প্রবাসে

ফ্রান্সের পেই দে লোয়ায় চার দিন

গ্রীষ্মের ছুটি মূলত ইউরোপিয়ানদের কাছে সারা বছরের এক উৎসব আনন্দের প্রতীক্ষা। ইউরোপজুড়ে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয় জুলাই থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। কর্মক্ষেত্রে চলে কর্মীদের অবকাশ যাপনের উৎসব। বেড়ে যায় দূরবর্তী বিমান, ট্রেন, বাসের টিকিটের দাম। হোটেল রেস্তোরাঁগুলো ব্যস্ত সময় পার করে। গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরাও ঠিক করলাম সক্রেটিস-প্লেটোর দেশ গ্রিসের রাজধানী এথেন্স ঘুরতে যাব।
ফ্রান্সের নন্ত শহরের কেন্দ্রস্থল প্লাস রয়্যাল। ছবি: লেখক

গ্রীষ্মের ছুটি মূলত ইউরোপিয়ানদের কাছে সারা বছরের এক উৎসব আনন্দের প্রতীক্ষা। ইউরোপজুড়ে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয় জুলাই থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। কর্মক্ষেত্রে চলে কর্মীদের অবকাশ যাপনের উৎসব। বেড়ে যায় দূরবর্তী বিমান, ট্রেন, বাসের টিকিটের দাম। হোটেল রেস্তোরাঁগুলো ব্যস্ত সময় পার করে। গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরাও ঠিক করলাম সক্রেটিস-প্লেটোর দেশ গ্রিসের রাজধানী এথেন্স ঘুরতে যাব।

প্রথমত এথেন্সের হোটেল ভাড়া ও খাবার খরচ ইউরোপের অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম এবং অনেক আগে বিমান টিকিট করলে সাশ্রয়ী দামে যাতায়াত করা যায়। তবে আগে টিকিট করতে পারিনি। যাওয়ার আগে প্যারিস-এথেন্সের বিমান ভাড়া দেখে হতাশ হলাম। বাধ্য হয়ে ফ্রান্সের মধ্যে কোনো সমুদ্রের নিকটবর্তী শহরে এবার গ্রীষ্মের ছুটি কাটাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ইন্টারনেট ঘোরাঘুরি করে আমাদের ভ্রমণ গন্তব্য ঠিক হলো ফ্রান্সের পেই দে লোয়া (Paye des loire) অঞ্চলের প্রধান শহর নন্তে (Nantes)।

ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ আগস্ট, ২০১৯ যাত্রা, ফেরত ১৩ আগস্ট। সকাল ৭টার ট্রেনের টিকেটের মূল্য সুলভ হওয়ায় সেই ট্রেনের টিকিট করলাম। আমাদের মেয়ে মিশেল বেড়াতে যাওয়া খুবই পছন্দ করে। টিকিট কাটার পর আমার চিন্তা শুরু হয় বাগানের গাছগুলোকে নিয়ে। গরমের সময় রোজ নিয়ম করে পানি না দিলে প্রাণ যায় যায় অবস্থা!

প্যারিসে আমাদের বেশ কিছু পারিবারিক বন্ধু আছেন। যে কোন বিপদে পাশে এসে দাঁড়ান। কিন্তু গাছগুলোর জীবন রক্ষার্থে কোন বন্ধুর সাহায্য চাইতে দ্বিধা লাগে। কারণ এখানকার ব্যস্ততা ভিন্ন রকম। কারো পেশাগত কাজের ব্যস্ততা, আবার সেটা না থাকলেও সরকারি প্রশাসনিক দৌড়াদৌড়ি  লেগেই থাকে। তবুও এরমধ্যেই একে অন্যের প্রয়োজনে ছুটে যায় প্রবাসীরা। যাই হোক দ্বিধার কারণে কাউকেই বলা হলো না, বরং গাছের গোড়ায় বেশি পানি দিয়ে গেলাম।

