিষয়গুলো।
cricket-1.jpg
ছবি: ফিরোজ আহমেদ

ঝর্ণা আক্তার সাংবাদিকদের বলতে শুনেছিলেন, বোরকা পরা মা ও সন্তানের ক্রিকেট খেলার ছবি বিশ্ব কাঁপাবে। ছবিটি বিশ্বকে কাঁপিয়েছেও। শত শত নিউজ, মতামত আর মন্তব্যের বন্যায় ভেসে গেছে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। লক্ষণীয় বিষয় হলো রক্ষণশীল, উদার-সেকুলার, প্রগতিশীল বা নারীবাদী - সবধরনের আলোচনার প্রায় কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ঝর্ণার বোরকা, মাতৃত্বের জয়গান অথবা নারীর পছন্দ করা না করার স্বাধীনতার বিষয়গুলো।

সেকুলার-লিবারেল-জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার অনেকে বোরকা পরে ক্রিকেট খেলার বিষয়টি আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের সঙ্গে যায় না বলে মনে করেছেন। কেউ বলেছেন এই ছবির জনপ্রিয়তা নির্দেশ করে যে, আমাদের দেশ দিনে দিনে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে পরিণত হওয়ার পথে হাঁটছে। কেউ ঝর্ণার মত অ্যাথলেটের বোরকা পরা অথবা বিয়ের পরে খেলা ছেড়ে দেওয়াকে পিতৃতন্ত্রের জয় হিসেবে দেখেছেন। অন্যদিকে কেউ কেউ বলেছেন ঝর্ণার ছবি দেখিয়ে দিয়েছে পর্দা করেও মেয়েরা খেলাধুলায় অংশ নিতে পারে। কেউ বলেছেন ঝর্ণা বোরকার অবমাননা করেছেন। কেউ বলেছেন বোরকা পরার স্বাধীনতার কথা। কেউ বলেছেন সব আলোচনার ঊর্ধ্বে ছবিটি তুলে ধরেছে মাতৃত্বের জয়গান। নারীবাদী চিন্তাধারার অনেকে তুলে ধরেছেন ঝর্ণার ছবিটি কীভাবে আমাদের মগজে গেঁথে থাকা বাংলাদেশি মুসলিম নারীর জেন্ডার পারফরমেন্সকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কেউ বোরকার সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ককে তুলে ধরে দেখিয়েছেন শুধু ধর্ম দিয়ে এই সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় (বিবিসি বাংলা, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০)।

পুরো আলোচনাতেই অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। তবে আমরা যদি শুধু ঝর্ণা আক্তারের মাতৃত্ব অথবা বোরকা অথবা তার পছন্দ করা না করার স্বাধীনতার ওপরে ফোকাস করি, আমরা এই বিষয়গুলোর সঙ্গে বড় বড় নিপীড়নকারী কাঠামোগুলোর সম্পর্ককে উপেক্ষা করব। পিতৃতন্ত্র আর ধর্মের সঙ্গে এই ছবির সম্পর্ক ঘুরেফিরে বার বার এসেছে। কিন্তু এই ছবির সঙ্গে পিতৃতন্ত্র ছাড়াও পুঁজিবাদ, শ্রেণীর স্তরবিন্যাসসহ অন্যান্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান জড়িত। এই সম্পর্কগুলো খতিয়ে দেখতে পারলে আমরা বুঝতে পারব কীভাবে এই ছবিটি বাঙালি মুসলিম নারীর জটিল এবং দ্বান্দ্বিক জীবনকে তুলে ধরেছে এবং কেন আমাদের কাছে এই ছবিটি তুমুল আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।

পুরো ছবিটিতে স্থানের রাজনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্থান আমাদেরকে নির্ধারণ করে দেয় জেন্ডারভেদে নারী-পুরুষ কে, কোথায়, কী করবে। ঝর্ণা একজন নারী হিসেবে যখন বাসার সামনে তার ও তার ভাই-বোনের সন্তানদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলেন, তখন সেই খেলা আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয় না। কিন্তু একই খেলা তিনি তার সন্তানের সঙ্গে পল্টন ময়দানে খেললে সেটি অনেক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তার ক্লাস ফোরে পড়া ছেলে সন্তানও এই বয়সে বুঝে গেছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তার মাকে কোন জায়গায় কোন কাজটি করার অনুমতি দেবে। ইয়ামিন সিনান তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আম্মু, এখন তো এখানে কেউ নেই। তাহলে তুমি ব্যাটিং করো, আমি বোলিং করি, ঠিক আছে? ...তুমি বাসার নিচে আমার সঙ্গে কত সুন্দর ব্যাটিং করো। এখন কেন তুমি ব্যাটিং করবা না?’ স্থানের রাজনীতি ইয়ামিনের মত ছোট্ট একটি ছেলেও ভালোই বোঝে। আশেপাশে কেউ নেই জন্যই সে তার মাকে তার সঙ্গে ক্রিকেট খেলার জন্য অনুরোধ করে।

