প্রবাসে

শিক্ষা ও গবেষণাই সেরা বানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়াকে

ঝা-চকচকে মেট্রোরেল কিংবা দর্শনীয় উড়ালসেতু। জনবান্ধব পাবলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা কিংবা টেলিকমিউনিকেশন ও ইলেকট্রনিক ব্যবসা। সব দিক থেকেই বিশ্বে এগিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া এমনিতেই আসেনি! এর পেছনে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে শিক্ষাব্যবস্থা এবং নিত্য নতুন গবেষণা।
ল্যাবমেইটদের সঙ্গে লেখক (মাঝে)

ঝা-চকচকে মেট্রোরেল কিংবা দর্শনীয় উড়ালসেতু। জনবান্ধব পাবলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা কিংবা টেলিকমিউনিকেশন ও ইলেকট্রনিক ব্যবসা। সব দিক থেকেই বিশ্বে এগিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া এমনিতেই আসেনি! এর পেছনে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে শিক্ষাব্যবস্থা এবং নিত্য নতুন গবেষণা।

বিজনেস কোরিয়ার তথ্যমতে বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি ১০০০ জন কর্মঠ মানুষের মধ্যে ১৪ জন (মোট জনসংখ্যার ১০০০ জনে ৭.৪ জন) সরাসরি গবেষণার সঙ্গে জড়িত। তারা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন টেকনোলজি উদ্ভাবনের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী এর বাণিজ্যিকরণের জন্য তাদের মেধা ও শ্রম কাজে লাগাচ্ছে।

স্যামসাং, এলজি, হুন্ডাই মোটরস, কিয়া, এসকে, পোস্কোসহ দক্ষিণ কোরিয়ার অসংখ্য কোম্পানি বিশ্বব্যাপী দাপটের সাথে ব্যবসা করে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এই কোম্পানিগুলো দাপটের সাথে ব্যবসার পেছনে যুগোপযোগী আবিষ্কার ও গবেষণার ক্ষেত্রে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলাই এদের প্রোডাক্টসগুলোকে গ্রাহকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

সৌজন্যে ব্লুমবার্গ

গত ৬০ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে প্রযুক্তিভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিনত হয়েছে। একেবারে শূন্য অবস্থা থেকে আজ বিশ্বের ১১তম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ! এই অসম্ভব একমাত্র সম্ভব হয়েছে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা, মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য যথাযথ পলিসি, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স সর্বোপরি সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপে জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া।

দক্ষিণ কোরিয়ায় নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, কট্টরপন্থী কোন নীতিকে আকড়ে ধরে না থেকে উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সযত্নে তারা শুধুমাত্র জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র বানিয়েছে। কৃষিতে ন্যুনতম অবদান কিংবা অন্যান্য কোন প্রাকৃতিক সম্পদহীন হয়েও একটি দেশ শুধুমাত্র জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় পৃথিবীর অন্যতম সম্পদশালী দেশে পরিণত হয়েছে। 

অনেকেই বলেন, পঞ্চাশের দশকে একই জায়গা থেকে পথচলা শুরু করেছিল পাশাপাশি দুটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়া। দুইদেশের জনগণ জাতিগতভাবে একই। কিন্তু শুধুমাত্র গবেষণার কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গায় পরিণত হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া।

আন্তর্জাতিক সব তথ্য বলছে, জ্ঞানবিজ্ঞানে বিনিয়োগে পৃথিবীর মধ্যে যে দেশটি সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করে সেটি হলো ইজরায়েল। মোট জিডিপির ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ তারা গবেষণার পেছনে খরচ করে। অতি সম্প্রতি (২০১৮ সালের তথ্যমতে) দক্ষিণ কোরিয়া তাদের মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ বা ৬৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার মানে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা শুধুমাত্র একবছরে শিক্ষা ও গবেষণায় খরচ করে সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছে!

আয়তন কিংবা জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমেরিকা, চীন, জাপান ও জার্মানির সঙ্গে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও গবেষণার ক্ষেত্রে বিনিয়োগে পিছিয়ে নিই দক্ষিণ কোরিয়া। শিক্ষা ও গবেষণায় তাদের এই আর্থিক বিনিয়োগই দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশ্বের অন্যতম সেরা উদ্ভাবকের মর্যাদা দিয়েছে যা এদের টেকসই উন্নয়নের গোপন রহস্য!

ব্লুমবার্গ ইনোভেশন ইনডেক্স ২০১৯ র‍্যাংকিং এর মতে দক্ষিণ কোরিয়া এ পর্যন্ত লাগাতার পাঁচ বার জার্মানি, সুইডেন, সিঙ্গাপুর, জাপান কিংবা সুইজারল্যান্ডকে পেছনে ফেলে সেরা ইনোভেটিভ দেশের মর্যাদা পেয়েছিল, যদিও প্রায় ৬ বছর পর ২০২০ সালের ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী জার্মানি দক্ষিণ কোরিয়াকে দ্বিতীয় অবস্থানে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। নেচার ইনডেক্স ২০২০ এর তথ্যমতে দক্ষিণ কোরিয়া কোয়ালিটি রিসার্চে পৃথিবীর প্রথম ১০ টি দেশের অন্যতম! 

প্রচন্ড পরিশ্রমী এই জাতি কাজ ও সততাকেই তাদের ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। এখানে যেমন প্রাতিষ্ঠানিক কোন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই তেমনি যেকোন নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতায় কোন হস্তক্ষেপও নেই। অন্যকে বিরক্ত না করে আপনি আপনার মতো ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবেন তবে দেশ ও সাধারণ নাগরিকের সমস্যা তৈরি করলে আপনাকে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে। আর প্রতিটি নাগরিক যে যার মতো নিজের কাজে ব্যস্ত ও দিনশেষে সাধারণ নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা বিশেষ করে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ দেশটিকে অনন্য করে তুলেছে। 

দেশ হিসেবে আমাদের বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অনেক কিছু শেখার আছে, দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে। মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতি হিসেবে শিক্ষা ও গবেষণায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগের পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার মান নিশ্চিতকরণ।

জেনে অবাক হবেন, একসময় অনেক কোরিয়ানই কাজ কিংবা উপর্জনের জন্য বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে পাড়ি জমিয়েছিল। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণায় যথাযথ বিনিয়োগ আজ তাদের পৃথিবীর সেরা দেশের কাতারে নিয়ে এসেছে।

প্রাকৃতিক সম্পদহীন, পাহাড়ি ও কৃষিকাজের প্রায় অনুপযোগী জমি নিয়ে শুধুমাত্র জ্ঞানবিজ্ঞানে বিনিয়োগ ও যথাযথ নীতির মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া যদি পৃথিবীর সেরা দেশের কাতারে আসতে পারে, সুজলা-সুফলা প্রিয় বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতেই পারি, একদিন আমরাও পারবো। প্রয়োজন শুধু যথাযথ পদক্ষেপের।

(লেখক: পিএইচডি গবেষক, বুসান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সহকারী অধ্যাপক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর, বাংলাদেশ।)

Comments

The Daily Star  | English

Mirpur-10 metro station to reopen tomorrow

Mohammad Abdur Rouf, managing director of Dhaka Mass Transit Company Ltd, revealed the information in a press conference

21m ago