আমার দেখা চীনা প্রযুক্তি
‘জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও’ উক্তিটি কমবেশি সবারই জানা। হ্যাঁ, আসলেই জ্ঞান অর্জনের জন্য জীবনে অন্তত একবার হলেও চীন ঘুরে যাওয়া প্রত্যেকের উচিত বলে মনে হয়। প্রযুক্তির ছোঁয়া নেই এমন কোনো জায়গা এখানে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, চীনা প্রযুক্তির কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো এই লেখায়।
চীন নামটা শুনলেই আমরা বাংলাদেশিসহ আশপাশের অনেক দেশের মানুষ নাক সিটকাই। হয়তো তা স্বাভাবিক, কারণ দেশে কম দামি চীনা পণ্যের রমরমা বাণিজ্য দেখে আমরা ভাবি চীনও এই কম দামি জিনিসের মত নড়বড়ে। কিন্তু, বাস্তবতা আসলে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
ছোট্ট একটি গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। গতবছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে দেশ থেকে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন। তাদের বেশিরভাগই প্রথমবার চীনে এসেছিলেন। তাদের ইচ্ছা ছিল এখান থেকে সস্তায় কিছু চীনা পণ্য কিনে দেশে নিয়ে যাবেন। বলতে গেলে একেবারে খালি লগেজ নিয়ে তাদের এখানে আসা এবং কমদামী চীনা পণ্যে লগেজ ভরে দেশে নেওয়ার ইচ্ছা। তারা বেশ কিছু উন্নত দেশ ভ্রমণ করেছেন, কিন্তু তাদের এবারের অভিজ্ঞতা ছিল ধারণার বাইরে। রাস্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থা আর সু-উচ্চ নজর কাড়া বিল্ডিংগুলো তাদের খুব আকর্ষণ করেছিল। তাদের নিয়ে সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন দেশি বন্ধু মিলে বের হয়েছিলাম। তাদের আবাসিক হোটেলের আশপাশের কিছু মার্কেটে একটু ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে। কিছু শপিং মল, লোকাল মার্কেট ঘোরার পরে তারা এমন কিছুই পেলেন না যা দিয়ে অন্তত লাগেজের অল্প একটু জায়গাও ভরা যায়। একজন তো আমার কানের কাছে এসে বললেন, ‘কমদামী কিছু কম্বল, সিট কাপড় আমার খুব দরকার ছিল। এখানে পাওয়া যাবে না?’ আমি তাকে বলেছিলাম, ‘এখানে যেগুলোর যেমন দাম দেখলেন সবখানে ওই একই রকম হবে, দামের খুব সামান্য হেরফের হতে পারে।’ তখন তারা বললেন, ‘এর থেকে আমাদের দেশেই ভালো, অনেক কম দামে ভালো ভালো চাইনিজ জিনিস পাই।’
আসলে বাস্তবতা হচ্ছে- চীনারা যে দেশ যেমন দামে পণ্য চায় ঠিক সেই পরিমাণ পণ্য ওই দেশের জন্য তৈরি করে রপ্তানি করে। রপ্তানি বাণিজ্যে সবদেশকে টপকে নিজেদের বিশ্বের এক নম্বরে রাখার চীনা সরকারের এটা একটা অভিনব কৌশল বললেও ভুল হবে না। এদের নিজেদের ব্যবহৃত জিনিসের গুণগত মান ওসব পণ্যের ধারেকাছেও নেই। সবকিছু লিখে শেষ করার মতো ধৈর্য এবং সময় সত্যিই অপ্রতুল। তবুও কিছু বিষয় তুলে ধরলাম-
ট্রাফিক ব্যবস্থা ও গণপরিবহন
চীনাদের ট্রাফিক ব্যবস্থা সত্যিই নজর কাড়ার মতো। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের দেখা মেলে না, তবে অফিস টাইমে কিছু ট্রাফিক পুলিশ তাদের নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। তবুও কেউ ট্রাফিক সংকেত অমান্য করে চলে না। প্রত্যেক সিগনাল এবং সব রাস্তা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন, তাই ট্রাফিক নিয়ম অমান্যকারীকে তাৎক্ষণিকভাবে ক্যামেরায় ডিটেক্ট করে উপযুক্ত শাস্তির বিধান আছে। এজন্য বাধ্যতামূলক ট্রাফিক আইন মেলে চলা সকলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে সবাই মনে করে। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি কিন্তু, কোন হর্নের শব্দ শোনা যায় না। পথচারী যদি একটু অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটেন বা রাস্তা পার হন তাহলে প্রাইভেট কার, বাসসহ অন্যান্য যানবাহনের চালক নিজেরা অপেক্ষা করে পথচারীকে রাস্তা পারের সুযোগ করে দেয়। রাস্তায় বাস, ট্যাক্সি, ই-বাইক, সাইকেল চালানোর সময় কোনো প্রতিযোগিতা (কে কার আগে যাবে) নেই।
হেল্পার বা অন্য কারো সাহায্য ছাড়া বিশাল বিশাল বিলাসবহুল পাবলিক বাস একজন মহিলা বা পুরুষ চালকের তত্ত্বাবধায়নে যথাসময়ে গন্তব্যে আসা যাওয়া করছে। প্রতিবার রাউন্ড দেওয়ার পরপরই গ্যারেজে ঢুকলে দায়িত্বরত ব্যক্তি ১-২ মিনিটের ভিতর বাসগুলোকে ধুয়ে মুছে একবারে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। সবগুলো বাসে জিপিএস ব্যবস্থা চালু করা, তাই চালক ইচ্ছে করলেও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সময় ক্ষেপণ করার সুযোগ নেই। বাসগুলো সবই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, ভিতরে টিভি পর্দায় সার্বক্ষণিক বিভিন্ন ভিডিও চলে এবং প্রতিটা স্টপেজ আসার আগেই টিভি পর্দায় যাত্রীদের সতর্কতামূলক ঘোষণা দেওয়া হয়। ১ ইউয়ান (১২.৫ টাকা) দিয়ে ৫০-৬০ কিলোমিটার পথ যাওয়া যায়। তবে, যেখানেই নামবেন ওটাই দিতে হবে তা এক স্টপেজ পরে হলেও (অন্য প্রদেশে কম বেশি হতে পারে)। বাসের দরজাগুলো খোলা এবং বন্ধ হওয়া চালক তার সিটে বসেই নিয়ন্ত্রণ করে। সামনের দরজায় যাত্রী ওঠা এবং পিছনেরটা নামার কাজে ব্যবহৃত হয়। যাত্রী ওঠার পথে রাখা কিউআর কোড মোবাইলে স্ক্যান করে, ব্যাংক কার্ড পাঞ্চ করে বা নির্দিষ্ট বক্সে টাকা রেখে ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থা আছে। প্রতি বাসে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫টা ক্যামেরা আছে। যেগুলোর মাধ্যমে সব যাত্রীর ওঠানামা, ভাড়া পরিশোধ, চালকের সতর্কতা সার্বক্ষণিক কর্তৃপক্ষ তদারকি করেন। বাসে ওঠার পরেই সিটে বসার জন্য কেউ হুড়োহুড়ি করে না বরং সবাই দাঁড়িয়ে থাকতেই পছন্দ করেন।
মাটির নিচে আছে আরেক পৃথিবী। সেখানে মেট্রোরেলগুলো প্রতি ৫ মিনিট পর পর ঘুরে আসছে। খুব অল্প সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে মেট্রোরেলের জুড়ি নেই। কর্মস্থল থেকে বাসা শত শত মাইল দূরে হলেও মেট্রোরেলের সাহায্যে খুব সহজেই নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে পৌঁছানো যায়। প্রতিটি মেট্রোরেলের প্রবেশদ্বার, বের হওয়ার পথে সার্বক্ষণিক চলন্ত সিঁড়ি, পায়ে হেঁটে নামার সিঁড়ি, পাশাপাশি শারীরিক প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার নিয়ে ওঠা নামার সুবিধাসহ শীততাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিটা মেট্রো স্টেশনে টিকিট কাটা থেকে শুরু করে বের হয়ে আসার আগ পর্যন্ত আছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। কোনো রকম ঝামেলা ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য মেট্রোরেল ব্যবহার করা যাত্রীর সংখ্যা অন্যান্য গণপরিবহনের যাত্রীর চেয়ে বেশি।
রাস্তা ও হাইওয়ে
রাস্তাগুলো প্রায় সবজায়গাতেই আট লেনের। প্রত্যেক রাস্তাতেই ই-বাইক, সাইকেল চালানোর আলাদা লেনসহ পায়ে হেঁটে চলার ব্যবস্থা আছে। সব হাইওয়েগুলো এক্সপ্রেস ওয়ের আদলে তৈরি, মানে কোথাও গাড়ী না থামিয়ে নির্দিষ্ট লেন ধরে শত শত মাইল গতিতে যাওয়া যায়। হাইওয়ের কিছু কিছু জায়গায় টোল দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। টোল গেটগুলো আসার মাইল খানিক আগেই চালকের মোবাইলের অ্যাপে সিগন্যাল দেয় এবং টোলের ভাড়া মোবাইলে পরিশোধ করলেই গাড়ী গেটে আসার কিছুটা আগেই নিজ থেকেই খুলে যায়। যাতে ওখানে আসার পরে সময় নষ্ট না হয়। চীনের হাই স্পিড (বুলেট ট্রেন) ট্রেনের কথা সবারই জানা। যাতে রওনা হয়ে মানুষ বিমানের মত দ্রুত গতিতে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে পারে। এদের এখানে আলাদাভাবে কোনো বর্ষা মৌসুম না থাকায় গ্রীষ্মের চেয়ে শীতের দিনে বৃষ্টির আধিক্য দেখা যায়। এ কারণে গ্রীষ্ম মৌসুমে হাইওয়েসহ সব রাস্তাঘাটে বেশি ধুলো ময়লা জমে। এই ধুলো ময়লা পরিষ্কার করার জন্য সবখানেই অত্যাধুনিক কিছু গাড়ী আছে। গাড়ীগুলোর সাহায্যে রাতের শেষ প্রহরে সব রাস্তা ধুয়ে মুছে এমনভাবে পরিষ্কার করে দেখলে মনে হবে রাস্তাগুলো এইমাত্র তৈরি করা হয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ঝরা পাতা বা অন্যান্য ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য সেন্সরের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলা কিছু মেশিন আছে, সেগুলো কোনো চালক বা অন্য কারো সাহায্য ছাড়া নিজ থেকেই রাস্তা পরিষ্কার করে। ভোরের আলো ফোটার আগেই এসব কাজ সম্পন্ন হয়।
কংক্রিটের সুউচ্চ পাহাড় কেটে তার ভিতর দিয়ে চলে গেছে মাইলের পর মাইল টানেল (গাড়ি যাওয়ার রাস্তা), মেট্রো রেলের লাইন এবং সর্বোপরি পাহাড় কেটে অত্যাধুনিক আবাসন বানানোর চিত্র সবসময় চোখে পড়ে। একদিন পথে যেতে যেতে দেখতে পেলাম পাহাড়ের তলদেশে ডিনামাইটের বিশাল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাহাড় কাটার কাজ শুরু হয়েছে এবং মাস দুই পরে সেই সুউচ্চ কংক্রিটের পাহাড় কেটে পরিষ্কার করে সেখান থেকে চলে গেছে দৃষ্টিনন্দন রাস্তা। কোনো এলাকায় জনবসতি গড়ে তুলতে চাইলে আগে থেকে জনগণের চাহিদা, যেমন রাস্তা-ঘাট, বাজার, পানি-বিদ্যুৎ লাইন, যোগাযোগের যথাযথ ব্যবস্থা শেষ করেই তারপরে সেখানে মানুষ বসবাসের অনুমতি মেলে। নির্মাণ কাজের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় খুবই কম সংখ্যক শ্রমিকের উপস্থিতিতে অত্যাধুনিক সব বিশালাকৃতি যন্ত্রের সাহায্যে অল্প সময়ে সুউচ্চ অট্টালিকা, দীর্ঘ সেতু, দৃষ্টি নন্দন হাইওয়েসহ নজর কাড়া সব স্থাপত্য তৈরি হচ্ছে। নদীর পাড়গুলো বড়বড় কংক্রিটের পাথর দিয়ে এত সুন্দরভাবে বাঁধানো যে হাজার বছরেও সেগুলো কিছু হওয়ার নয়। প্রতিটা নদীর পাড় দিয়ে চলে গেছে দৃষ্টিনন্দন সবুজ অরণ্যে ঘেরা অত্যাধুনিক পার্ক এবং মানুষের হাঁটার রাস্তা।
সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরা
চুরি-ছিনতাই, বাটপারি, ব্লাকমেইল ছোট বড় যে কোনো অপরাধ করে এখানে কেউ পার পায় না। তাই এসব অপরাধ সংঘটিতও হয় না। হবে কি করে? সবকিছুই ক্যামেরায় রেকর্ডিং হচ্ছে। নিজের বাসা থেকে বের হয়েই আপনি ক্যামেরায় ট্র্যাকিং হতে থাকবেন আর সেটা চলবে যতক্ষণ না আবার আপনি বাসায় ফিরছেন ততক্ষণ। কোথায় নেই ক্যামেরা? প্রতিটা অলিগলি, মাঠ, পাহাড়, নদীর কিনারা, পার্ক, সুপার মল সবখানেই ক্যামেরা আপনাকে ডিটেক্ট করবে। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশে এত ক্যামেরা ট্র্যাকিং সিস্টেম আছে কিনা আমার জানা নেই। তাই এখানে কারো কোনো জিনিস হারানো গেলে সেটা খুঁজে বের করা যত সহজ, মানুষের নিরাপত্তাও পুরোপুরি নিশ্চিত। সবজায়গাতেই মানুষের চলাচল নিরাপত্তার চাঁদরে ঘেরা এবং কোনো রকম অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের (পুলিশ, সেনাবাহিনী) টহল চোখে পড়ে। একজন নারীও এখানে রাত ১২টার পরে সাইকেল চালিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরে।
কেনাকাটা
শ্রমিক থেকে উচ্চবিত্ত সবাই স্মার্ট ফোন (আইফোন, স্যামসাং, অপ্প, হুয়াউয়ে) ব্যবহার করে। কাছে একটা ফোন থাকলে কেনাকাটা বা দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য আর কোনো কিছুর দরকার পড়ে না। কারণ এখানে নগদ টাকার কোনো লেনদেন নেই বললেই চলে। সেটা যত বড় বা ছোট পরিমাণের লেনদেন হোক না কেন। সরাসরি ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত উইচ্যাট (চাইনিজদের সর্বাধিক ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম), আলি-পে (আলিবাবা পরিচালিত) অ্যাপসের মাধ্যমে সব কেনাকাটা কোনো ঝামেলা ছাড়াই মোবাইল ফোনে হয়ে যাচ্ছে। এই দুটো মোবাইলের অ্যাপসের কথা একটু আলাদাভাবে বলতেই হয়। এমন কোন দরকারি কাজ নেই যা এই অ্যাপস দুটোর সাহায্যে করা যায় না। যে কোনো পরিবহনের (বিমান থেকে ট্যাক্সি) অগ্রিম টিকিট বুকিং, হোটেল বুকিং, রেস্টুরেন্টে সিট বুকিং, প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় আর্থিক লেনদেনসহ অন্যান্য অনেক সুবিধাদি, এছাড়া সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ এবং জনপ্রিয় মাধ্যমসহ যে কোনো সময় যে কাউকে যে কোনো পরিমাণ তাৎক্ষনিক আর্থিক লেনদেনের নির্ভরযোগ্য দুইটি অ্যাপ হচ্ছে উইচ্যাট এবং আলিপে। প্রতিটা চীনা নাগরিকের এই অ্যাপ দুটো ব্যবহারের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনকে অনেক বেশি ছন্দময় এবং সহজ করে দিয়েছে।
চাইনিজ কৃষি
কৃষিতে আছে এদের অভিনব সাফল্য। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, সীমিত চাষযোগ্য কৃষি ভূমি নিয়ে এই বিশাল জনসংখ্যার দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা মেটানো খুবই কঠিন এবং চ্যালেঞ্জের। তাই বাধ্য হয়েই কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের উন্নত কৃষি নির্ভর পদ্ধতি এদের অনুসরণ করতে হয়। কৃষি জমি প্রস্তুত, বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল কেটে প্যাকেটজাত করা সবকিছু আধুনিক যন্ত্রপাতির ছোঁয়ায় খুবই সহজে হয়ে যাচ্ছে। চাহিদার তুলনায় চাষ যোগ্য কৃষি জমির অপ্রতুলতার কারণে বাধ্য হয়ে এরা হাইব্রিড শাকসবজি চাষ করে। একবার আমাদের পাশের একটা কৃষি ফার্মে গিয়ে দেখেছিলাম, সব সবজি গাছগুলোতে বাম্পার ফলন, সবজির ভারে গাছগুলোর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। কৃষি জমি থেকে শুরু করে সব জমি সরকারের তত্ত্বাবধায়নে থাকে, সরকার থেকে নির্দিষ্ট সময়ের লিজ নিয়ে তবেই কৃষকসহ অন্যান্য জনগণ ব্যবহারের অনুমতি পায়। সেজন্য জমাজমি নিয়ে কারো ভিতর কোনো বিরোধ নেই।
পরিবেশ বান্ধব ই-বাইক, সাইকেল, প্রাইভেট কার: রাস্তার দুপাশ দিয়ে রাখা আছে বিভিন্ন কোম্পানির সারি সারি ই-বাইক, সাইকেল আর প্রাইভেটকার। সবগুলোই সেলফ সার্ভিস, মানে নিজেদের ড্রাইভ করতে হবে, মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পরিবহনের গায়ে লাগানো কিউআর কোর্ড স্ক্যান করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক খুলে যায়। তারপর পথচারী নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছিয়ে সেগুলো আবার লক করে রাখে। যাতে করে অন্য কেউ আবার তা পুনরায় ব্যবহার করতে পারে। প্রাইভেট কারও একই ভাবে রাস্তার পাশে নির্দিষ্ট স্থানে পার্ক করে রাখা আছে, যারা ফ্যমিলিসহ একটু দূরে কোথাও যেতে চায় তাদের ক্ষেত্রে এটা খুবই উপযোগী। সেক্ষেত্রে অবশ্যই চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা লাগবে।
কর্মক্ষেত্রে নারী
রাস্তায় বা বিভিন্ন শপিং মলে সবখানে নারীর আধিক্য দেখা যায়। এগুলো দেখলেই সহজেই আচ করা যায় এখানে নারীরা অনেক বেশি কর্মক্ষম। দোকান পাট, বড় বড় শপিং মল, বাস, ট্রাক, মেট্রো সবকিছু নারীর তত্ত্বাবধায়নে চলে। নির্মাণ কাজের শ্রমিক হিসেবেও পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অধিক উপস্থিতি লক্ষণীয়।
গণপরিবহন এবং পাবলিক প্লেসে (পার্কসহ বিভিন্ন ঘোরার জায়গা) কোথাও হকার দেখতে পাওয়া যায় না। কোথাও কোনো ভিখারি চোখে পড়েনি। তবে, মাঝেমধ্যে রাস্তার পাশে জনবহুল কিছু এলাকায় শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র (ভায়োলিন, বাঁশি ইত্যাদি) বাজিয়ে বা নিজের গলায় স্পিকারে গান করতে দেখেছি। কারো মনে চাইলে তাদের সামনে রাখা কিউআর কোর্ড মোবাইলে স্ক্যান করে কিছু টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছে।
দেশকে উন্নতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে সবচেয়ে বেশি দরকার রিসার্চ এবং টেকনোলজি। এটাতেও চীনারা এখন বিশ্বের মধ্যে এক নাম্বারে অবস্থান করছে। একজন গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষককে এরা অনেক মূল্যায়ন করে। প্রায় সব সেক্টরেই বেশিরভাগ উন্নত দেশকে টপকে যাওয়া চীনের এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিছু খারাপ দিক: এরা সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তা রাস্তা পারাপার, গাড়ি চালানো, খাওয়া বা যে কোনো সময় হতে পারে। ইংরেজি প্রয়োজন না হওয়ায় ইংরেজিতে এদের দক্ষতা কম। কারণ ছোট থেকে এদের ইংরেজি শেখানো হতো না (বর্তমানে ভিন্ন), তাই ইংরেজিতে দক্ষতার লেভেল এদের বেশ নিচে। সব সফটওয়্যার, অ্যাপস নিজেদের ভাষায় ব্যবহার উপযোগী। এজন্য এসব ব্যবহারে ইংরেজির দরকার পড়ে না। সামান্য হাই-হ্যালো, ইয়েস-নো বলার মতো ইংরেজিও বেশিরভাগ মানুষের জানা নেই। এ কারণে চাইনিজ ভাষা না জেনে এখানে এলে প্রথমদিকে একটু বিপাকেই পড়তে হয়। চীনে গুগল ব্যবহারের অনুমতি নেই, তাই যে কেউ এখানে গুগল বা গুগলের কোনো অ্যাপস (জিমেইল, গুগল স্কলার, প্লে স্টোর ইত্যাদি) ব্যবহার করতে পারে না। ফেসুবক ব্যবহারেরও অনুমতি নেই। সেক্ষেত্রে ভিপিএন ব্যবহার করে গুগল সম্পর্কিত দরকারি কাজগুলো করতে হয়।
অজয় কান্তি মণ্ডল, পিএইচডি গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এবং ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি ফুজিয়ান, চীন।
Comments