বিদেশি হলেই ভালো, এটা হয়ে গেছে আমাদের নীতি: ডা. জাফরুল্লাহ

আরটি-পিসিআর মেশিনের ওপর নির্ভরতা কমাতে ও দৈনিক করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে অ্যান্টিজেন র‌্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বিদেশ থেকে আনা হবে অ্যান্টিজেন কিট। দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত কিটের অনুমোদন এখনো দেওয়া হয়নি।
Dr_Zafrullah
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

আরটি-পিসিআর মেশিনের ওপর নির্ভরতা কমাতে ও দৈনিক করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে অ্যান্টিজেন র‌্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বিদেশ থেকে আনা হবে অ্যান্টিজেন কিট। দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত কিটের অনুমোদন এখনো দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

তিনি বলেন, ‘বিদেশে যারা অ্যান্টিজেন কিট উৎপাদন করল, সরকার এখন তাদের কাছ থেকে কিনে আনবে। তাদেরটা দিয়ে পরীক্ষা করবে। কিন্তু, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনুজীব বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে আমাদের গণস্বাস্থ্যের বিজ্ঞানীরা দেশেই কিট উদ্ভাবন করলেন, সারাবিশ্বে সবার আগেই আমরা উদ্ভাবন করলাম, অথচ আমাদেরটা অনুমোদন দেওয়া হলো না। অনুমোদন না দেওয়ার ক্ষেত্রে বলা হলো, গণস্বাস্থ্যের কিট মানসম্পন্ন না। আমাদের জাতীয় চরিত্রই এরকম হয়ে গেছে যে, বিদেশ থেকে কিনে আনা, বিদেশ থেকে আনলে সেটা ভালো। আর আমাদের বিজ্ঞানী-চিকিৎসকরা কিছু করলে সেটাকে আমরা গুরুত্ব দিতে চাই না। এই যে এমন একটা নীতি হয়ে গেছে, অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন কিটের অনুমোদনের ক্ষেত্রে আমরা এই নীতির প্রতিফলন দেখেছি।’

‘আমরা অনুমোদন পেলাম না কেন? কারণ, যেহেতু আমরা বাণিজ্য করব না, যেহতেু তিন শ টাকার মধ্যেই আমরা আমাদের উদ্ভাবিত কিট বাজারে দিতে পারব, আমরা যেমন বাণিজ্য করব না, তেমনি আমাদের কিট দিয়ে অন্য কারোও বাণিজ্য করার সুযোগ নেই। আমরা যে কিট তিন শ টাকায় দেবো, সেটি বিদেশ থেকে কিনে আনবে দুই হাজার ৮০০ টাকায়। এর মানে হচ্ছে, এই জায়গায় বাণিজ্যের সুযোগ থাকছে। এবং এটা আমাদের কিট অনুমোদন না দেওয়ার প্রধান কারণ বলে আমার কাছে মনে হয়’, বলেন তিনি।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আরও বলেন, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে। যে দেশের জন্য সারাজীবন কাজ করলাম, যুদ্ধ করলাম, সেই দেশের বিজ্ঞানীরা সবার আগে কিট উদ্ভাবন করেও অনুমোদন পেল না। এখন প্রশ্ন হলো— দেশীয় বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত কিট যে উপায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে, বিদেশ থেকে আনা কিটও কি একই উপায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে? এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। যে ফর্মুলায় আমাদের কিট পরীক্ষা করা হলো, যে সময় নেওয়া হলো, বিদেশ থেকে আনা কিটেরও ক্ষেত্রেও তো তাই হওয়ার কথা। কিন্তু, যদি করা না হয়, তাহলে বুঝতে হবে গণস্বাস্থ্যের কিটের অনুমোদন না দেওয়া ও বিদেশ থেকে কিনে আনা কিটের মধ্যে অন্য বিষয় আছে। এখানে মানুষের সেবা করাটা প্রধান বিষয় না। আমাদের কিটের ক্ষেত্রে যেটা প্রযোজ্য, বিদেশের কিটের ক্ষেত্রে সেটা কেন প্রযোজ্য না?’

