পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ছে রোহিঙ্গারা
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/rohingya_settlement_0.jpg?itok=_OxZsVKZ×tamp=1601555179)
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করার পাঁচ বছরের মধ্যেই একটি রোহিঙ্গা পরিবারের চার ছেলে, এক মেয়ে সবাই ভোটার হয়েছেন এবং পাহাড়ের নির্জন একটি এলাকায় দোতলা বাড়ি করছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে— কত সহজে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করা যায়, স্থায়ী হওয়া যায়?
রোহিঙ্গা আমির আলীর পরিবার। আমির আলী জানান, তিনি তার স্ত্রী আমিনা খাতুন ও তাদের পাঁচ সন্তান প্রায় পাঁচ বছর আগে মিয়ানমারের মংডু থেকে বাংলাদেশে আসেন। তারা এখন বান্দরবানের কাইছতলীতে বসতি স্থাপন করেছেন।
সম্প্রতি ওই এলাকায় গেলে দেখতে পাই, আমিরের পরিবার যে জমিতে বসবাস করছেন, সেখানে তারা একটি দ্বিতল বাড়ি নির্মাণ করছেন।
আমির স্বীকার করলেন প্রায় দশ শতক জায়গার ওপর পরিবার নিয়ে তিনি আছেন এবং সেই জায়গাটি তিনি কারও কাছ থেকে কিনে নেননি।
২০১৭ সালের আগে সীমান্ত অতিক্রম করে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে বসবাস শুরু করেছেন, আমির তাদেরই একজন এবং এটি তিনি অবলীলায় স্বীকার করেছেন।
স্থানীয় মো. সিরাজ বলছিলেন, ‘শুধু আমিরের পরিবার নয়, হলুদিয়া থেকে প্রান্তিক লেক পর্যন্ত এখন প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা পরিবার রয়েছে। প্রতিনিয়ত এখানে নতুন নতুন রোহিঙ্গাদের দেখা যাচ্ছে।’
স্থানীয় এবং কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করছেন এবং সেখানকার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারছেন।
‘রোহিঙ্গা পরিবারগুলো বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে যেমন: বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফসহ নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সরকারি ভাতা পান’, বলেন সিরাজ।
আমাদের দেশের জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়াও পাহাড়ে বসতি স্থাপন করা রোহিঙ্গাদের জন্য কঠিন কিছু না।
বেশ কয়েক বছর আগে মিয়ানমারের বুচিডং এলাকা থেকে আসা নূর নাহার বেগমও এখন বান্দরবানের সুয়ালক ইউনিয়নের হরিণ মারা এলাকায় বসতি স্থাপন করে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।
নূর নাহার বলেন, ‘আমরা একজন স্থানীয়কে বছরে চার হাজার টাকার দিয়ে এই এলাকায় বসবাস করি।’
‘হরিণ মারা এলাকায় ২২টি রোহিঙ্গা পরিবার ইতোমধ্যে বসতি স্থাপন করেছেন। তাদের অনেকেই বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রও সংগ্রহ করেছেন। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই বলে আমার স্বামী ও আমি এখনো কার্ডটি পাইনি’, বলেন নূর নাহার।
এই এলাকার জাফর আলম নামে একজনের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে যেটি ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর বান্দরবান থেকে ইস্যু করা হয়েছিল। জাতীয় পরিচয়পত্রে জাফরের জন্মস্থান কক্সবাজার দেখানো হয়েছে এবং তার জন্ম সাল দেখানো হয়েছে ১৯৬৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি।
জাফরের প্রতিবেশী ফাতেমা বেগম বলেন, ‘জাফর বেশ কয়েক বছর আগে মিয়ানমার থেকে এসে এই এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।’ জাফর এখন সেটি অস্বীকার করে বলছেন, তার জন্ম বাংলাদেশের কক্সবাজারে। বান্দরবানে এসে তিনি ভোটার হয়েছেন।
নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুল্লাহ বলেছেন, ‘দোছড়িতে প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা আছেন, যারা কয়েক বছর আগে এখানে এসেছেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দোছড়ি এলাকার কয়েকজন স্থানীয় দাবি করেছেন যে, হাবিবুল্লাহর বাবা-মাও মিয়ানমার থেকে আসা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘আমার বাবা-মা বহু বছর আগে কক্সবাজারের রামু এলাকায় থাকতেন। তবে, আমার জন্ম দোছড়িতে।’
জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় অনেকেই জানায়, প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা পরিবার বান্দরবান জেলায় বসতি স্থাপন করেছেন। এদের বেশিরভাগ নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলীকদম, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদরে রয়েছেন।
আলীকদম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন বলেন, ‘গত সাত-আট বছরে প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গা পরিবার উপজেলায় বসতি স্থাপন করেছে এবং এখানে বার্মাইয়া বা বার্মিজ পাড়া নামে একটি গ্রামও রয়েছে।’
সুয়ালক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উ ক্যনু মারমা বলেন, ‘২০০৭-২০০৮ সালের আগে সুয়ালক এলাকায় রোহিঙ্গা ছিল না। কিন্তু, এখন এই এলাকায় প্রায় দুই শর বেশি রোহিঙ্গা পরিবার বাস করে।’
তিনি আরও জানান, এর মধ্যে এই এলাকার প্রায় ৫০টি রোহিঙ্গা পরিবার ভোটার তালিকায় নিবন্ধিতও হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের বান্দরবান চ্যাপ্টারের সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় প্রশাসন কেবল রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন করতে সহায়তা করছে না, তারা তাদেরকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছে এবং স্থায়ী বসবাসের সনদও দিচ্ছে।’
বান্দরবানের জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দেওয়ার একটি সিন্ডিকেট রয়েছে।’
‘২০১৯ সালে মূলত রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে আমরা প্রায় এক হাজার ৯০০টি আবেদন বাতিল করে দিয়েছি। কারণ আবেদনের সঙ্গে যেসব ডকুমেন্ট দেওয়া হয়েছিল, তাতেই আমাদের সন্দেহ হয়েছিল যে এই আবেদনকারীরা বাংলাদেশি নন’, যোগ করেন মোহাম্মাদ রেজাউল করিম।
তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের জন্ম সনদ দেন।’
এ বিষয়ে বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘সম্প্রতি বান্দরবানে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। যারা বিভিন্ন সরকারি ভাতা পাচ্ছেন, তারা হয়তো এই অঞ্চলটিতে অনেক আগে এসেছিলেন।’
পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের ক্রমবর্ধমান বসতি স্থাপন সেখানকার পাহাড়িদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যকে আরও বেশি হুমকির মধ্যে ফেলবে বলে পাহাড়িরা মনে করছেন।
১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি হলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সংকট চলছে, তার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাধ বসতি স্থাপন, পাহাড়ে বসবাসের স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ প্রদানসহ নানামুখী কার্যক্রমে রোহিঙ্গাদের নাম সুকৌশলে নিবন্ধন এই অঞ্চলের পাহাড়িদের জন্য এক অশনিসংকেত বলে মনে করা হচ্ছে।
বান্দরবানে বিশেষ করে লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা বিভিন্ন সময় পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের অভিযোগ রয়েছে। আরও অনেক জুমিয়া পরিবার উচ্ছেদ আতঙ্কে আছেন বলে জানা গেছে।
২০১৬ সালে লামা উপজেলার ছোট কলার ঝিরি এলাকায় শহিদুল ইসলাম নামে একজন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে ওই এলাকার ৮২টি ম্রো পরিবারের জুমের জায়গা দখলের অভিযোগ উঠেছিল। ওই এলাকায় রশিদ আহমেদ নামে একজন রোহিঙ্গা যিনি অর্থের বিনিময়ে ম্রোদের জায়গা দখল করতে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে কথা হয়।
রশিদ জানান, শহিদুল প্রায় ২০-২৫ জন রোহিঙ্গাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল এবং তাদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। যেন ম্রোরা ভয়ে জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হন। বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
Comments