৯ আগস্ট ট্রেন ছাড়ল প্যারিসের মোঁপারনাস স্টেশন থেকে। পরের তিন ঘণ্টা জান্নাত ও মিশেলের সঙ্গে গল্পগুজব। সকাল ১০টায় নন্ত ট্রেন স্টেশনে নেমেই বৃষ্টির কবলে। আমরা যে এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছিলাম সেখানে ওঠার কথা বিকেল ৩টায়। ফোন নম্বরে কল করে জানতে চাইলাম আগে ওঠা যাবে কী না? উত্তরে বলল, এখনো আগের অতিথিরা আছেন। পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগেজ নিয়ে কোথায় যাব? তারা তখন একটা ঠিকানা পাঠালো। ততক্ষণে সবার খিদে লেগেছে।  

স্টেশনের দোকানগুলোতে চেয়ার খালি না পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু একটাও বুলনজারি (রুটির দোকান) পেলাম না। একটু হতাশ হলাম, পয়সা খরচ করে কোন ভূতুড়ে শহরে এসে পড়লাম! প্যারিসের বাইরে ফ্রান্সের অন্য শহরগুলোতে যে জনশূন্য ভাব সেই অভিজ্ঞতা আমার আছে। রাস্তার মধ্যে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো, তাই আবার স্টেশনে এলাম। ফিরে এসে দেখি স্টেশনের রুটির দোকানের কয়েকেটি চেয়ার খালি। সবাইকে নিয়ে সেখানে খেয়ে আস্তে ধীরে বের হলাম। এরপর বাসে করে নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে লাগেজগুলো রাখলাম।

অচেনা শহরের বুকে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে চোখে ধরা পড়ল মাকডোনাল্ড রেস্টুরেন্ট। পাশেই দুটি তার্কিশ কাবাবের দোকান। মাকডোনাল্ডে বাচ্চাদের খাবারের সাথে একটা খেলনা থাকে। সেখানেই গেলাম। খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ করে একটু সামনে এগুতেই চোখে পড়ল বিশাল এক চত্বর। মাঝে বড় আকারের একটি ভাস্কর্য। চারপাশে উছলে পড়ছে পানির ঝর্ণা। বড় ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে পুরো চত্বর জুড়ে শত শত ছোট বড় ভাস্কর্য। যেগুলোর মধ্যে আছে পৃথিবীখ্যাত ভাস্কর্যের কপি। যেমন- আমেরিকার স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ব্রাজিলের ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার। এমন সব ভাস্কর্যের সাথে এই চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে পৌরাণিক গ্রিক দেব-দেবী ও রূপকথার নানা কাল্পনিক চরিত্রও। মনে হলো, চত্বরটিতে পৃথিবীর সব বিখ্যাত ভাস্কর্যের মিলনমেলা চলছে।

এই স্থানটির নাম প্লাস রয়্যাল। নন্ত শহরের কেন্দ্রস্থল বলা হয়। এই বিশাল চত্বরের মাঝে বৃহৎ গোলাকার একটি ঝর্ণা এবং ঝর্ণার চারপাশে কয়েকটি মূর্তি বসানো। নন্তের স্থপতি মাথুরিন ক্রুসি ১৭৮৬ সালে এটির নকশা করেন এবং ১৭৯০ সালে নির্মিত হয়। এই চত্বরে ফ্রান্সের অন্যান্য স্থানের মতো বিশেষ কোন রাজার মূর্তি রাখা হয়নি। কিন্তু স্থানটির আলাদা এক প্রতীকী মূল্য রয়েছে। স্থানটি এই শহরের উৎসব আনন্দ, আড্ডা, রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

কিছু কিছু মূর্তির গায়ে লাগানো রয়েছে ছোট ছোট কিছু পোস্টার। একটি পোস্টারের লেখা ভাবনার জন্ম দিলো। পোস্টারে ফরাসি ভাষায় যা লেখা তার মানে দাঁড়ায়- ‘বিচার কোথায়?’ ফ্রান্স নারী পুরুষের সমঅধিকারের দেশ। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণিভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিটি মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়।

চত্বরের মূর্তিগুলির সাথে আমাদের ভালো একটা সময় কাটল। ঘড়ির কাঁটায় বেলা ২টা বাজতেই আমরা ছুটে গেলাম আমাদের লাগেজগুলো সংগ্রহে। এপার্টমেন্ট ভাড়া প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের অফিসের কর্মরত তরুণী আমাদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন, কীভাবে আমাদের এপার্টমেন্টে পৌঁছুতে হবে।

এই শহরে মেট্রোরেল নেই। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মধ্যে ট্রাম ও বাস সার্ভিস রয়েছে। তিনটি ট্রাম লাইনের মাধ্যমে শহর ও শহরতলিতে সহজেই যাতায়াত করা যায়। জটিলতায় না গিয়ে আমরা হেঁটে মিডিয়াটেক ট্রামস্টেশনে এলাম। আমাদের যেতে হবে তেরত নামক জায়গায়।

ম্যাপ দেখে ট্রামের সঠিক দিক নির্ধারণ করে উঠলাম। আমার ধারণা ছিল, নন্ত শহরের আশেপাশে হবে আমাদের এপার্টমেন্ট। কিন্তু ট্রাম একের পর এক স্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চলতে লাগল। ট্রামের জানালা দিয়ে দেখছি নতুন শহর। গ্রীষ্মের আলো ঝলমল দুপুর, সূর্যের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে, রাস্তার ধার ও বাড়ির আঙ্গিনায়গুলোতে ফুলের বাহার।

সুপরিকল্পিত শহর কিন্তু জনমানবের আনাগোনা খুব কম। যতগুলো বিল্ডিং দাঁড়িয়েছে ততগুলো মানুষ চোখে পড়লো না। মনে হচ্ছে একটি ফুল বাগানের মধ্যদিয়ে আমাদের ট্রাম এগিয়ে যাচ্ছে। এতটাই সুপরিকল্পিত শহর। প্রায় ত্রিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে চলে এলাম আমাদের গন্তব্যের তেরত স্টেশনে।

এক পথচারীকে আমাদের ঠিকানা দেখিয়ে জানতে চাইলাম কীভাবে যেতে হবে। ট্রাম স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। তাই বাসা খুঁজে পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এলাকা। আমাদের বাসার বিল্ডিংটিও আধুনির নকশায় গড়া। চুক্তিপত্রে উল্লেখিত বাসায় প্রবেশের কোড ও নির্দেশাবলী অনুসরণ করে বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করলাম কিন্তু আমাদের নির্ধারিত ফ্ল্যাট নম্বরের পাশে এসে একটু বিড়ম্বনায় পড়তে হলো। ধারণা ছিল কেউ একজন এপার্টমেন্টের চাবি এখানে এসে বুঝিয়ে দেবে। কাউকে না পেয়ে একটু হতাশ হলাম।

ফ্লোরের অন্যান্য ফ্লাটে উঁকিঝুকি দিয়ে কারও দেখা মিলল না। ঠিকানা মতো চলে এসে এখন বন্ধ দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে তার উপর এতোবেলা বাইরে এলোমেলো ঘোরাঘুরির ধকলে সবার মধ্যে ক্লান্তি চলে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ এলোমেলো চেষ্টা করে বাধ্য হয়েই এপার্টমেন্ট ভাড়া প্রদানকারী অফিসে ফোন দিলাম।

ফোনের অপর প্রান্তের দায়িত্বরত ব্যক্তি বললেন, আপনার এপার্টমেন্টের প্রবেশ দরজার ডানপাশের নিচে ছোট্ট একটি বাক্স লাগানো রয়েছে, বাক্সটি আপনার চুক্তিপত্রে উল্লেখিত কোড নম্বর দিয়ে খুলতে হবে, ওই বাক্সটির মধ্যে চাবি রয়েছে। ভদ্রমহিলার কথা মতো নিচের দিকে তাকাতেই দেখা মিলল দরজার এক কোণে কোড নম্বর সম্বলিত চিকন ম্যাচ বাক্স আকৃতির ছোট্ট কিছু। উল্লেখিত কোড নম্বর সঠিকভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেলাতেই ছোট্ট বাক্সের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রবেশ দরজার চাবি। এমন ব্যতিক্রম পদ্ধতির সাথে জীবনে এই প্রথম সাক্ষাৎ ঘটলো আমাদের।

কোন মানুষ ছাড়াই শুধু পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ব্যবসা পরিচালনা। বেশ ভালো লাগলো। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করে দারুণভাবে হোঁচট খেতে হল। ঘরটি পরিস্কার করা হয়নি। কর্তৃপক্ষকে জানাতেই তারা দুঃখ প্রকাশ করে একজনকে পাঠিয়ে দিলো পরিস্কার করতে। রুমে উঠে কিছু জিনিসপত্র কিনতে বাইরে বেরুলাম।

রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল, জনমানবের কোলাহলমুক্ত এলাকা। রাস্তার পাশে একটি স্যান্ডউইচের দোকানে কিছু তরুণ আড্ডা দিচ্ছে। তাদের জিজ্ঞেস করলাম কারফো সুপার স্টোরে কীভাবে যাব। খুব সহজ করে রাস্তা দেখিয়ে দিলো। নতুন এলাকা আমরা হেঁটে হেঁটে এগুচ্ছি। খুব ভালো লাগছে। আসলে প্রতিটি নতুনের এক আলাদা ভালোলাগা রয়েছে। সে জন্যই হয়তো নতুন এলাকা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি।

সুবিশাল মার্কেট, প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দোকান রয়েছে। আমরা কারফো সুপার স্টোরে ঘুরে ঘুরে চাল, ডাল, সকালের নাস্তার কিছু ফল ও মিশেলের প্রয়োজনীয় খাবার সামগ্রী কিনলাম। ফিরে এসে দেখি আমাদের এপার্টমেন্টটি চকচকে তকতকে করে মেয়েটি চলে গিয়েছে। মিশেল তার নিজস্ব রুম পেয়ে খুব খুশি। জানালার ওপাশে প্রশস্ত আঙ্গিনা। রুমের ভেতর থেকে বিশাল আকাশ দেখা যায়। সে অনেকক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এলাকার আশপাশ দেখতে লাগলো।

আমরা তিনজন বারান্দায় গিয়ে বসলাম। রাত ১০টা বাজলেও সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ আগে। চারদিকে বিজলি বাতি জ্বলে উঠলেও প্রকৃতিতে রাতের আবহ এখনো নামেনি। দিনের আলো কিছুটা রয়ে গিয়েছে। বারান্দার সামনে কোন বড় বিল্ডিং নেই। ছোট ছোট পাভিয় বাড়ি। তাই সন্ধ্যার ফুরফুরে বাতাস হু হু করে ছুটে এসে গায়ে লাগছে। আমাদের এপার্টমেন্টটি দ্বিতীয় তলায়। বিল্ডিংয়ের নিচে গাড়ি পার্কিংয়ের প্রশস্ত জায়গা। পার্কিংয়ের পাশের একটি বাড়ির আঙ্গিনায় চলছে উৎসব আনন্দ। হালকা গানের সাথে অনেকে নাচছে, কেউ পান করছে। বারান্দায় গল্প করতে করতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে এলো। আমরা ঘুমাতে গেলাম। কারণ আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় রয়েছে প্রথম দিন নন্ত শহর ঘুরে দেখা।

(লেখক: ফ্রান্সের প্যারিসে বসবাসরত)

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

13h ago