পরামর্শক কমিটি পরামর্শ দিচ্ছে, কিন্তু শুনছেন কে?
দেশে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির দেওয়া পরামর্শগুলোর বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। পাশাপাশি ঘর থেকে বের হলে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আছে বলে মনে হয় না। যেন সবকিছুই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সবকিছুই পুনরায় চালু হয়ে গেছে। স্যানিটাইজ তো দূরের কথা, এখন মানুষকে তেমন একটা মাস্কও পরতে দেখা যায় না।
জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শগুলো শোনা হচ্ছে না কেন? যদি শোনা হয়, তাহলে বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না কেন? অনেকেই এমন সমালোচনাও করেন যে, কমিটির দেওয়া পরামর্শগুলোই সঠিক নয়। আসলে কি তাই? আমাদের দেশে সংক্রমণের বর্তমান অবস্থা কেমন? বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের করণীয়?— এসব বিষয়ে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এবং কমিটির আরেক সদস্য, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
পরামর্শক কমিটির পরামর্শগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘পরামর্শগুলো শোনা হচ্ছে না বলা মুশকিল। কিন্তু, সবকিছুই কেমন যেন বিলম্বিত করে ফেলছে। যেমন: আমরা প্রথম থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথাই বলছি। এর মধ্যে, একটা প্লাটফর্ম করার জন্য বলেছিলাম, যার মাধ্যমে কোন হাসপাতালে কতগুলো আসন ফাঁকা আছে, তা জানা যাবে। এটা বলেছিলাম কারণ, শুরুর দিক থেকে আমরা দেখছিলাম, রোগীরা খুব ভোগান্তির মধ্যে আছে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করছে। এর জন্যেই আমরা ওয়েবসাইট প্লাটফর্মটি করতে বলেছিলাম। যাতে রোগীদের ভোগান্তি না হয়। এটা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।’
‘এরপর অ্যান্টিজেন টেস্টের বিষয়টি আমরা অনেক আগে বলেছিলাম। মে মাসের শেষে দিকে। অথচ এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে ফলপ্রসূ কোনো অগ্রগতি নেই। এখন বলা হচ্ছে, তারা কাজ করছেন, এগুলো প্রক্রিয়াধীন। ভ্যাকসিনের বিষয়ে আমরা যেটা বলেছি, সেই বিষয়ে তারা চেষ্টা করছে। আসলে বিষয়গুলো কেমন যেন বিলম্বিত হয়ে যাচ্ছে। আবার কিছু কিছু জিনিস আছে যে তারা করতে পারছে না। যেমন: আমরা প্রথম থেকেই বলছিলাম, সরকারি ব্যবস্থাপনায় আমাদের চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবার থাকার ব্যবস্থা করা। আমরা হোটেলের কথা বলিনি। বলেছি, মানসম্মত থাকার ব্যবস্থা করা। যাতে তাদের পরিবারের কেউ আক্রান্ত না হয়। এ বিষয়ে এখনো তেমন কিছু হয়নি। তারা হোটেলে রাখার বিষয়ে অনাগ্রহী। কিন্তু, এর পরিবর্তে যে বিকল্প ব্যবস্থা করা দরকার, সেটা এখনো হয়নি। তবে, সচিব (স্বাস্থ্য) আমাদের সঙ্গে সভা করেছেন এবং এ বিষয়ে তিনি খুবই ইতিবাচক। কিন্তু, এখনো এই প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হয়নি। তাই সবমিলিয়ে আমি বলব না যে, তারা আমাদের পরামর্শগুলো শুনছে না। বিষয়টি হচ্ছে, সবকিছু বিলম্বিত হচ্ছে। তবে, আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ফল না দেখি, ততক্ষণ পর্যন্ত তো আমরা ধরে নেই যে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রশ্ন আসে যে, তারা কি বিষয়গুলো আমলে নিচ্ছে না? মূল বিষয় হচ্ছে, আমরা সবাই দ্রুত বাস্তবায়ন আশা করছি এবং সেটা হচ্ছে না’, বলেন তিনি।
পরামর্শক কমিটির পরামর্শগুলো ঠিক নেই বলে যে সমালোচনা, সেই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আসলে প্রথম দিকে প্রশাসনের মধ্য থেকে অনেকেই এমনটা বলেছেন। তবে, আমি মনে করি, দায়িত্বশীল কেউ বা যারা নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের, তাদের কেউ এমন নেতিবাচক কথা বলেননি। এটা অধস্তন পর্যায়ের কেউ কেউ প্রথম দিকে বলেছেন, আমরা শুনেছি। আমরাও তখন আমাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছি, তাদেরকে তিরস্কারও করেছি।’
দেশে বর্তমানে করোনার সংক্রমণের অবস্থা স্থিতিশীল বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমানে শনাক্তের হার কম। তবে, মৃত্যুহার আবার বাড়ছে। সব বিবেচনায় আমি বলব না যে, আমাদের শৈথল্যের কোনো সুযোগ আছে। আমি মনে করি যে, আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশ যারা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল, সেখানে আবার সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ তো বিশ্বের বাইরের কোনো দেশ না। তাই আমাদের দেশেও আবার সংক্রমণ বাড়তেও পারে। আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের এখানে যেহেতু মার্চ থেকে সংক্রমণ, তখন থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের দুর্বলতার জায়গাগুলো তো চিহ্নিত হয়েছে। আমি মনে করে, সেগুলো বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে এখনই পরিকল্পনা করে রাখা উচিত।’
‘আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের একটা বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে যে, এই যে ভ্যাকসিন নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু, ভ্যাকসিন আমরা বা পৃথিবীর মানুষ কবে পাবে, এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া খুবই মুশকিল। সেজন্য আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার যে অভ্যাস, সেটার ওপর জোর দেওয়া দরকার। গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও সরকারি কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। যাতে আমাদের দেশের মানুষ মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করে এবং অহেতুক জনসমাগম না করে। এগুলোও ভ্যাকসিনের মতো কার্যকরী। এগুলো মানতে হবে কারণ করোনার সংক্রমণ সহজে পৃথিবী থেকে যাবে বলে মনে হয় না। আমি এপ্রিলের প্রথম দিকেই বলেছিলাম যে, এই সংক্রমণ সহজে যাচ্ছে না। তাই আমাদেরকে সর্বোচ্চ সতর্কতা পালন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা অবশ্যই ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষা করব। কিন্তু, ভ্যাকসিনই একমাত্র পথ না। এখানে জনসচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানার বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।’
পরামর্শগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার চেষ্টা করছে। আমরা অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন টেস্টের বিষয়ে বলেছি। সেটা তারা বোধহয় সিদ্ধান্ত নেবে। সরকার অ্যান্টিজেন টেস্টের ভালোমানের কিট খুঁজছে। ভালোমানের কিট পেলেই হয়তো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদন দেবে। তবে, কাজগুলো আরও দ্রুত হওয়া উচিত। এগুলো খুব ধীরে হচ্ছে। অ্যান্টিবডি টেস্ট আসলে আমরা কতগুলো কাজ করতে পারব। যেমন: যদি সেরোসার্ভেইল্যান্স করা যায়, তাহলে যখন ভ্যাকসিন আসবে, তখন বোঝা যাবে যে এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। আবার কতগুলো বিষয়ে অনেক আগে আমরা বলেছিলাম। যেমন: প্লাজমা থেরাপির বিষয়ে বলেছিলাম। কিন্তু, এটা নিয়ে এখন তো আর কোনো কথাই শোনা যায় না। আমরা সেটা তাড়াতাড়ি করতে বলেছিলাম।’
‘আবার চিকিৎসকসহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের আবাসনের বিষয়ে আমরা প্রত্যেক সভায় কথা বলেছি। গত সভাতেও বলেছি যে, তাদেরকে টাকা দিয়ে দেওয়া হলো, তারা ব্যবস্থা করে নেবে, এগুলো ঠিক না। তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে হোটেলই দিতে হবে, তা নয়। এটা তো অন্যভাবেও করা যেতে পারে। একজন চিকিৎসককে টাকা দিলেন, তিনি বাসা খুঁজবেন কখন আর কাজ করবেন কখন? বাসা খোঁজাটাও তো কাজ। এখন তিনি বাসা খুঁজবেন নাকি চিকিৎসা দেবেন? আসলে চিকিৎসকদের আবাসনের বিষয়ে ব্যবস্থাপনায় একটা বড় সমস্যা হয়েছে’, বলেন তিনি।
কমিটির পরামর্শ নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোন পরামর্শ ঠিক নেই তা তো বলতে হবে। আমরা তো অনেক পরামর্শ দেই। আমরা তো বলব আমাদের পরামর্শগুলো ঠিক। নির্দিষ্ট করে বলতে হবে যে কোন পরামর্শটা ঠিক না। আমরা চিন্তা-ভাবনা করেই পরামর্শ দেই।’
দেশে বর্তমানে শনাক্তের হার ১১-১২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু, এই অবস্থায় থাকলে চলবে না বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে নিয়ে যেতে হবে। এখন এটি পাঁচ শতাংশের নিচে নিয়ে যেতে হলে কিছু কাজ করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে মানুষকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ, মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখা, স্যানিটাইজ করা, এগুলো তো করতে হবে। এখন আমরা যদি রাস্তাঘাটে বের হই, তাহলে দেখি বেশিরভাগ মানুষ মাস্ক পরে না। এদিকে আমাদের কার্যক্রমটা জোরদার করতে হবে। আরেকটা বিষয়ে নিয়ে এখন কেউই কথা বলে না। তা হলো লকডাউন। আমাদের এখানে টোলারবাগ, পূর্ব রাজাবাজার ও ওয়ারী লকডাউন করা হয়েছিল। আর কোথাও হয়নি। আমি মনে করি, লকডাউন নয়, আইসোলেশন কার্যক্রম বাড়ানো দরকার। ব্যাপক হারে পরীক্ষা করতে হবে এবং শনাক্তদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। লকডাউন আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়। সব বন্ধ করে রাখলাম, কাউকে কোথাও যেতে দিলাম না, যারা কাজে বা অফিসে যাবে, তাদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করে ফেললাম। এত বেশি কাজ তো হাতে নেওয়ার দরকার নেই। এতে তো মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। মানুষের মনে ভীতি তৈরি হয়।’
‘এটাই ফলপ্রসূ যে, পরীক্ষা করা, শনাক্ত হলে আইসোলেশন করা। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে যদি কাজটি করা যেত, তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো। যেসব জেলা শহরে সংক্রমণের হার বেশি, সেখানে রোগী শনাক্ত করে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা দরকার। আইসোলেশনের জন্য জায়গা তো আমাদের কম নেই। এখন তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ। কিন্তু, সেটা তো করা হলো না। এটা করা হলে এবং মানুষ ব্যক্তিগত সুরক্ষা বজায় রেখে চললে আমাদের সংক্রমণের হার আরও কমে যেত। সংক্রমণ না কমাতে পারলে তো আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে পারছি না। আর যানবাহনের দিকে নজর দিতে হবে। মানুষ গণপরিবহনে চলাচল করছে। কিন্তু, যদি মাস্ক না পরে চলাচল করে, তাহলে তো ঝুঁকি বাড়বে। এক্ষেত্রে বাসের চালক ও চালকের সহায়ককে দায়িত্ব দিতে হবে। তারা বিষয়টি তদারকি করবে যে, যাত্রীরা যাতে মাস্ক পরে বাসে যাতায়াত করে’, যোগ করেন তিনি।
বর্তমানে পরীক্ষা কম হচ্ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের পরীক্ষার সংখ্যা বর্তমানে কমে গেছে। এখন পরীক্ষার সংখ্যা ১১ থেকে ১৩ বা ১৪ হাজারের মধ্যে আটকে গেছে। নমুনার সংখ্যা আর বাড়ছে না। নমুনা সংখ্যা বাড়লে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়। এত কম নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে সারাদেশে কাভার হচ্ছে কি না, আমরা জানি না। এখানে আরেকটা বিষয় হলো, তথ্যপ্রবাহটা কমে গেছে। দুপুর আড়াইটার দিকে করোনার যে ব্রিফিং হতো, যেটা না হওয়ার কারণে আমরা ঠিক সময়ে তথ্য পাচ্ছি না। আগে নির্দিষ্ট একটা সময়ে এই তথ্যটা পাওয়া যেত। যেটা এখন হয়তো টেলিভিশন স্ক্রলে দেখছি। এখন এটা বিলম্বিত হওয়া তো বাঞ্ছনীয় না। এখন মানুষ বলছে যে, কোথাও তো করোনার খবর পাই না। আপনারা শুধু মাস্ক পরতে বলেন। মানুষ ভাবছে করোনা বোধহয় শেষ হয়ে গেছে।’
Comments