ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ কেন?
বিগত কয়েক বছর ধরে যেখানেই কোনো ঘটনা ঘটে, বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে, তার সবকিছুর সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে ছাত্রলীগের নাম আসে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়ন কিংবা ধর্ষণ— যত অভিযোগ, সবই তাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের যত সফল আন্দোলন, তার প্রায় সবকটির সঙ্গেই ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা আছে। সেই ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে কেন এত অভিযোগ? এর কারণটা কী? এ বিষয়ে শিক্ষকরা কী মনে করেন?
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন ও অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
যে দলই ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের ছাত্র সংগঠনই অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে এবং সাংগঠনিক শক্তি দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত করে, এটিই মূল সমস্যা বলে মনে করেন অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘সাংগঠনিক শৃঙ্খলার জায়গায় যদি শক্ত থাকা না যায়, তাহলে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখাটা সম্ভব হয় না। এই যে আমরা বিভিন্ন ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো দেখছি, এর কারণই হলো সাংগঠনিক শৃঙ্খলা না থাকা। ছাত্রদের সময়টাই হচ্ছে শিক্ষাগ্রহণের। এ সময় যদি তাদের নানা ভুল-ক্রুটি হয়, সেটি সংশোধনের দায়িত্ব শিক্ষক, অভিভাবক ও তারা যে রাজনৈতিক দলের, সেই দলের। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়, আমরা অভিভাবকত্বের দায়িত্বে অবহেলা করি ও সতর্ক থাকি না। পাশাপাশি যাদেরকে ছাত্র সংগঠনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদেরও দায়িত্ব আছে। তারা সে দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেনি। আমরা দেখেছি, নানা রকমের অনিয়মের সঙ্গে থাকার কারণে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
তবে, যেখানে সমাজের চারদিকে এত অনিয়ম-দুর্নীতি, সেখানে শুধু ছাত্রদের দোষ দেওয়া যায় না বলে মনে করেন ঢাবির সাবেক এই উপাচার্য। তিনি বলছিলেন, ‘সমাজের চারদিকে অনিয়ম ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের মাধ্যমে আমরা নিজের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করি। এর মাধ্যমে ছাত্র সংগঠনগুলো কিছুটা সুযোগ পেয়ে যায়। নিরেট লোভটা সমাজের সর্বস্তরে পেয়ে বসেছে। যার প্রভাব ছাত্র সংগঠনের ওপরেও পড়েছে। এ লোভ সামলানোর শিক্ষাটা যদি ছাত্রদের না দেওয়া যায়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলবে। ছাত্ররা চাঁদাবাজি-দুর্নীতি-অপকর্ম করছে, সেই দায়-দায়িত্ব তো শিক্ষকদেরকেও নিতে হবে। কারণ, তাদের সঠিক শিক্ষাটা আমরা দিতে পারছি না। কেন পারছিনা? এই দেশেই তো ছাত্ররা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, অন্যের উপকারের জন্য জীবন দিয়েছে। সেই দেশের ছাত্রদের এই ধরনের অপকর্মের তালিকা আসবে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণ করা যায় না।’
এর জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা ছাড়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন, সরকারি আমলা, রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, সচিব, কাউকেই সংশোধন করা যাবে না। নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে শিক্ষকদের এই চেষ্টাটা করতে হবে। আর ইতোমধ্যে যারা বড় পর্যায়ে আছে, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আদালত বা দুদক তো আছে।’
সিলেটের এমসি কলেজে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগের ছয় কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হলো। এর আগেও, ২০১২ সালে কলেজটির ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়া মতো ঘটনার অভিযোগ আসলো। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আসলে ছাত্রলীগ বলে কথা না। বিএনপির আমলের দিকে তাকালে ছাত্রদলের কী কী ঘটনা সেটা আমি নিজে ক্যাম্পাসে দেখেছি। তাই এগুলো আলাদা বলে তো আর লাভ হবে না। রোগের লক্ষণ তো একই। রোগ তো একটাই। তাই আমাদের দেখতে হবে সমস্যাটা কোথায়। এই ধরনের ননা অভিযোগ অনেক ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধেই বলা যাবে। বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দলের শৈথিল্যতাও রয়েছে। ভালো নেতাকর্মীও তো সংগঠনে রয়েছে এবং তাদের সংখ্যাই বেশি। অপকর্মগুলো করছে অল্প কয়েকজন। কিন্তু, অপকর্মের মাত্রা এতই বেশি যে, ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করতে হলো। এই যে ব্যবস্থা নেওয়া, এটা দ্রুত নেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা দরকার। আর তাদেরকে শিক্ষাটা দিতে হবে।’
বিষয়টি শুধু ছাত্রলীগের নয়, আমাদের পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনাগুলো হওয়ার কারণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠান বিকশিত না হওয়া। যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলের ছাত্র নেতাদের মধ্যেই এমন জিনিস তৈরি হয়। এখন দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তাই তাদের ছাত্র সংগঠনের একটার পর একটা ঘটনা আসছে। যতদিন পর্যন্ত দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা চালু না থাকবে, যোগ্য লোক যতক্ষণ পর্যন্ত পার্টির মধ্যে না থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটা উন্নত হতে থাকবে।’
যারা প্রকৃত অর্থে ছাত্রলীগ বা যেকোনো দলের ছাত্র সংগঠন করে, তারা এ ধরনের কাজ করবে না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা এগুলো করছে, তারা আসলে সুবিধাবাদী। তাদের কোনো দল নেই। যে দল ক্ষমতায় আসে, তারা সেই দলেরই নেতা হয়ে যায়। এখন যে দল ক্ষমতায় আছে, যদি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই ছাত্র সংগঠনকে গুরুতরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে যা ঘটার তাই ঘটছে। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল বা যেকোনো দলের ছাত্র সংগঠন এগুলো করবে। দল ক্ষমতায় থাকলে ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। রাতকে দিন, দিনকে রাত করতে পারে। অন্যায়কে ন্যায়, ন্যায়কে অন্যায় বানাতে পারে। বহু মানুষ এগুলোর ভুক্তভোগী। এগুলোর বিচারও হয় না। কিছু কিছু হয়তো হচ্ছে। তবে, খুব ধীর প্রক্রিয়ায় বা খুবই সামান্য শাস্তি। কিন্তু, রুট লেভেল থেকে এগুলোকে খতম করার জন্য যে প্রক্রিয়া চালু করা দরকার, তা হচ্ছে না।’
‘কোনো ঘটনা ঘটার পর হয়তো আমরা রিঅ্যাক্টিভ ব্যবস্থা নিতে দেখতে পাই। অর্থাৎ হয়তো গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু, এরপর কি আর বিচার হচ্ছে? অর্থাৎ প্রোঅ্যাক্টিভ ব্যবস্থাটা কী? এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানো না হলে এগুলো ঘটতেই থাকবে। প্রোঅ্যাক্টিভ ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া তো এগুলো বন্ধ করা যাবে না। এর মাধ্যমেই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব’, যোগ করেন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ বা ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব প্রসঙ্গ টানতে চাই না। এগুলো তো আমরা জানিই। আমি যা বলার তা বলেছি। পুরো সামাজিক কাঠামোর দিকটি দেখতে হবে। এটির দূর করতে হলে আওয়ামী লীগ বা যেকোনো দলই হোক, তাদের মধ্যে গণতন্ত্রায়ণ ও ডেডিকেটেড নেতাদের প্রাধান্য থাকতে হবে। এখানে একটা আরেকটার সঙ্গে তো সম্পৃক্ত। ছাত্রলীগ তো স্বাধীন না। মূল দলেরই অঙ্গ সংগঠন।’
ধর্ষণ, ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়া, চাঁদাবাজি কিংবা অন্যান্য যে ঘটনাগুলো ঘটছে এবং ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, সেগুলো অভিযোগ নয়, সত্য। তারা করছে বলেই তাদের বিরুদ্ধে এগুলোর অভিযোগ আসছে, এমনটিই বলেছেন অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন। তিনি বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ না, তারা এগুলো করছে। করছে বলেই তাদের দিকে আঙ্গুল উঠছে। আমাদের দেশে যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলগুলোর ছাত্র সংগঠনই এরকম কাজ করে। এর পেছনে তাদের দলীয় রাজনৈতিক পরিচয়টাই কাজ করে। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। তাদের একটা ক্ষমতা থাকে যে তারা সরকারি দলের। তারা জানেন যে, যে কাজই তারা করুক, রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা পার পেয়ে যাবে।’
রাজনৈতিক দলগুলোই তাদের আশ্রয় দিয়ে রাখে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা যা করছে, সেগুলোর বিচার তো হচ্ছে না। এখন হয়তো আবরার হত্যার বিচার হবে। কারণ এটা এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যেটা আর এড়ানো যায়নি। কিন্তু, যেগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়নি, সেগুলোর ক্ষেত্রে তো তাদেরকে গ্রেপ্তার করাই হয় না। যদিও বা করা হয়, তারা জানে যে রাজনৈতিক পরিচয়ে বের হয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে তারা সার্ভিস দেয় বলেই তাদের বিরুদ্ধে দলগুলো ব্যবস্থা নেয় না। তারাও তো ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। খুব ঝামেলা না হলে তো নিজের লোককে কেউ জেলে দেয় না। পুরোটাই ক্ষমতার ব্যাপার।’
‘আমরা অনেক দেখেছি, ছাত্র হত্যা হয়েছে, অনেক কিছুই হয়েছে, কিন্তু, কখনোই বিচারগুলো হয়নি। এটা যে শুধু ছাত্রলীগের সময় হয়েছে তা নয়, ছাত্রদলের সময়েও হয়েছে। যেহেতু বিচার হয় না, সে কারণে তারা নিজেদেরকে খুবই শক্তিশালী মনে করে এবং এসব ঘটনা ঘটাতে থাকে। আর দলের নেতা-নেত্রীরা বলছেন, কাউকে ক্ষমা করা হবে না। কিন্তু, আসলে তার দলের লোক হলে সবাইকেই ক্ষমা করে দেওয়া হয়’, বলেন অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘ছাত্রলীগ বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন। এখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের ছাত্র সংগঠনও ক্ষমতা-দাম্ভিকতা দেখাতে চায়। ক্ষমতার সঙ্গে থাকার কারণে তারা অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধাও পায়। সব মিলিয়ে অনেক বেশি অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুযোগ তাদের তৈরি হয়। তারা মনে করেন, আইন তাদের ঊর্ধ্বে, প্রশাসন তাকে কিছু করতে পারবে না, তার নেতারা তো আছে, তারা তাকে বাঁচাবে। ফলে আইনকে তারা থোরাই কেয়ার করে। মূলত ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকার কারণেই এটা হচ্ছে। আজকে যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকত, ছাত্রদল একই কাজ হতো। মূল বিষয়টি হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণেই ছাত্রলীগের এই ধরনের বেপরোয়া বা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সংখ্যাটা বেশি।’
‘পুরো বিষয়টিই হচ্ছে ক্ষমতাসীন রাজনীতি। যদি ছাত্রলীগের কেউ করে, তার দলের নেতা তাকে সাপোর্ট দেয়। শিক্ষকরা যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকে, তারাও তাকে সাপোর্ট দেয়’, বলেন তিনি।
আগে কোনো ব্যবস্থা না নিলেও ইদানীং ছোট একটা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘আগে ছাত্রলীগের কেউ কোনো অপরাধ করলে প্রথম তাকে ছাত্রলীগের বলে স্বীকারই করা হতো না। তবে, এখন অস্বীকারটা কম করে অভিযুক্তকে প্রাথমিকভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। বহিষ্কার করার পর কিন্তু বাংলাদেশের আইনে তাদের বিচারটা হবে। আর ছাত্রলীগ সব সময় একটা দায়সারা কথা বলে যে, এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু, যখন সারাদেশে একের পর এক ঘটনা ঘটে, তখন এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকে না। এর মধ্যে একটা প্যাটার্ন বা কাঠামো খুঁজে পাওয়া যায়।’
Comments