দুঃস্বপ্নের জর্ডান

স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর নাজমা বেগম তার দুই সন্তানের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার লড়াই করতে বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ভাবেন, এটা তার জীবন বদলে দেবে।
নাজমা বেগম। ছবি: সংগৃহীত

স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর নাজমা বেগম তার দুই সন্তানের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার লড়াই করতে বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ভাবেন, এটা তার জীবন বদলে দেবে।

সত্যিই তার জীবন বদলেছে। তবে, তিনি যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে না।

ঝিনাইদহের মহেশপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ৩২ বছর বয়সী এই নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে হাউস কিপিংয়ের চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখান তার গ্রামেরই একজন। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জর্ডানে।

আরব দেশটিতে ১০ মাস থাকাকালীন বন্দিদশা ও নির্যাতনের শিকার হন নাজমা। ভাগ্য বদলে দিতে পারে এমন অর্থ নিয়ে ফিরে আসার পরিবর্তে, তিনি গত ১০ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরেন খালি হাতে। সঙ্গে বয়ে নিয়ে এসেছেন শারীরিক আঘাত এবং সেই আঘাতের গল্প।

নাজমা সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি আমার জীবনে এমন দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছে। আমি সেখানে আমার পরিবারের জন্য উপার্জন করতে গিয়েছিলাম। তার বদলে আমাকে বিক্রি হতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি মারাত্মক সমস্যায় আছি। আমার চিকিৎসা করার এবং সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য আমার কাছে কোনো টাকা নেই। এখন কী করব, তা আমি জানি না।’

তাকে বলা হয়েছিল, মাসে তাকে জর্ডানের ২৫০ দিনার বেতন দেওয়া হবে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু, তিনি জানতেন না কোন রিক্রুটিং এজেন্সি তাকে পাঠাচ্ছে এবং কোথায় তিনি কাজ করবেন। তার কাছে শুধু কয়েকজনের নাম ও ফোন নম্বর রয়েছে।

গত বছরের ১২ ডিসেম্বর তাকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। সেখানে কালো দাড়িওয়ালা একজন তাকে তার পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্র দেয়। নাজমা চলে যান জর্ডানের রাজধানী আম্মানে।

প্রতারণা

আম্মানে পৌঁছে তিনি বুঝতে পারেন তিনি ভুল করেছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই জানতে পারেন তিনি আটকা পড়েছেন এবং একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের শিকার হয়েছেন।

সেখানে যাওয়ার পরপরই আশরাফ নামে এক জর্ডানের নাগরিক তাকে বিমানবন্দর থেকে একটি অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যায় এবং বন্দি করে রাখে বলে অভিযোগ করেন নাজমা।

তিনি বলেন, ‘পরে আশরাফ আমাকে দুই বছরের চুক্তিতে মোহাম্মদ নামে স্থানীয় একজনের কাছে বিক্রি করে দেয়।’

মোহাম্মদের দ্বিতল বাড়িতে তিনি প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন যুবতীকে বন্দি অবস্থায় দেখতে পান। যাদের মধ্যে আট থেকে নয় জন বাংলাদেশি এবং বাকিরা ফিলিপাইন ও ইথিওপিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছিলেন।

নাজমা অভিযোগ করেন, মোহাম্মদ তার পাঁচটি মাইক্রোবাসের মধ্যে ওই নারীদের যৌনকর্মীর কাজ করতে বিভিন্ন হোটেল ও বাড়িতে পাঠাতেন। অনেককে গৃহকর্মী হিসেবেও বিভিন্ন বাড়িতে পাঠানো হতো।

যৌনকাজে অস্বীকৃতি জানালে মোহাম্মদ তাকে নির্দয়ভাবে মারধর করে এবং তার মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। যাতে বাংলাদেশে তার আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে।

ক্ষিপ্ত হয়ে মোহাম্মদ তাকে একটি ঘরে আটকে রেখে অত্যাচার চালায় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘নির্যাতনের ফলে প্রায়শই আমার নাক বেয়ে রক্ত পড়তো।’

উদ্ধার প্রাপ্তি

নির্যাতন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছালে অ্যাপার্টমেন্টের একজন ফিলিপাইনের নারী নাজমাকে নির্যাতনের ভিডিও করেন এবং ভিডিও কলিং অ্যাপের মাধ্যমে তা ঝিনাইদহে তার বোনের কাছে পাঠান।

নাজমার স্বজনরা ঝিনাইদহে মানবাধিকার ডিফেন্ডার ফোরামের মাধ্যমে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাহায্য নেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জর্ডানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহানকে চিঠি দেয় আসক। দূতাবাসের দ্রুত হস্তক্ষেপে নাজমাকে উদ্ধার করা হয়।

এমন গল্প রয়েছে আরও অনেক

সরকারি সূত্রে জানা যায়, জর্ডানে আনুমানিক ৭৫ হাজার বাংলাদেশি নারী এবং ২৫ হাজার বাংলাদেশি পুরুষ কাজ করেন।

অনিরাপদ অভিবাসনের একটি উদাহরণ নাজমা। তার এই পরিস্থিতি সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা শত শত নারীর গল্প।

এই অনিরাপদ অভিবাসনের অন্যতম কারণ গ্রামাঞ্চলে লাইসেন্সবিহীন দালালদের ওপর নির্ভরতা।

গণমাধ্যমের খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত চার বছরে ১৩ হাজার নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন।

তাদের বেশিরভাগই অভিযোগ করেছেন, তাদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের অপর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী বেতন দেওয়া হয়নি এবং চুক্তির সময়ের বাইরেও কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে।

সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে Nightmare in Jordan

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago