সিনেমায় মেগাস্টার উজ্জ্বলের অর্ধশতাব্দী

মেগাস্টার উজ্জ্বল। ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ

বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্তর হাত ধরে সিনেমায় যাত্রা শুরু উজ্জ্বলের। প্রথম সিনেমায় নায়িকা হিসেবে পেয়েছিলেন মিষ্টি মেয়ে কবরীকে। বিনিময় সিনেমা দিয়ে একক নায়ক হিসেবে পথচলা শুরু তার। গল্পটি ১৯৭০ সালের।

রোমান্টিক নায়ক থেকে সামাজিক সিনেমার নায়ক এবং সবশেষে অ্যাকশন সিনেমার নায়ক। তিন মাধ্যমে সফল নায়ক উজ্জ্বল সিনেমায় কাজ করছেন ৫০ বছর ধরে। পেয়েছেন মেগাস্টার উপাধি।

৫০ বছরের সিনেমার ইতিহাসে তার নায়ক জীবনের টার্নিং পয়েন্ট যেসব সিনেমা সেগুলোর গল্প দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন উজ্জ্বল।

সেসব গল্প শোনা যাক তার মুখ থেকেই-

প্রথম সিনেমা ‘বিনিময়’ হিট করার পর আমার কপাল খুলে যায়। এরপর ‘সমাধান’ ও ‘বন্ধু’ সিনেমা দুটি হিট হয়। সারাদেশের সিনেমা হলগুলোতে ভিড় উপচে পড়েছিল তখন। ‘বিনিময়’, ‘সমাধান’, ‘বন্ধু’ তিনটি সিনেমা আমার অভিনয় জীবনের শুরুতেই ভাগ্য খুলে দেয়।

‘বন্ধু’ সিনেমার একটি গান এখনো অনেকের মুখে মুখে ফেরে। সেই সময়ে গানটি তুমুল সাড়া পেয়েছিল। গানটি হলো-বন্ধু তোর বারাত নিয়া আমি যাব। আমার ও রাজ্জাকের লিপে ছিল গানটি।

‘সমাধান’ সিনেমায় আমার লিপে গাওয়া- ‘লোকে বলে রাগ নাকি অনুরাগের আয়না’ ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটির বদৌলতে আমিও নায়ক হিসেবে সবার দৃষ্টি কাড়ি।

আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘অনুভব’ সিনেমায় শাবানার বিপরীতে আমি অভিনয় করি। এই সিনেমাটিও আমার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই সিনেমার একটি গান বিখ্যাত হয়ে আছে এখনো। গানটি হলো- যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, সদরঘাটের পানের খিলি তারে বানাইয়া খাওয়াইতাম।

সুভাষ দত্ত আমাকে দিয়ে ফের নায়ক হিসেবে অভিনয় করালেন ‘বলাকা মন’ সিনেমায়। ‘বলাকা মন’ এ আবারও নায়িকা হিসেবে পাই কবরীকে। এই সিনেমার একটি গান সেই সময়ে অনেককে নাড়া দিয়েছিল। গানটি হলো- একটি ফুলের পাশে আরেকটি ফুল যদি আসে, ধীরে ধীরে সে তো মালা হয়। ‘বলাকা মন’ বক্স অফিসে অসম্ভব ভালো ব্যবসা করে নিয়েছিল।

সুভাষ দত্ত, আজিজুর রহমান সাহেবদের মত বিখ্যাত পরিচালকরা আমাকে নিয়ে সফলতা পাওয়ার পর আমার সিনেমার ক্যারিয়ার ধীরে ধীরে ভালো হতে শুরু করে। অন্য সব বিখ্যাত পরিচালকরাও আমাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেন।

‘পিঞ্চর’ নামে একটি সিনেমা করি। এই সিনেমার একটি গান ভীষণভাবে সাড়া ফেলেছিল। গানটি হচ্ছে- চিঠি দিও প্রতিদিন…। এখনো গানটি শোনা যায় অনেকের মুখে।

আমি ও শাবানা আরও পরে এসে জুটি হিসেবে অভিনয় করি ‘অনুরাগ’ সিনেমায়। এটিও রোমান্টিক সিনেমা। কামাল আহমেদ এর পরিচালক ছিলেন।

রোমান্টিক সিনেমায় নায়ক হিসেবে সফলতা পাওয়ার পর সামাজিক ও অফট্রাকের সিনেমায় অফার পাওয়া শুরু করি। তেমনি একটি সিনেমার নাম ‘শনিবারের চিঠি’। ববিতা ছিলেন আমার নায়িকা। অফট্রাকের সিনেমা হিসেবে ব্যবসা সফল হয়ে যায়।

অফট্রাকের সিনেমা হিসেবে ‘লালন ফকির’ সিনেমাটি আমাকে আরও বেশি পরিচিতি ও খ্যাতি এনে দিয়েছিল সেই সময়ে। আমার বিপরীতে ছিলেন কবরী।

ভালো লাগার বিষয় হলো ‘লালন ফকির’ মঞ্চ নাটক করেছি, টেলিভিশনে করেছি, আবার সিনেমায়ও করি। আসকার ইবনে শাইখ টেলিভিশনে পরিচালক ছিলেন। এই সিনেমাটিও এদেশের সব শ্রেণীর দর্শকদের কাছাকাছি নিয়ে যায় আমাকে।

শাবানার সঙ্গে একটু বিরতি দিয়ে অভিনয় করি- ‘দুটি মন দুটি আশা’ সিনেমায়। সামাজিক এই সিনেমাটি প্রচুর মানুষকে সেই সময়ে হলমুখি করেছিল।

হাবা হাসমত নামে পরিচিত ‘হাসমত ধন্যি মেয়ে’ নামে একটি সামাজিক সিনেমা পরিচালনা করেন। সামাজিক এই সিনেমাটি আমার স্বীকৃতি বাড়িয়ে দেয়। ‘পায়ে চলার পথ’ সিনেমাটিও আমার জন্য সিনেমার ক্যারিয়ারে সুখবর নিয়ে আসে।

সামাজিক সিনেমা হিসেবে ‘সমাধি’ সিনেমাটির কথা বলতেই হয়। এই সিনেমায় রাজ্জাক ও আমি নায়ক ছিলাম। ববিতা ও সুচরিতা নায়িকা ছিলেন। এই সিনেমার একটি গান- মা গো মা ও গো মা আমারে বানাইলা তুমি দিওয়ানা। আরেকটি গান হিট করেছিল- তুমি কেনো কোমরের বিছা হইলা না। এই সিনেমাটি মাসের পর মাস সিনেমা হলে চলেছিল।

আমি ও রাজ্জাক আরও অভিনয় করি ‘অনুরাগ’ সিনেমায়। শাবানা ছিলেন নায়িকা। সামাজিক সিনেমা হিসেবে এটিও সফল একটি সিনেমা।

এভাবেই খ্যাতিমান পরিচালকদের হাত ধরে একের পর এক সফলতা ঘরে আসে আমার। প্রচুর সিনেমা হাতে আসে। কাজ করে যাই মন দিয়ে। সাধনা ছিল আমার। সাধনা করে একটা অবস্থান গড়ে তুলি।

কমেডি সিনেমা আমি একটিই করেছিলাম। তার নাম- ‘ইয়ে করে বিয়ে’। অসাধারণ সফল একটি কমেডি সিনেমা।

রোমান্টিক ও সামাজিক সিনেমার নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর অ্যাকশন সিনেমার নায়ক হিসেবে আমাকে প্রতিষ্ঠা করান বিখ্যাত পরিচালক মমতাজ আলী। মমতাজ আলীর যতগুলো সিনেমা করেছি- সবগুলোই ব্যবসায়িক সফলতা পেয়েছে।

মমতাজ আলী পরিচালিত ‘নসিব’, ‘উসিলা’, ‘নালিশ’সহ বেশ কয়েকটি অ্যাকশন সিনেমার নায়ক আমি। এই সিনেমাগুলো আমাকে এদেশের মানুষের কাছে অ্যাকশন সিনেমার অন্যতম প্রধান নায়ক হিসেবে তুলে ধরে। ‘নসিব’ সিনেমাটি সেই সময়ে ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ হলে কয়েক মাস ধরে টানা চলেছে।

মনে আছে, চাঁদপুরের একটি হলে ‘নসিব’ টানা নয় মাস চলেছিল। ঢাকা শহরে ‘নসিব’ চলাকালীন হলের কাউন্টার খোলার সঙ্গে সঙ্গে টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে যেত। পুরনো ঢাকায় প্রতিটি হলে ‘নসিব’ সিনেমার লেট নাইট শো চলত। এটা আমার প্রযোজিত সিনেমা। এই ছবিটি চালিয়ে হল মালিকরা যেমন অর্থ পেয়েছিলেন, তেমনি ভাবে আমিও প্রচুর অর্থ পেয়েছিলাম।

‘নসিব’ সিনেমাটি ছিল আমার নায়ক জীবনের অন্যতম একটি রেকর্ড।

এভাবেই আমার নায়ক জীবন চলতে থাকে। আর দেখতে দেখতে সিনেমায় আমার ৫০ বছর পূরণ হলো। আমি কৃতজ্ঞ এদেশের দর্শকদের কাছে, সাংবাদিকদের কাছে, পরিচালকদের কাছে, সহশিল্পীদের কাছে এবং আমার সিনেমা শিল্পের সবার কাছে।

সত্যি বলতে, নায়ক জীবনের ৫০ বছরের গল্প বলতে চাইলে দিনের পর দিন বলতেই পারব। এ গল্প সহজে শেষ হওয়ার নয়।

Comments

The Daily Star  | English
Israeli strikes on Iran 2025

Israel launches major attack on Iran: what we know so far

‘Nuclear plant, military sites’ hit; strikes likely killed Iranian chief of staff, top nuclear scientists; state of emergency declared in Israel, fearing Iranian retaliation

5h ago