বলা হচ্ছে— এই কিটগুলো যেসব দেশের, এগুলো সেসব দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে, এগুলো ডব্লিউএইচও কর্তৃক অনুমোদিত। এ বিষয়ে  ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এখানে একটা বিষয় খেয়াল করে দেখেন, আমরা যখন কিট উদ্ভাবন করেছি, এটি উদ্ভাবনের ঘোষণা দিয়েছি, তখন ডব্লিউএইচও এবং ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের অবস্থান ছিল র‌্যাপিড টেস্ট কিটের বিপক্ষে। নির্মোহভাবে যেকোনো মানুষ যদি বিশ্লেষণ করে, তাহলে দেখা যাবে ডব্লিউএইচও কিংবা ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়ে চিন্তা-ভাবনা এবং গুণগত মান উন্নয়নের দিক থেকে আমরা অনেক এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু, আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি আমাদের সহায়তা করল না বলে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীকে সেটা দেখাতে পারল না। আমাদের বিজ্ঞানী ড. বিজন ফেব্রুয়ারি থেকে প্লাজমা থেরাপির কথা বলছেন। তখনো ডব্লিউএইচও এবং ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশগুলোও প্লাজমা থেরাপির কথা বলেনি। কিন্তু, এর মাস চারেক পরে এসে ডব্লিউএইচওসহ অন্যান্য দেশগুলো প্লাজমা থেরাপির কথা বলেছে। এক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয় যে, অন্যেরা যেভাবে চিন্তা করছিল, আমাদের চিন্তা-ভাবনা এর চেয়েও অনেক দূরদর্শী ছিল। আমরা এদিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিলাম। অথচ রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে আমরা সুযোগগুলো নিতে পারলাম না।’

‘এখন এই যে আমরা এসব সুযোগগুলো নিতে পারলাম না, এর জন্যে ব্যক্তিগতভাবে আমি, ড. বিজন কুমার শীল, আমাদের অন্যান্য বিজ্ঞানীরা কিংবা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ ও এদেশের ১৭ কোটি মানুষ। আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়া। কোনোরকম বাণিজ্য আমরা করি না। কিন্তু, রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে দেশের সাধারণ মানুষ এর সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এত বছর পরে এসে এটাই আমার দুঃখ-কষ্ট। নানা আইনি মারপেঁচে দেশের কিটের মান নির্ণয়ে পরীক্ষা  জটিল করা হয়েছে’, যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার দেশের সরকারই তো আমাদের সহায়তা করছে না। সরকার সহায়তা করলে তো আমাদেরকে ডব্লিউএইচও পর্যন্তও যেতে হয় না। বিশ্বের অনেক দেশ আমাদের বহু পরে কিট উদ্ভাবন করে সেগুলো তারা ব্যবহারও করছে। তারা ডব্লিউএইচওর দিকে তাকিয়ে নেই। তারা তাদের মানুষকে সেবা দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নীতি হওয়া উচিত জনমানুষের সেবার পক্ষে। কিন্তু, আমাদের এখানে সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় নীতি হয়ে গেছে ব্যবসায়ী, অসততা, অনিয়ম, দুর্নীতির পক্ষে। যারা সততা ও ন্যায্যতার পক্ষে, আজ তারা বঞ্চিত। যারা অনিয়ম-দুর্নীতির পক্ষে, তারাই লাভবান। এটাই আমাদের রাষ্ট্রের নীতি। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও  এমনটাই আমরা দেখছি। দুঃখ-কষ্ট করা ছাড়া এ নিয়ে আমাদের আর কিছু করার নেই।’

গণস্বাস্থ্যের কিটের অনুমোদনের জন্য এখন কি করবেন?, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জানি না। হয়তো আদালতে যেতে পারি। আদালতে গিয়ে কী হবে সেটাও জানি না। কিংবা এভাবে চুপচাপ বসে থাকব কি না, তাও জানি না। কিছুটা হতাশা তো কাজ করছে। কিন্তু, হতাশা নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। আমরা তো কাজ বন্ধ রাখিনি। আমরা আমাদের মতো করে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago