সিলেটে বিষ্ণু ও ধ্যানীবুদ্ধের ভাস্কর্যের সন্ধান

Srihatta_Vishnu_Murti.jpg
সিলেটে বঙ্গের প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন দুটি প্রাচীন প্রস্তর ভাস্কর্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। ছবি: তরুণ সরকার

সিলেটে বঙ্গের প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন দুটি প্রাচীন প্রস্তর ভাস্কর্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টার’র পক্ষ থেকে সিলেটের অন্যতম প্রধান বৈষ্ণবতীর্থ বিয়ানীবাজারের পঞ্চখণ্ড বাসুদেব অঙ্গনে অভিযানে ভাস্কর্য দুটির সন্ধান পাওয়া যায়।

এর একটি হলো গরুড়াসীন বিষ্ণু মূর্তি। মূর্তিতত্ত্ববিদদের মতে, বাংলাদেশে দুষ্প্রাপ্য বিষ্ণু মূর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম গরুড়াসীন বিষ্ণু। সিলেট বিভাগে এর আগেও তিনটি বিষ্ণু মূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তবে গরুড়াসীন বিষ্ণু মূর্তি সন্ধান পাওয়ার ঘটনা সিলেট বিভাগে এই প্রথম।

অন্যটি মিনিয়েচার ধ্যানীবুদ্ধ মূর্তি। যার একটি হাতসহ নানা স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পর্যবেক্ষণ করে মূর্তিতত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন, এটি ধ্যানী বুদ্ধের বৈরোচন মূর্তি।

বাসুদেব অঙ্গনে প্রাচীন প্রস্তর মূর্তি রয়েছে তিনটি। অচ্যুতচরণ চৌধুরীর লেখা ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ এবং ‘বাংলাপিডিয়া’সহ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থে সিলেটের বিয়ানীবাজারে বাসুদেব অঙ্গনে একটি বাসুদেব মূর্তি রক্ষিত থাকার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু সেখানে আরও দুটি মূর্তি রক্ষিত থাকার বিষয়টি কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না। এমনকি গীতাযজ্ঞের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চখণ্ড বাসুদেব অঙ্গন কর্তৃপক্ষ প্রকাশিত তিন শতাধিক পৃষ্ঠার স্মারকগ্রন্থে একটি বাসুদেব মূর্তির উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য দুটি মূর্তির অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করা হয়নি।

বিয়ানীবাজারের পঞ্চখণ্ড পরগনায় দুটি পাশাপাশি গ্রাম সুপাতলা ও নিদনপুর প্রাচীন প্রত্নস্থল হিসেবে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদদের কাছে সুপরিচিত। নিদনপুর তাম্রশাসনের মাধ্যমে দুই শতাধিক ব্রাহ্মণকে জমিদান করা হয়েছিল। নিদনপুর গ্রামে শিববাড়ি নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত একটি অনুচ্চ টিলার ওপর ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে টিলাটির তৎকালীন স্বত্বাধিকারী শেখ মোশাররফ পেয়েছিলেন কামরূপ রাজ ভাস্কর বর্মার (রাজত্বকাল খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের প্রথম ভাগ) সাতটি তাম্রশাসন, যা বর্তমানে নিদনপুর তাম্রশাসন নামে বাংলাদেশ, ত্রিপুরা ও আসামের প্রাচীন ইতিহাস চর্চায় এক অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। পঞ্চখণ্ড পরগনার সুপাতলা গ্রামে একাধিক পুকুর থেকে পাওয়া গেছে প্রাচীন ভাস্কর্য।

Bishnu_on_Garuda.jpg
গরুড়াসীন বিষ্ণু | ছবি: সাগর দাস চৌধুরী

পঞ্চখণ্ড বাসুদেব অঙ্গনের ঐতিহ্য অনুযায়ী, বাসুদেব অঙ্গনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং বাসুদেব অঙ্গন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত বাসুদেব সেবক সংঘের সভাপতি অধ্যক্ষ দ্বারকেশ চন্দ্র নাথ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, নিদনপুর তাম্রশাসনে ষষ্ঠ ফলকে উল্লেখ আছে, দানকৃত মোট জমির সাত শতাংশ বলি, চরু ও সত্রের জন্য বরাদ্দ হয়। বলি, চরু ও সত্র সাধারণ দেবপূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। নিদনপুর তাম্রশাসনে উল্লিখিত বলি, চারু ও সত্রের জন্যে দানকৃত ভূমিকে কেন্দ্র করে হয়তো বাসুদেব অঙ্গন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।

পঞ্চখণ্ড বাসুদেব বিগ্রহের বলি, চরু ও সত্র তথা পূজা ও ভোগ-নিবেদন, শিক্ষা ও দাতব্য কার্মক্রম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ভূমিপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণরা।

পঞ্চখণ্ড বাসুদেব অঙ্গন কমপ্লেক্সের অবস্থান বিয়ানীবাজার পৌরসভার সুপাতলা মহল্লায় একটি অনুচ্চ টিলাকে কেন্দ্র করে। এখানে রয়েছে বাসুদেব শ্রী মন্দির, নাট মন্দির, শিব মন্দির, ঝুলন মন্দির, পুষ্পদোল মন্দির, দোল মন্দির, যজ্ঞকুণ্ড, রথযাত্রা মন্দির, স্নানযাত্রা মন্দির, ছাত্রাবাস ও পাঠাগার ইত্যাদি ভবন। তিনটি প্রাচীন মূর্তি রক্ষিত ও পূজিত হচ্ছে শ্রী মন্দিরে। অঙ্গন কমপ্লেক্সের পূর্ব দিকে নিচু সমতলভূমিতে রয়েছে অঙ্গনের একটি প্রাচীন পুকুর।

গরুড়াসীন বিষ্ণু মূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল পঞ্চখণ্ড বাসুদেব অঙ্গনের পুকুরে। বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এবং বাসুদেব অঙ্গন পরিচালনা কমিটির সভাপতি দ্বারকেশ চন্দ্র নাথ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বাসুদেব অঙ্গনের পুকুর খননকালে গরুড়াসীন বিষ্ণু মুর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল। এরপর থেকে মূর্তিটি বাসুদেব অঙ্গনে পূজিত হয়ে আসছে।

Dhyani_Buddha.jpg
ধ্যানীবুদ্ধ | ছবি: তরুণ সরকার

তিনি আরও বলেন, পঞ্চখণ্ড বাসুদেব অঙ্গনের পুকুরে বিষ্ণু মূর্তি প্রাপ্তির ঘটনা অঙ্গনের দীর্ঘ বৈষ্ণব ঐতিহ্যের প্রমাণ। প্রাচীনকালে এখানে পাথর প্রতিমায় বিষ্ণু পূজিত হতো। পরবর্তীকালে হয়তো প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে অঙ্গনের পুকুরের ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

বিষ্ণু হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা। সৃষ্টি-পালন-ধ্বংস-ত্রয়ী তত্ত্বে বিষ্ণু পালনকর্তা। বৈদিক নিরাকার বিষ্ণু পৌরাণিককালে সাকাররূপ নেয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় শাস্ত্র ও ভাস্কর্য শিল্পে সময়ভেদে, স্থানভেদে বিষ্ণুর রয়েছে নানা রূপ, নানা নাম। বিষ্ণুমূর্তি সাধারণত দ্বিভুজ, চতুর্ভুজ, অষ্টভুজ হয়ে থাকে। তবে চতুর্ভুজ বিষ্ণু মূর্তির সংখ্যাই বেশি। চতুর্ভুজ বিষ্ণুর আয়ুধ সাধারণত পদ্ম, শঙ্খ, গদা ও চক্র। বাংলাদেশেও নানা ধরনের বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া যায়। তবে বিষ্ণুর বাসুদেব মূর্তিই বাংলাদেশে সর্বাধিক পাওয়া গেছে। শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী দণ্ডায়মান বিষ্ণু এবং দুপাশে থাকে দণ্ডায়মান শ্রী দেবী ও ভূ-দেবী এ ধরনের বিষ্ণু মূর্তিকে সাধারণত বাসুদেব বলা হয়।

অচ্যুতচরণ চৌধুরীর লেখা ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত সিলেট বিষয়ক আকরগ্রন্থ ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ এ বাসুদেব অঙ্গনকে উল্লেখ করা হয়েছে, সিলেটের অন্যতম প্রাচীন তীর্থরূপে। গ্রন্থে আরও উল্লেখ আছে, সুপাতলা গ্রামে দুর্গাদলই নামে জয়ন্তিয়া রাজার একজন কর্মচারী বাস করতেন। দুর্গাদলইয়ের বাড়ির সামনে পুকুর খননকালে একটি বাসুদেব মূর্তি ও একটি মহামায়া মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। মহামায়া মূর্তিটি শাক্ত মতবাদের অনুসারী জয়ন্তীয়া রাজাকে উপহার দেওয়া হয়। আর বাসুদেব মূর্তিটি স্থাপন করা হয় সুপাতলার বাসুদেব অঙ্গনে।

‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ অনুযায়ী, বাসুদেব মূর্তিটি পুকুরে পাওয়া গিয়েছিল কমপক্ষে ১৮৫ বছর আগে। কারণ জয়ন্তীয়া রাজের পতন ঘটে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে। ব্রিটিশদের অধীনে বন্দি অবস্থায় রাজা মৃত্যুবরণ করেছিলেন। দুর্গাদলইয়ে পুকুর থেকে মূর্তিপ্রাপ্তির ঘটনা নিশ্চয়ই ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের আগের ঘটনা হবে। দুর্গাদলইয়ের পুকুর থেকে পাওয়া বাসুদেব মূর্তিতে বিষ্ণু সমপদস্থানক ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান। দুপাশে রয়েছে শ্রী দেবী ও ভূ-দেবী।

কমলাকান্ত গুপ্ত চৌধুরীর লেখা ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘কপার প্লেট অব সিলেট’ গ্রন্থে সিলেট বিভাগে তিনটি বিষ্ণু মূর্তি প্রাপ্তির উল্লেখ আছে। এর মধ্যে সিলেট শহরে আম্বরখানা মহল্লায় রাজার মায়ের দীঘি থেকে প্রাপ্ত একটি, সুনামগঞ্জে জগন্নাথপুরে মন্দিরে পূজিত একটি এবং পঞ্চখণ্ড বাসুদেব অঙ্গনে রয়েছে একটি বিষ্ণু মূর্তি। উল্লিখিত তিনটি মূর্তিই বিষ্ণুর বাসুদেব রূপ।

সিলেটের পঞ্চখণ্ড বাসুদেব অঙ্গনে রক্ষিত গরুড়াসীন বিষ্ণু মূর্তিটির উচ্চতা দুই ফুট সাত ইঞ্চি এবং প্রশস্ত এব ফুট দুই ইঞ্চি। চতুর্ভূজ মূর্তিটির হাতে রয়েছে (ক্রম অনুযায়ী) গদা, চক্র, শঙ্খ ও পদ্ম। মূর্তিতে গরুড়ের কাঁধের ওপর বিষ্ণু উপবিষ্ট। আর বিষ্ণুর দুই পায়ের পাতা রয়েছে গরুড়ের দুই হাতের উপর। ভাস্কর্যের নিচে দুপাশে রয়েছে শ্রী দেবী ও ভূ-দেবী। মাঝে বিষ্ণু. দুপাশে রয়েছে হাতি ও ঘোড়া এবং এর ওপর একটি করে মিনিয়েচার মূর্তি। বিষ্ণু মাথার উপরে রয়েছে কীর্তিমুখ তথা সিংহের মুখ এবং মাথার দুপাশে রয়েছে বিদ্যাধর। গরুড় পদ্মের উপর উড়তে শুরু করার ভঙ্গিতে রয়েছে। তার একটি পায়ের পাতা ও হাঁটু পদ্মের ওপর এবং অপর পায়ের পাতা পদ্মে কিন্তু হাঁটু উত্তোলিত।

গরুড় বিষ্ণুর বাহন। পুরাণ অনুযায়ী, গরুড় মানুষ ও পাখির সমন্বিত রূপ। গরুড়ের রয়েছে মানুষের মতো মুখ, হাত-পা, আবার পাখির মতো দুটি ডানাও আছে। গরুড়ের (গরুডা) উপর উপবিষ্ট বিষ্ণু মূর্তিকে মূর্তিতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থে পণ্ডিতরা ‘গরুড়াভাহানা ভিষ্ণু’, ‘ভিষ্ণু সিটস অন গরুড়া’, ‘ভিষ্ণু অন গরুড়া’, ‘ভিষ্ণু রাইডিং অন গরুড়া’ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করেছেন।

মূর্তিতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জাদুঘরের ক্যাটালগ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ইতোপূর্বে সাতটি গরুড়াসীন বিষ্ণু মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে রাজশাহী জেলায় তিনটি (কুরপাড়া, নীমগাছি ও শ্রীমন্তপুর), দিনাজপুরে দুটি (অগ্রদ্বিগুন ও হাটপুকুরী) এবং বগুড়া (শানাইল) ও বরিশাল জেলায় (লক্ষ্মণকাঠি) একটি করে গরুড়াসীন মূর্তি। এ ছাড়া, পশ্চিমবঙ্গে একটি (মুর্শিদাবাদ) গরুড়াসীন বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল।

Basudeb_Bishnu.jpg
বাসুদেব বিষ্ণু | ছবি: তরুণ সরকার

জাতীয় জাদুঘরের সাবেক কিপার ও প্রাচীন শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ ড. নীরু শামসুন্নাহার দ্য ডেইলি স্টারকে সিলেটে পাওয়া গরুড়াসীন বিষ্ণু মূর্তি সম্পর্কে বলেন, ভাস্কর্যটি দেখে স্থবির মনে হয় না। মনে হয় লাইভলি ভাস্কর্য। অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে পাথর খোদাই করা হয়েছে। ভাস্কর্যটিতে অনুপাত সাম্য যথার্থ। আলঙ্করের বাহুল্য নেই। বিষ্ণুর মুখমণ্ডলে সমাহিত ভাব এবং গরুড়ের মুখমণ্ডলে বিনীত ভাব আনা হয়েছে বেশ দক্ষতার সঙ্গে। ভাস্কর্যটি কোনো এক মাস্টার ভাস্করের কাজ।

তিনি আরও বলেন, বাংলা-বিহার অঞ্চলে অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ভাস্কর্য নির্মাণের একটি নিজস্ব রীতি গড়ে উঠেছিল। তার সুবর্ণ সময় ছিল দশম-একাদশ শতক। দেবভাবে সঙ্গে মানবীয় ভাবের সমন্বয়, অসাধারণ অনুপাত সাম্য, আলঙ্করণ ও অলঙ্কারে বাহুল্যহীন ইত্যাদি দশম-একাদশ শতাব্দীর বাংলার ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য। দ্বাদশ শতকে ভাস্কর্যে আলঙ্করণ ও আলঙ্কার বৃদ্ধি পায়, দেহ স্থুল হয়ে যায়। সিলেটের গরুড়াসীন বিষ্ণু মূর্তিটিতে বাংলার ভাস্কর্যশিল্পের সুবর্ণসময়ের বৈশিষ্টসমূহ দেখা যায়। তাই ভাস্কর্যটিকে দশম-একাদশ শতকের বলে আমার ধারণা।

মূতিত্ত্ববিদ মো. মোশারফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ছয় শতাধিক বিষ্ণু মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মাত্র প্রায় সাতটি রয়েছে গরুড়াসীন বিষ্ণু মুর্তি। এ কারণে মূর্তিটিকে রেয়ার বলা যায়। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত গরুড়াসীন বিষ্ণু মূর্তির মধ্যে পঞ্চখণ্ড বাসুদেব অঙ্গনে রক্ষিত গরুড়াসীন বিষ্ণু মূর্তিটিকে আমার সর্বাধিক প্রাচীন বলে মনে হচ্ছে। এতে নতুন কিছু ফিচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বংশানুক্রমিকভাবে বাসুদেব অঙ্গনের সেবায়েত হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, দুর্গাদলই গ্রামে পুকুর খননকালে বাসুদেব মূর্তির সঙ্গে মিনিয়েচার মূর্তিটি পওয়া গিয়েছিল। এরপর থেকে মূর্তিটি বাসুদেব অঙ্গনে পূজিত হচ্ছে। মিনিয়েচার মূর্তিটি আমরা নারায়ণরূপে পূজা করি। ধ্যানীবুদ্ধ মূর্তিটির উচ্চতা সাড়ে চার ইঞ্চি এবং আড়াই ইঞ্চি প্রশস্ত। উপবিষ্ট এবং ধ্যানরত। মূর্তিটির মুখমণ্ডল ও পৃষ্ঠপঠের অলঙ্করণ ক্ষতিগ্রস্ত। বাম হাত ভাঙা।

বিয়ানীবাজারে প্রাপ্ত ধ্যানীবুদ্ধ মূর্তি বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও মূর্তিতত্ত্ববিদ ড. স্বাধীন সেন এবং বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও মূর্তিতত্ত্ববিদ মো. মোশারফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দুজনই মূর্তিটি পঞ্চবুদ্ধের অন্যতম বৈরোচন বলে মত দিয়েছেন। বাম হাত ভাঙা হলেও ডান হাতের ভঙ্গি দেখে মূর্তিটিতে দুটি হাত ধর্মচক্র মুদ্রায় বিন্যস্ত ছিল বলে তারা দুজন মতামত ব্যক্ত করেন।

বৌদ্ধ মূর্তি শাস্ত্র অনুযায়ী, বৈরোচনের দুই হাত ধর্মচক্র মুদ্রায় বিন্যস্ত থাকে। অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেনের মতে, ভাস্কর্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এর সময়কাল নির্ধারণ করা কঠিন। তবে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে হবে। মো. মোশারফ হোসেনও ভাস্কর্যটির সময়কাল নির্ধারণ কঠিন বলে মত দেন। তবে তিনি ধারণা করেন, এটি দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের ভাস্কর্য হতে পারে।

মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার মূলত ধ্যানী বুদ্ধ বা পঞ্চবুদ্ধ তত্ত্বকে কেন্দ্র করে। ধ্যানীবুদ্ধের সংখ্যা পাঁচ। তারা হলেন—  বৈরোচন, অক্ষোভ্য, রত্নসম্ভব, অমিতাভ ও অমোঘসিদ্ধি। ধ্যানীবুদ্ধ থেকে বুদ্ধশক্তির উদ্ভব হয়। বোধিসত্ত্বদের উৎপত্তি হয়। বিভিন্ন বৌদ্ধ দেবদেবী এবং বোধিসত্ত্বগণ কোনো একটি ধ্যানীবুদ্ধ কুল বা বংশের অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। এ জন্য প্রত্যেক ধ্যানীবুদ্ধকে ‘কুলেশ’ বলা হয়। বোধিসত্ত্ব ও বৌদ্ধ দেবী মূর্তির মাথার উপরে সাধারণত কুলেশের মিনিয়েচার মূর্তি থাকে। বৈরোচন কুলোদ্ধবা দেবীর মধ্যে রয়েছে মারীচী, চুণ্ডা, জাঙ্গুলী, বৈশ্যতারা, কনক প্রজ্ঞাপারমিতা, গ্রহমাতৃকা, বজ্রবারাহী, সিতাতপত্রা অপরাজিতা, উষ্ণীষ বিজয়া ইত্যাদি।

ধ্যানীবুদ্ধের পাঁচটি মূর্তি কল্পনা প্রায় একই ধরনের। পদ্মের উপর উপবিষ্ট ও ধ্যানরত। কিন্তু তাদের মুদ্রা আলাদা। বৈরোচন ধর্মচক্র মুদ্রায়, অক্ষোভ্য ভূমিস্পর্শ মুদ্রায়, রত্নসম্ভব বরদ মুদ্রায়, অমিতাভ সমাহিত মুদ্রায় ও অমোঘসিদ্ধি অভয় মুদ্রায় উপবিষ্ট থাকেন। মুদ্রা দেখেই প্রধানত ধ্যানীবুদ্ধ মূর্তি চিনিতে হয়।

ভারতবর্ষে বুদ্ধিস্ট আইকোনোগ্রাফি চর্চার পথিকৃৎ ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের লেখা ‘বৌদ্ধদের দেবদেবী’ গ্রন্থে পঞ্চবুদ্ধ সম্পর্কে বলা হয়, ‘সকলেই ধ্যানাসনে সমাধি অবস্থায় বসিয়া থাকেন। আসনের নিচে কমল থাকে। সকলেরই একটি মুখ এবং দুইটি হাত। তাঁহাদের নেত্র ধ্যানস্তিমিত ও অর্ধনিমীলিত। তাঁহাদের পরিধানে ত্রিচীবর থাকে এবং সকলেই অলঙ্কাররহিত হন। তাঁহাদের কেবল রং আলাদা, মুদ্রা আলাদা।’

সিলেটে ধ্যানীবুদ্ধ ভাস্কর্য প্রাপ্তি সম্পর্কে ‘কপার প্লেট অব সিলেট’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদক ও সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস গবেষক হিমাদ্রী দাশ পুরকায়স্থ বলেন, নবম-দশম শতকে সিলেট অঞ্চলে মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম বিশেষত বজ্রযান অনুসারীরা বেশ প্রবল ছিল। সিলেট শহরের লামাবাজার, লামাপাড়া ইত্যাদি নাম মহাযান বৌদ্ধদের যাজক লামাদের স্মৃতি বহন করছে। বিয়ানীবাজারের ধ্যানীবুদ্ধ মূর্তি সন্ধান পাওয়ার ঘটনা সিলেট অঞ্চলে অতীতে মহাযান পন্থার চর্চার প্রত্নপ্রমাণ। অনুসন্ধান করা হলে সিলেট অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের আরও নিদর্শন সন্ধান পাওয়া যেতে পারে বলে আমার ধারণা।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

3h ago