‘সরকারের সমালোচনা করা নাগরিকের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার’
দেশের সব সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর গত ৭ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের একটি চিঠি সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশনা রয়েছে।
এই চিঠির ছয়টি পয়েন্টের প্রথমটিতে বলা হয়েছে, ‘সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।’ এছাড়াও আরও বেশ কিছু নির্দেশনা রয়েছে সেখানে।
প্রশ্ন উঠেছে, সরকার এভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে কিনা? এমন নির্দেশনা স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় কিনা? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়েছে লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর সঙ্গে।
মাউশির নির্দেশনা সম্পর্কে সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘সরকারের দিক থেকে এটা যদি পরামর্শ হতো তাহলে বলার কিছু থাকত না। কিন্তু এটা হুকুম বা নির্দেশ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এই ধরনের নির্দেশ স্বাধীন মতামত প্রকাশের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ। রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় এমন কোনো পোস্ট যদি কেউ দেন, এটা খুব বড় অপরাধ। সেজন্য তাকে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সরকারের ‘সরকারের ভাবমূর্তি’ বা ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি’র সংজ্ঞা কী? সংগত কারণে সরকারের সমালোচনা করা নাগরিকের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই জিনিসটি যদি নির্দেশ দিয়ে বন্ধ করা হয় তাহলে তা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ। সরকারের প্রশংসা করার অধিকার যেমন সবার রয়েছে, তেমনি রয়েছে সমালোচনা করার অধিকারও।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশনার প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘এই নির্দেশনা অত্যন্ত অবিবেচনা প্রসূত। এই নির্দেশনার কারণেই বরং সরকারের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলো।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী এই নির্দেশনার চিঠি সম্পর্কে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, এমসি কলেজের ঘটনার ফলে এমন চিঠির বিষয়ে চিন্তাটা এসেছে। সারা দেশের মানুষ ফুসে উঠেছে। সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনায় মানুষের ভেতরের যে ক্ষোভ তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে রাস্তার আন্দোলনে। চিঠিতে যে ক্লজগুলো দেখলাম তার সবগুলোই আইসিটি আইনে আছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই চিঠি দিয়ে সেগুলোই আবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের মত প্রকাশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে তার ইঙ্গিত হিসেবে আইসিটি আইনটিই যথেষ্ট। এই চিঠি দিয়ে আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া হলো যে সরকার মত প্রকাশসহ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে।’
রাস্তায় হওয়া আন্দোলন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশ দুটি ভিন্ন জিনিস উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই যে নোয়াখালীর যে ভিডিওটি ভাইরাল হলো, সেটা তো অবশ্যই রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। আইসিটির অপব্যবহার তো হচ্ছেই।’
সারাদেশে বিভিন্ন প্রান্তে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে না এলে কী এই ঘটনাগুলো রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে না? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটা তো করেই। এ বিষয়গুলো সমূলে উৎপাটিত তো হয় না। সমস্যার মূলে যাওয়াই হয় না। কারা এসব করছে? তাদের চিহ্নিত করলেই বোঝা যাবে সমস্যা কোথায়, মূল দোষী কারা। তাদের বেশির ভাগই তো নিরাপদে আছে। আন্ডার দ্যা ল, নট বাই দ্যা ল। তারা ব্যবসায়ী হতে পারে বা রাজনৈতিক নেতা হতে পারে।’
সেখানে আইসিটি আইন আছে সেখানে আর কোনো বিশেষ নির্দেশনার প্রয়োজন হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘুরে ফিরে কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সার্ভিস বা পেশার কথা এসেছে নির্দেশনায়। এর সবই আছে আইসিটি আইনে। যার কারণে এটা আলাদাভাবে ইস্যু করার কারণ আমার কাছে বোধগম্য না।’
এই নির্দেশনাটি বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্ম এবং শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বরং, বেড়ে চলা অপরাধের লাগাম টানা যেত। সত্যিকার অর্থে আইসিটির অপব্যবহার হলে বা মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। যারা আইসিটির অপব্যবহার করছে তারা সবাই তো আর শিক্ষার্থী নয়।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বারবার এইচএসসি পরীক্ষার তারিখ সম্পর্কে ভুয়া তথ্য দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কই, তখন তো কিছু করলো না। তাদের ধরল না কেন? এটা কি আইসিটির অপব্যবহার ছিল না? সেটাও তো আইসিটি আইনেই ধরা যেত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ নকল করে এসব করছে, অথচ তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি।’
Comments