পুরো ব্যাপারটিতে স্থানের রাজনীতি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন আমরা দেখি ঝর্ণা ও ইয়ামিন আশেপাশে কেউ না থাকায় খেলা শুরু করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সাংবাদিকেরা তাদের ঘিরে ধরেন। অনেকে তাদের অনুমতি না নিয়েই ছবি তোলা শুরু করেন (বিডি সিলেট টিভি, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০)। ঝর্ণা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে তিনি ছবি তোলার অনুমতি দেন এই ভেবে যে, তিনি তো পর্দা করেই ছবি তুলছেন (গাংচিল, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০)। বোরকা পরার কারণেই তিনি ছবি তোলার অনুমতি দেন এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন। বোরকা পরা অবস্থায় না থাকলে তিনি হয় তো এতখানি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নাও করতে পারতেন। বোরকা নারীর গতিশীলতা রোধ করে কি না, তা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ঝর্ণা আক্তারের বোরকা তার গল্পটি চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে বড় একটি ভূমিকা রেখেছে।

ঝর্ণার ছবি বিষয়ক আলোচনায় আমরা আরেকটি ট্রেন্ড দেখতে পাই, তা হলো- বোরকার ওপর থেকে ফোকাস সরিয়ে তার মাতৃত্ব ও সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার বিষয়টিতে ফোকাস করার আহ্বান। মাতৃত্ব ও সন্তানের প্রতি ভালোবাসা মহান হতে পারে বা নাও হতে পারে। কিন্তু মাতৃত্বের একটি সুস্পষ্ট রাজনীতি আছে। মাতৃত্ব ব্যাপারটির সঙ্গে বিশুদ্ধ ভালোবাসা ছাড়াও আরও কিছু ব্যাপার জড়িত। এইচএসসির পরেই ঝর্ণার বিয়ে হয়ে যায় এবং তিনি সংসার সামলাতে গিয়ে একজন খ্যাতিমান অ্যাথলেট হয়ে ওঠার স্বপ্ন বিসর্জন দেন। তবে তার মানে এই না যে, ঝর্ণা একজন অবদমিত নারী যার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। তিনি তার বড় মেয়েকে জেন্ডার রীতি উপেক্ষা করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন। কিন্তু ছেলেকে তিনি মাদরাসা দিয়েছেন। আমাদের প্রচলিত উদারনৈতিক চিন্তাধারা হয়ত ঝর্ণার এই সিদ্ধান্তের কারণ বুঝে উঠতে পারছে না এবং এর উত্তর ঝর্ণাই ভালো জানেন। তবে ঝর্ণা স্বপ্ন দেখেন তার ছেলে একদিন মাদরাসা থেকে বের হয়ে বিকেএসপিতে সুযোগ পাবে এবং খ্যাতিমান একজন ক্রিকেটার হবে। তাই ঝর্ণা কি ক্ষমতায়িত নাকি নিপীড়িত– এই প্রশ্নের কোনো সোজাসাপ্টা উত্তর নেই।

মা হিসেবে ঝর্ণার প্রতিদিনের রুটিনের কথা চিন্তা করলে আমরা দেখব তিনি থাকেন শ্যাওড়াপাড়ায়। তার ছেলে সকালবেলায় আরামবাগের একটি মাদরাসায় যায়। মাদরাসা থেকে ফেরার পর বিকালে তিনি ছেলেকে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করার জন্য কবি নজরুল অ্যাকাডেমিতে নিয়ে যান। মা-ছেলের এই ছবিটি তাই শুধু একটি বিশুদ্ধ, অরাজনৈতিক ভালোবাসার নিদর্শন নয়। ছবিটি আমাদের শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের জন্য নারীর প্রতিদিনের অবৈতনিক গৃহস্থালি কাজের অসামঞ্জস্যপূর্ণ চাপেরও সাক্ষ্য দিচ্ছে।

মা-ছেলের ক্রিকেট খেলার ছবিটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আরেকটি বড় কারণ হলো- তারা এখানে ক্রিকেট খেলছে। ক্রিকেটের মত একটি করপোরেট পুঁজিবাদী পুরুষ আধিপত্যবাদী একটি ইন্ডাস্ট্রিতে বোরকা পরা মা এবং মাদরাসা পড়ুয়া সন্তানের অংশগ্রহণ আমাদের উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় আলোড়ন তোলে। পাবলিক পরিসরে এই ইন্ডাস্ট্রিতে অংশ নেওয়ার কারণে আমাদের অনেকে ঝর্ণার বোরকা পরা অথবা তার সন্তানের মাদরাসায় যাওয়ার বিষয়টি অনগ্রসরতার পরিচায়ক হিসেবে ধরে নিতে রাজি নন। আর দশজন মধ্যবিত্তের মত ঝর্ণাও স্বপ্ন দেখেন তার ছেলে ক্রিকেট খেলে মধ্যবিত্ত টানাপড়েনের জীবন থেকে বের হয়ে একদিন সাকিব আল হাসানের মত বিখ্যাত (এবং বিত্তবান) হবে। ঝর্ণা নিজেই আশি এবং নব্বই দশকের অ্যাথলেট ছিলেন। শটপুট, দীর্ঘলম্ফ, বর্শানিক্ষেপ এবং দুইশ ও চারশ মিটার রেসের মত প্রতিযোগিতায় তিনি নিয়মিত অংশ নিয়ে সফল হয়েছেন। কিন্তু সন্তানকে তিনি তার মত ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলেট হিসেবে গড়ে তুলতে চাননি। তিনি স্বপ্ন দেখছেন সন্তানকে বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার বানাবেন।

ঝর্ণার প্রজন্ম থেকে ইয়ামিনের প্রজন্মের স্বপ্নের এই রূপান্তর নিয়ে আমাদের ভেবে দেখার অবকাশ আছে। নয়াউদারনৈতিক বিশ্বায়ন আর অর্থব্যবস্থা দিনে দিনে সুকৌশলে আমাদের ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলোর মধ্যে যেগুলো ব্যবসায়িক মূলধন তৈরি করতে পারছে না, সেগুলোকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারত এখন ক্রিকেট বিশ্বে সুপার পাওয়ার। সারাবিশ্বের এক বিলিয়ন ক্রিকেট ভক্তের নব্বই শতাংশই ভারতবাসী (দ্য ইকনমিক টাইমস, ২৭ জুন ২০১৮)। আইপিএলের বাজারমূল্য এখন প্রায় ৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার (সিএনবিসি, ১ আগস্ট ২০১৮)। ভারতীয় ক্রীড়া অর্থনীতির প্রায় পঁচাশি ভাগ দখল করে নিয়েছে ক্রিকেট (এক্সচেঞ্জ ফোর মিডিয়া, ২১ মে ২০২০)। এই চিত্র দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে প্রায় একইরকম। ক্রিকেটের এই নব্যউদারনৈতিক আগ্রাসন আমাদের অবচেতন চিন্তাধারাকেও গ্রাস করেছে। আর তাই বোরকা পরা মা আর মাদরাসা পড়ুয়া সন্তানকে বাজার অর্থনীতির তালে তাল মিলিয়ে ক্রিকেট খেলতে দেখলে আমরা আপ্লুত হই। এই মা ও সন্তান যদি ক্রিকেট না খেলে ব্যাডমিন্টন বা কানামাছি খেলতেন, তাহলে কি তারা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একইরকম মনোযোগ পেতেন?

একজন আপাতদৃষ্টিতে রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত মায়ের পিতৃতান্ত্রিক জেন্ডার কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে বাজার অর্থনীতির তৈরি করে দেওয়া স্বপ্ন পূরণের অনন্য প্রচেষ্টার কারণেই এই ছবিটি গণমানুষের মাঝে এত সাড়া জাগিয়েছে।

নাফিসা তানজীম, যুক্তরাষ্ট্রের লেযলি ইউনিভার্সিটির জেন্ডার, রেস ও সেক্সুয়ালিটি এবং গ্লোবাল স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Hasina sued over shop owner's death

Hasina's extradition: India to deal with govt thru diplomatic channel

India will handle the matter of ousted prime minister Sheikh Hasina's extradition with the Bangladesh government through diplomatic channels, stated Indian external affairs minister S Jaishankar

Now